জানুয়ারি ০৬, ২০২৪ ২০:১৩ Asia/Dhaka

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-এ পর্যন্ত ব্যাংক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। সিপিডির এ প্রতিবেদনকে সঠিক বলে মনে করি। রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইসলামি ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স বিভাগের অধ্যাপক এবং সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড পিস স্টাডিজ এর নির্বাহী পরিচালক ড. মিজানুর রহমান।

তিনি আরো বলেন, এই ঘটনাগুলোর সাথে সরকারের বিভিন্নমহল জড়িত রয়েছে। যদি তাদের দেয়া তথ্য ফেক হতো তাহলে সরকার এর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিত। মামলা-মকদ্দমা করা হত, গ্রেপ্তার করাসহ অনেক কিছুই করা হত।

ড.মিজানুর আরো বলেন, সুশাসনের অভাবে এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন সিরাজুল ইসলাম। উপস্থাপনা, প্রযোজনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব, ড. মিজানুর রহমান, ২৪শে ডিসেম্বর সিপিডি এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ব্যাংক কেলেঙ্কারির মাধ্যমে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। মন্ত্রীদের কেউ কেউ বলছেন- এটা নির্জলা মিথ্যা। আবার সামাজিক মাধ্যমে অনেকে বলছেন -দুর্নীতির অর্থের পরিমাণ আরো অনেক বেশি। আপনি কী বলবেন?

সিপিডি

ড. মিজানুর রহমান: আপনার প্রশ্নের জন্য ধন্যবাদ। সিপিডি এই তথ্য দিয়েছে। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একটি থিঙ্কট্যাঙ্ক। অনেক গবেষণা করে তথ্য ও উপাত্ত্বের ভিত্তিতে সাংবাদিক সম্মেলন করে তারা বিষয়টি জনসমক্ষ্যে উপস্থাপন করেছেন। তাদের তথ্যে কোনো ফেক বা অসত্য থাকার সুযোগ নেই।

আর যদি সরকারের বিপক্ষে কথা বলার বিষয়টি থাকে সেক্ষেত্রে বলব তারা সেরকম কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। বরং সরকারের সাথে তাদের নেক নজর থাকার কথা। সুতরাং সিপিডির তথ্য সঠিক বলে আমি মনে করি। বাস্তবে অনিয়মগুলো বা ব্যঙ্ক কেলেঙ্কারির বিষয়টির -ঋণ অবলোপন, ঋণ পুনঃনির্ধারণ অথবা আদালতের স্থগিতাদেশ বিবেচনায় নিলে তার পরিমাণ আরো বেশি হবে। ঋণসহ নানা ধরনের অনিয়ম হয়েছে। সেগুলো অফিসিয়াল সুত্রের তথ্যের ভিত্তিতে তারা বিষয়টি তুলে ধরেছে।

অনিয়মের কারণে ২০১২ সাল থেকে এ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়েছে সাড়ে তিনগুণ। এরফলে ব্যাঙ্কের তারল্য সংকট বেড়েছে। আপনারা বিষয়টি জানেন যে, বাংলাদেশের বেশ কিছু ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি বলেই এই ঘটনাগুলো ঘটেছে।

আর আমি পরিস্কারভাবে বলতে চাই, এই ঘটনাগুলোর সাথে সরকারের বিভিন্নমহল জড়িত। আপনারা জানেন যে, বিরোধী মতের অনেক ছোট খাট ক্রুটিগুলোকে খুঁজে বের করে সেজন্য কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। অথচ এতবড় বড় ঘটনাগুলো ঘটে যায় তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয় না। কোনো কিছুই করা হয় না। আর সিপিডির দেয়া তথ্য সম্পর্কে সরকারের একটি মহল থেকে প্রতিবাদ করা হয়েছে। যদি তাদের দেয়া তথ্য ফেক হতো তাহলে সরকার এর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিত। মামলা-মকদ্দমা করা হত, গ্রেপ্তার করাসহ অনেক কিছুই করা হত। সেসব কিছুই যখন করা হয়নি তারমানে হচ্ছে সরকারও জানে যে, এই ঘটনাগুলো সত্য ও সঠিক।

রেডিও তেহরান: এরইমধ্যে কয়েকটি ব্যাঙ্কের অর্থ সংকটের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে। আপনার কী মনে হয়- ব্যাঙ্কগুলোর এই সংকট দূর করার ক্ষেত্রে সরকার ভূমিকা রাখতে পারত?

