জুলাই ২১, ২০১৬ ১৮:৩৯ Asia/Dhaka

 ‘মাকবারাতুশ শোয়ারায়ে তাব্রিয’ নামে একটি নামকরা গোরস্তানের কথা সাহিত্য সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জেনে থাকবেন। গোরস্তানটি একর্থে যেন ইরানী সাহিত্যের সমৃদ্ধ ইতিহাসের বাস্তব সংকলন যা দেশের সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক সীমা পরিসীমা পেরিয়ে চলে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন দিগন্তে। বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থে বিধৃত তথ্য অনুযায়ী ইরানসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অন্তত ৪০০ জন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এবং স্বনামখ্যাত বহু মনীষীকে প্রায় আট শ’ বছর আগে এখানে সমাহিত করা হয়েছে।

এঁদের মধ্যে সবার আগে অর্থাৎ হিজিরি চতুর্থ শতকে সমাহিত হয়েছেন বিখ্যাত কবি ‘আসাদি তূসি’। আমরা এ আলোচনার ধারাবাহিকতায় আরো কথা বলবো ইনশাআল্লাহ। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে,ইতোপূর্বে আমরা ইরানের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশ সফরে গিয়েছিলাম। সেখানকার ঐতিহাসিক তাব্রিয শহরের কথাও নিশ্চয়ই বুলে যান নি। তাব্রিয হলো পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের কেন্দ্রীয় শহর। যতোটাই ঘুরেছি আমরা এই শহরটিতে, তারপরও অনেক কিছুই থেকে গেছে দেখার বাকি। আজো তাই চলুন অন্য কোনো শহরে যাবার আগে শেষবারের মতো ঘুরে বেড়াই শহরটির না দেখা এলাকাগুলো। এখানে দেখার বাকি আছে ঐতিহাসিক অনেক স্থাপনা। নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন তাব্রিয বহু প্রাচীনকাল থেকেই বড়ো বড়ো মনীষীদের পদচারণায় ছিল সমৃদ্ধ। স্বনামধন্য অনেক কবি, কালজয়ী কতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বকে যে লালন করেছে এই তাব্রিয তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এ কারণে ইরানের এই প্রদেশটি সবসময়ের জন্যেই আলাদা গুরুত্বের অধিকারী ছিল এবং এখনো আছে।

তাব্রিযে যেসব মনীষী জীবনযাপন করেছেন তাঁদের অনেকেই ইরানের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আয়াতুল্লাহ কাজি তাবাতাবায়ি এবং আয়াতুল্লাহ মাদানী ছিলেন এই শহরের বিখ্যাত দুইজন আলেমে দ্বীন। তাঁরা ইসলামী বিপ্লব বিরোধী সন্ত্রাসীদের শিকার হয়ে শাহাদাৎবরণ করে চির অমর হয়ে আছেন। ইবাদাতের মেহরাবে শহীদ হয়েছিলেন তাঁরা। আল্লামা মুহাম্মাদ তাকি জাফরি, আল্লামা সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন তাবাতাবায়ি এবং আল্লামা আব্দুল হোসাইন আমিনী তাব্রিযেরই আরো ক’জন মহান মনীষী। দ্বীনী শিক্ষা দীক্ষার ক্ষেত্রে যে কজন আলেস- ওলামা ব্যাপক অবদান রেখে গেছেন এবং যাদেরকে নিয়ে আজারবাইজান গর্ব করে বেড়ায় তাঁদের অন্তর্ভুক্ত হলেন এইসব মনীষী। ক্যালিগ্রাফি বা চারুলিপীর জনপ্রিয় ফন্ট নাস্তালিকের উদ্ভাবক মির আলী তাব্রিযিও এই তাব্রিয শহরেরই কৃতী সন্তান ছিলেন।

তাব্রিয শহরের বিভিন্ন এলাকার মাঝে ‘কুয়ি সোরখব’ নামক স্থানটি খুবই নামকরা। ‘কুয়ি সোরখবে’র শাব্দিক অর্থ হলো ‘লালচে পাহাড়’। এই পাহাড়ের এতো নাম বা মর্যাদার কারণ হলো এখানে সমাহিত হয়েছেন বড়ো বড়ো সব কবি সাহিত্যিক ও অন্যান্য মনীষী। খ্যাতিমান ব্যক্তি মাত্রই এখানে সমাহিত হবার ইচ্ছে পোষণ করেন। কুয়ি সোরখবে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু স্থাপনা এবং বহু আধ্যাত্মিক মনীষীর মাযার। এসবের কারণে এই স্থানটি সবার কাছেই পবিত্র হিসেবেও পরিগণিত। আজ না হয় এখানকার কটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক।

