অপরাধ থেকে দূরে রাখতে যুব সমাজকে আত্ম-বিশ্বাসী ও আশাবাদী করাও জরুরি
সোনালী সময়-২০ (যুব সমাজ ও অপরাধ)
একটি জাতি বা দেশের উন্নয়ন অনেকাংশেই নির্ভর করে দক্ষ ও প্রতিশ্রুতিশীল যুব শক্তি এবং যুব সমাজের সুস্থতা ও সক্রিয়তার ওপর। যুব সমাজের মধ্যে অপরাধ ছড়িয়ে পড়লে সে জাতির বিপর্যয় অনিবার্য।
সমাজ-বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা গেছে আধুনিক যুগে যুব সমাজের নানা অপরাধ ও সামাজিক অবক্ষয়ের প্রধান কয়েকটি কারণ হল ক্রমবর্ধমান সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসম প্রতিযোগিতা, অপরিকল্পিত শহরায়ন বা নগরায়ন, শিল্পায়ন, মানসিক চাপ, বিকল্প-ধারার কর্মসংস্থানের অভাব, সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ ও খেলাধুলার সুযোগের অভাব। এ ছাড়াও গতানুগতিক শিক্ষা কার্যক্রম এবং বাস্তবধর্মী নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সংক্রান্ত শিক্ষার অভাব সব পর্যায়ে, বিশেষ করে যুব সমাজের অপরাধ-প্রবণতা বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্তি, এসব মাধ্যমের অপব্যবহার ও উদ্দেশ্যহীন ব্যবহারও যুব সমাজের অপরাধের অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রে নোংরা রাজনৈতিক কার্যকলাপে সম্পৃক্ততা ও ক্ষমতা প্রদর্শনের মোহও যুব সমাজকে অপরাধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
যুব সমাজের অপরাধী শ্রেণীর মধ্যে প্রচলিত অপরাধ-প্রবণতাগুলোর মধ্যে রয়েছে মিথ্যা কথা বলা, ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া, ভবঘুরে হওয়া, ভিক্ষাবৃত্তি করা, জিনিসপত্র বা সম্পদ ভাঙচুর করা বা ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানো, চুরি করা, মাদকাসক্তি, অন্যদের অধিকার পদদলন, যৌন-বিচ্যুতি... ইত্যাদি।
বেকারত্ব ও দুশ্চিন্তা আর হতাশা যুব সমাজের অপরাধ প্রবণতার অন্যতম প্রধান বা বড় কারণ। যেসব পরিবারের সদস্য শৈশবেই দারিদ্রের চাপ অনুভব করেছে সেইসব সদস্য যুব বয়সে অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বংশগত কোনো অসুস্থতা বা শারীরিক ত্রুটি অপরাধের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। অনভিজ্ঞতা, অসচেতনতা ও সুশিক্ষার অভাবও যুব সমাজের উচ্ছৃঙ্খল তৎপরতার অন্যতম কারণ। এইসব সমস্যা এমনই যে রাতারাতি সেসবের সমাধান করা সম্ভব নয়। আজকাল তরুণ ও যুব সমাজের যৌন অপরাধসহ নানা অপরাধ-প্রবণতার পেছনে কাজ করছে নানা ধরনের গণ-মাধ্যমের পক্ষ থেকে অগঠনমূলক চিন্তার বিস্তার ও যৌন-উস্কানিমূলক তৎপরতা।
যুব সমাজের অপরাধ-প্রবণতা কমানোর সহায়ক কয়েকটি কাজ হল তাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের বা অভিভাবকের সুসম্পর্ক স্থাপন, নজরদারি করা, পরিবারের পরিবেশকে সুন্দর ও সুস্থ রাখা, পড়াশুনায় ভালো ফলাফল করার পরিবেশ গড়ে তোলা, ভালো ও সৎ বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে দেয়া, নানা ধরনের খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও জ্ঞান-বিজ্ঞান-ভিত্তিক ক্লাব বা সমিতির সদস্য করা ইত্যাদি।