ড. মিজানুর রহমান: আমি অবশ্যই মনে করি সরকার ভূমিকা রাখতে পারত। বরং আমি মনে করি এই অর্থ কেলেঙ্কারির সাথে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যক্তি এরসাথে জড়িত। আপনি যে কয়েকটি ব্যাংকের কথা বলেছেন তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি ব্যাংক হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। বাংলাদেশের ৬ থেকে ৭ টি ব্যাংক একই মালিকের অধীনে। ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত তাদের মাত্র একটি ব্যাংক ছিল। আমি বলতে চাইছি ফোর্থ জেনারেশনের যে ব্যাংকগুলো করা হয়েছে তার সবগুলো পলিটিসাইজড। সবগুলোই পলিটিক্যাল লোকদেরকে দেয়া হয়েছে। ফলে এই অর্থ তছরুপসহ নানা কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে। ২০২৫ কিংবা ২০২৬ সালের দিকের আগের কথা বলছি। তখনকার অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, নতুন এসব ব্যাংকের দরকার নেই কিন্তু রাজনৈতিক কারণে দিতে হয়েছে। সেসময় ছয় থেকে সাতটি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়া হয়। তারপর থেকে এইসব ব্যাংকের অবস্থা করুণ হতে থাকে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বৃহৎ যে ইসলামি ব্যাংক লি. সেই ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংককে টাকা ধার দিত সেই ব্যাংক এখন তাদের চলতি আমানতের ঘাটতিতে পড়েছে। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব ব্যাংককে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে চলতি আমানতে যে ঘাটতি রয়েছে তার দ্রুত সমাধান করেন। তানাহলে আপনাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেয়া হবে। আমি মনে করি এসবই সরকারের বিভিন্ন মহলের ছত্রছায়ায় হয়েছে আর এরমধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনেক দুর্বলতা রয়েছে। তারা যদি ইচ্ছা করত তাহলে এটাকে সমন্বয় করা যেত এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করা যেত বলে আমি মনে করি।

রেডিও তেহরান: ড. মিজানুর রহমান,  দেশের ব্যাংক ব্যবস্থায় যে সংকট চলছে, তার পেছনে কোন কোন বিষয়কে আপনি মূল দায়ী বলে মনে করেন?

ড. মিজানুর রহমান: আমি এজন্য অন্যতম দুটি কারণের কথা বলব। আমি একটি আর্টিকেল লিখেছি সেখানে দুটি বিষয় উল্লেখ করেছি। বিষয় দুটি হচ্ছে- সুশাসন ও আস্থার সংকট।

সুশাসনের অভাবে এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন করে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছে। ব্যাংকের এসব বিষয় আইনের ভিত্তিতে নিয়মের ভিত্তিতে করে। জোর করে করা হয় এমন নয়। যারা এসব কাজ করেন তারা দেশের প্রচলিত আইনে তাদের পক্ষে তাদের মতো করে তৈরি করে দুর্নীতি এবং অন্যায় করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া হয়। সুতরাং আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি সরকারের সুশাসন জনগণের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ধরুন-বাংলাদেশ থেকে ডলার পাচার হয়ে যায়। তখন এটি একটি সংকট হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশি টাকা তো আর বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়না। এটাতো বিদেশে যায় না। ফলে বাংলাদেশি টাকা বাংলাদেশেই আছে। কিন্তু আস্থার সংকটের কারণে এই ব্যাংকগুলো ফাইনান্সিয়াল ইনক্লুশান বা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে টাকাগুলো আটকে আছে। মানুষের ঘরে ঘরে ব্যাংকের ভল্ট এখন। মাটির নিচে টাকা বিভিন্ন জায়গায় টাকা। এরপরও যদি আপনি একটি কারণের কথা জানতে চান-আমি বলব সুশাসন। আর দ্বিতীয় কারণ হিসেবে আমি আবারও বলব ব্যাংকগুলোর ওপর জনগণের আস্থার সংকট। তৃতীয় কারণ হিসেবে বলব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধির ফলে মানুষ তাদের সঞ্চয় ভেঙে খেয়ে ফেলতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো আমানতের সংকটে পড়ে গেছে। কাজেই আমি মনে করি সরকার যদি উদ্যোগ নিত তাহলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হত।

রেডিও তেহরান: ড.মিজানুর রহমান, সবশেষে  যে বিষয়টি জানতে চাইব সেটি হচ্ছে, সরকারের এক মন্ত্রীর বিদেশে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকার ব্যবসা রয়েছে তবে তিনি নির্বাচনী হলফনামায় এই তথ্য দেননি। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ বা টিআইবি। এটা কী টিআইবি’র বাড়াবাড়ি নাকি বাস্তবতা?

ড. মিজানুর রহমান:  টিআই একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা। তার বাংলাদেশি শাখা টিআইবি। এটি অত্যন্ত মানসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠান। সেজন্যেই দীর্ঘদিন ধরে এটি সফলভাবে টিকে আছে। কাজেই টিআইবির দেয়া তথ্য যথার্থ। আমি মনে করি এটি সঠিক। তারা বাড়াবাড়ি তো অবশ্যই করেনি বরং দেশের স্বার্থে তারা সহযোগিতা করেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। কানাডার বেগমপড়ার নাম আপনারা শুনেছেন। মালেশিয়া, কুয়েত ও কাতারসহ বিভিন্ন জায়গায় টাকা পাচার হয়েছে। আর সেই পাচার হয়ে যাওয়া টাকার কথা কোনো প্রার্থীর হলফনামায় আসবে না। ঐসব কালো টাকা তারা বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দেয়। ফলে টিআইবির দেয়া তথ্য ও কথা যথার্থ বলে আমি মনে করি।

রেডিও তেহরান: জনাব মিজানুর রহমান বাংলাদেশের ব্যাংক কেলেঙ্কারি নিয়ে সিপিডির প্রতিবেদন এবং বাস্তবতা নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ড. মিজানুর রহমান : আপনাকেও ধন্যবাদ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩

ট্যাগ