তাব্রিযের কুয়ি সোরখবে রয়েছে বহু মসজিদ এবং সমাধি। এগুলোর মাঝে বরকতময় এবং পবিত্র একটি মসজিদ ও সমাধি হলো সাইয়্যেদ হামযা মসজিদ ও সমাধি। এই সমাধিতে যেসব পাথরের কাজ করা হয়েছে, তা থেকে এই সমাধিটির এতো সম্মান ও মর্যাদার বিষয়টি প্রমাণিত হয়ে যায়। পাথর কাটা শিল্প অত্যন্ত প্রাচীন একটি শিল্প মাধ্যম। সেই পাথরের ওপর নকশা কাটা আরো কঠিন একটি শিল্পের নিদর্শন। সাইয়্যেদ হামযা সমাধিতে এইসব প্রাচীন অথচ কঠিন শিল্পগুলোর কাজ এতো নিপুণভাবে করা হয়েছে যে পুরো স্থাপনাটিকেই দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছে। সমাধিটির সর্বপ্রথম স্থাপনার তারিখ উল্লেখ রয়েছে সাত শ’ চৌদ্দ হিজরি। তবে এই স্থাপনাটি বেশ কয়েকবার মেরামত করা হয়েছে। সাইয়্যেদ হামযা সমাধির পাশে রয়েছে তাব্রিযের মাকবারাতুশ শোয়ারা অর্থাৎ কবি সাহিত্যিকদের কবরস্থান। গোরস্তানটি যেন ইরানী সাহিত্যের সমৃদ্ধ  ইতিহাসের বাস্তব সংকলন যা দেশের সাংস্কৃতিক এবং ভৌগোলিক বলয়ের সীমা পরিসীমা পেরিয়ে ছড়িয়ে গেছে বিশ্বময়।

ঐতিহাসিক এই গোরস্তানটির বর্ণনা সর্বপ্রথম যে বইটিতে পাওয়া যায় তা হলো হামদুল্লাহ মোস্তাওফি’র নুজহাতুল কুলুব। সাত শ’ চল্লিশ হিজরির রচনা এটি। এরপর হিজরি ১১৯৩ এবং ১১৯৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পের ফলে মাকবারাতুশ শোয়ারা অর্থাৎ কবি সাহিত্যিকদের কবরস্থানটির ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখিন হয়। এই কবরস্থানের গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে পুনরায় তাকে নতুন করে নির্মাণ করা হয়।

নতুন করে গড়ার ফলে স্মৃতিময় গোরস্তানটি তার পুরোণো চেহারাটিতে নতুন প্রলেপ আর নতুন স্থাপত্যের আদলে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। পুরো একটা সাংস্কৃতিক অঙ্গনে গড়ে ওঠা সমাধিস্থলটির নতুন আঙ্গিকের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের পর এর কাজ সম্পন্ন হয়। ইরানের সমকালীন স্থাপত্য নিদর্শনের ক্ষেত্রে এই মাকবারাতুশ শোয়ারা অর্থাৎ কবি সাহিত্যিকদের কবরস্থানটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং স্মৃতিময় একটি স্থাপনা। বিগত চল্লিশ বছর ধরে দর্শনার্থীদেরকে এর সৌন্দর্য ও চমৎকারিত্ব যেভাবে আকৃষ্ট করে যাচ্ছে সেটাই এই দাবির যথার্থ প্রমাণ বহন করে।

বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থে বিধৃত তথ্য অনুযায়ী ইরানসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের অন্তত ৪০০ জন বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এবং স্বনামখ্যাত বহু মনীষীকে প্রায় আট শ’ বছর আগে মাকবারাতুশ শোয়ারায় সমাহিত করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে সবার আগে অর্থাৎ হিজরি চতুর্থ শতকে সমাহিত হয়েছেন বিখ্যাত কবি ‘আসাদি তূসি’। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন কাতরান তাব্রিযি, মুজির উদ্দিন বিলকানী, খাকানী শিরভনি, জহির উদ্দিন ফারিয়াবি, শাহপুর নিশাবুরি, শামসুদ্দিন সাজ্জাসি, খাজা হুমাম তাব্রিযি, মানি শিরাযি, শাকিবি তাব্রিযি, লাসানি শিরাযি, জুলফিকার শেরভানি এবং সাইয়্যেদ মুহাম্মাদ হোসাইন শাহরিয়রসহ আরো বহু মনীষী।

বীর যোদ্ধা শেখ মোহাম্মাদ খিয়াবনী, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব মির্যা আলী সেকাতুল ইসলাম তাব্রিযি, কবি, লেখক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডক্টর মাহদি রৌশান যামির, কোরআনে কারিম লেখক ও বিশিষ্ট ক্যালিগ্রাফিস্ট ওস্তাদ মির্যা তাহের খোশনেবিসে তাব্রিযি, আহলে বাইতের ওপর কবিতা লেখক বিশিষ্ট কবি সাইয়্যেদ ইউসুফ নাজমি এবং মাহমুদ মালমসি’র কবরও এই মাকবারাতুশ শোয়ারাতেই রয়েছে।

মাকবারাতুশ শোয়ারা গোরস্তান ছাড়াও সাহেবুল আম্‌র সমাধিটিও তাব্রিযের ঐতিহাসিক এবং যিয়ারতের স্থান হিসেবে সবার কাছেই সমাদৃত। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে কোরআন মিউজিয়ামও স্থাপিত হয়েছে এখানে। বিভিন্ন যুগের কোরআনের দৃষ্টিনন্দন বহু নমুনা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে এখানে। ওস্তাদ শাহরিয়র সাহিত্যিক মিউজিয়ামও তাব্রিযের দর্শনীয় আরেকটি নিদর্শন। শাহরিয়র ছিলেন ইরানের বিখ্যাত একজন কবি।*

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২১