তালাক ও পরিবার ব্যবস্থার ভাঙ্গন যুব সমাজের অপরাধ-প্রবণতার অন্যতম প্রধান কারণ। তাই পরিবারগুলোকে সুখের নীড় হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যা যা করা দরকার সেসবই করতে হবে। ভালো পরিবার তথা ভালো বাবা ও মা এবং ভাইবোনের সংসর্গ আর নজরদারিসহ ভালো স্কুল ও ভালো সঙ্গী-সাথী বা বন্ধুও যুব সমাজের অপরাধ প্রবণতা নিয়ন্ত্রণের সহায়ক। পড়াশুনাসহ স্বাভাবিক দৈনন্দিন কার্যক্রম পরিচালনায় উৎসাহ দেয়া ও তাদের চাকরি অথবা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও যুব-অপরাধ কমিয়ে আনার সহায়ক।
যেসব সন্তান শৈশব থেকেই মা-বাবার আদর-যত্ন পায়নি কিংবা পরিবারের কোনো কোনো সদস্যের অপ্রীতিকর আচরণের শিকার হয়েছে তাদের এক বড় অংশ পরবর্তীকালে অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর সদস্য হয় এবং তারা প্রতিহিংসাপরায়ন হয়ে ওঠে। পরিবারের ভেতরেই যদি অনৈতিকতার চর্চা হয় ও পরিবারের সদস্যদেরকে ধর্ম বা পরকালীন বিশ্বাস সম্পর্কে উদাসীন রাখা হয় সেসব পরিবারের সদস্য সহজেই অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। নীতি-নৈতিকতা, ন্যায়-অন্যায়, শালীনতা ও অশালীনতা বা লজ্জাহীনতা ও হালাল-হারাম সম্পর্কে যুব সমাজকে সুশিক্ষিত করতে হবে শৈশব ও কৈশোর থেকেই এবং এ সংক্রান্ত শিক্ষা পরিবারের অভিভাবকদের পক্ষ থেকেই প্রচার করতে হবে সন্তানদের মধ্যে।
একটি ভালো স্কুল ও স্কুলের শিক্ষকদের পক্ষ থেকে সুশিক্ষা প্রদানের বিষয়টিও যুব সমাজকে মানসিক দিক থেকে সুস্থ রাখার জন্য জরুরি। স্কুলের শিক্ষকদের আচরণে যদি শ্রেণী-বৈষম্য, ধনী-তোষণ, সাম্প্রদায়িকতা-এসব দেখা যায় তাহলে তার বিরূপ প্রভাব ছাত্রদের ওপর পড়বেই। যুব সমাজকে অধ্যবসায়ী, ধৈর্যশীল, দায়িত্বশীল, ঐক্যকামী, সহনশীল, সামাজিক, সৃষ্টিশীল এবং সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় সংগ্রামী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যথাযথ কর্মসূচি ও শিক্ষা প্রদান জরুরি।
যুব সমাজকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে হলে সমাজ থেকে বঞ্চনা, দারিদ্র, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যগুলোও দূর করতে হবে। তবে ইসলাম ধর্ম দারিদ্রের মধ্যেও সততা বজায় রাখার সুশিক্ষা দেয়। অপরাধ প্রবণতা দূর করতে দেশ ও জাতির সংবাদ-মাধ্যম ও গণমাধ্যম এবং বিনোদন বা সাংস্কৃতিক মাধ্যমগুলোকেও হতে হবে সংস্কারকামী, ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার প্রচারক, উদার, জনকল্যাণকামী এবং সব ধরনের সংকীর্ণতা হতে মুক্ত। টেলিভিশনের ভালো বা শিক্ষণীয় অনুষ্ঠানমালা ও ভালো চলচ্চিত্র এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। চলচ্চিত্র বইয়ের চেয়েও বেশি প্রভাব রাখে গণ-মানসে। অপরাধ থেকে দূরে রাখতে যুব সমাজকে আত্ম-বিশ্বাসী ও আশাবাদী করাও জরুরি। মানুষ যখন বুঝতে পারে যে সে হচ্ছে আল্লাহর প্রতিনিধি ও সৃষ্টির সেরা জীব তখন সে অপরাধে জড়িত হতে পারে না। এ জন্যই বলা হয় যে নিজেকে চিনতে পারে সে আল্লাহকেও চিনতে পারে। আত্মবিশ্বাস ও মহান লক্ষ্যগুলোর প্রতি আগ্রহ গড়ে তুলতে হলে যুব সমাজকে শৈশব থেকেই সুশিক্ষার পথে রাখতে হবে এবং বাবা-মায়ের ও পরিবারের বড়দের আচরণও হতে হবে সুশিক্ষার বাস্তব দৃষ্টান্ত। #
পার্সটুডে/০৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।