আজারবাইজান: মারাগেহ পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও লাল গম্বুজ
‘দেখবো ঘুরে ইরান এবার’ নামক পর্যটনমূলক ধারাবাহিকে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের মারা’গেহ’ শহরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের কথা হয়তো শুনে থাকবেন আপনারা। ইরানের বিখ্যাত বিজ্ঞানী ‘খাজা নাসিরুদ্দিন তূসি’র তত্ত্বাবধানে এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ারটি গড়ে উঠেছিল। শহরের উত্তর দিকের একটি টিলার ওপরে ১২৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নির্মিত হয়েছে এই টাওয়ারটি।
পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে, তাব্রিযের দক্ষিণে মোটামুটি প্রশস্ত এবং উর্বর একটা সমতলভূমিতে, সাহান্দ আগ্নেয়গিরি আর উরুমিয়ে হ্রদের মাঝে রয়েছে ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও সমৃদ্ধ শহর মারা’গেহ। শহরটি দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে গেছে। উত্তরাংশটিতে পড়েছে সাহান্দ পর্বতের উচ্চভূমির দক্ষিণ উপত্যকা। আর শহরটির কেন্দ্রীয় এবং দক্ষিণাঞ্চলে পড়েছে সমতল প্রান্তর। মারা’গেহ শহরের আবহাওয়া বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলের আবহাওয়া মোটামুটি নাতিশীতোষ্ণ। তবে সমতল প্রান্তর বা হ্রদের তীরবর্তী এলাকার আবহাওয়াটা উষ্ণ। তবে দক্ষিণ অংশের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং কোনো কোনো এলাকার আবহাওয়া ঠাণ্ডা। অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর হলো মারা’গেহ। এই শহরে কৃষিজ পণ্য উৎপন্ন হয় প্রচুর, সেইসাথে পশুপালন এবং তা থেকে উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীও প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন হয়।
অনেক প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার উর্বর মাটি কৃষিপণ্যের জন্যে বেশ উপযোগী এবং বিচিত্র কৃষিজ পণ্য সামগ্রী উৎপন্নও হয়ে আসছে। পার্বত্য উপত্যকায় অবস্থানের কারণে পাহাড় চুঁইয়ে নেমে আসা পানি বয়ে আনে প্রচুর পরিমাণে পলিময় মাটি। মুসলমান ভূগোলবিদ ইবনে হোকাল হাজার বছর আগে আর বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ হামদুল্লাহ মোস্তাওফি ছয় শ’ ষাট বছর আগে মারা’গেহ শহরের ব্যাপক প্রশংসা করেছিলেন। এখানে ছিল প্রচুর পরিমাণ ফল বাগান আর কৃষিজ পণ্য। এগুলো তাঁদেরকে মুগ্ধ করেছিল বলেই প্রশংসা করেছিলেন। বহু রকমের ও জাতের ফল বাগান ছিল মারা’গেহ শহরে। অন্তত ছাব্বিশ রকমের আঙুরই এ এলাকায় উৎপাদিত হতো। এতো ব্যাপক পরিমাণ ফল তো তো আর খেয়ে শেষ করা যেত না, তাই বাড়তি ফলগুলোকে শুকানোর ব্যবস্থা ছিল। এভাবে মারা’গেহ শহর হয়ে উঠেছিল শুকনো ফল বা ড্রাই ফ্রুটসের শহর। নিজেদের চাহিদা মেটানোর পর বাড়তি শুকনো ফলগুলো ইরানের অপরাপর শহরে পাঠানো হতো। এভাবেই সমগ্র ইরানজুড়ে মারা’গেহ শহরের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল।
মারা’গেহ শহরে অন্তত তিন শতাধিক ঐতিহাসিক নিদর্শন আছে। এই শহরে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের ১১০ টি নিদর্শন রয়েছে জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায়। কাল পরিক্রমায় এখানে জন্ম নিয়েছেন বহু শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, আধ্যাত্মিক মনীষী। পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশের গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি ইরান এবং আজারবাইজানের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন। অবশ্য কতোটা প্রাচীন সে সম্পর্কে প্রকৃত ইতিহাস ততোটা সুস্পষ্টভাবে পাওয়া না গেলেও প্রাপ্ত তথ্যপঞ্জি থেকে মনে করা হয় খ্রিষ্ট জন্মের আগেই মারা’গেহ শহরটি গড়ে উঠেছিল। এখানকার সাহান্দ আগ্নেয়গিরিতে অগ্ন্যুৎপাতেরও আগে এখানে বাস করতো বিশালদেহি সব জন্তু জানোয়ার। যেসব জীবাশ্ম এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকেই এই শহরের প্রাচীনত্ব নির্ণয় করা হয়েছে। তবে জীবাশ্ম পাওয়া যাবার কারণে এ নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের জন্যে খুবই মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে মারা’গেহ।
আজারবাইজান প্রদেশের সবচেয়ে বড়ো শহর হচ্ছে তাব্রিয, তাব্রিযের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হলো মারা’গেহ। মারা’গেহ শহরের জনসংখ্যা দুই লাখ ষাট হাজারের মতো। ইরানে ইসলাম পরবর্তী ইতিহাসে এই শহরটি আলাদা বৈশিষ্ট্যে গুরুত্বপূর্ণ ও সমাদৃত হয়ে উঠেছে। খ্রিষ্টিয় তেরো শতক থেকে খ্রিষ্টিয় চৌদ্দ শতকের মধ্যে অর্থাৎ এইলখানের যুগে মারা’গেহ শহরটি রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। এই সময়টাতেই মূলত মারা’গেহ শহরটি নতুনভাবে প্রাণবন্ত ও উন্নত হয়। এ সময় মারা’গেহ শহরে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশাল একটি বিশ্ববিদ্যালয়, গড়ে উঠেছিল পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এর ফলে জ্ঞান পিপাসু ছাত্র আর গবেষকগণ আসতে থাকেন এই শহরে।
পর্যবেক্ষণ টাওয়ারটি অবশ্য মারা’গেহ শহরে গড়ে উঠেছিল ইরানের বিখ্যাত মনীষী খাজা নাসির উদ্দিন তূসি’র তত্ত্বাবধানে। কালক্রমে এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ারটিই হয়ে ওঠে মারা’গেহ শহরের অন্যতম বিখ্যাত একটি স্থাপনা। ১২৫৯ খ্রিষ্টাব্দে টাওয়ারটি নির্মিত হয়েছে। শহরের উত্তর দিকের একটি উঁচু টিলার ওপর গড়ে তোলা হয়েছিল এটি। প্রাপ্ত তথ্যপঞ্জি অনুযায়ী দীর্ঘদিন পর্যন্ত টাওয়ারটি তার অবস্থানে অটুট থাকার পর মারাত্মক এক ভূমিকম্পের আঘাতে টাওয়ারটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। এখন আর তার ধ্বংসাবশেষের ক্ষত চিহ্ন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। অবশ্য ঐতিহাসিক আরো অনেক স্থাপনা ও নিদর্শন রয়েছে এই শহরে। আর এসব নিদর্শন থেকেই উপলব্ধি করা যায় যে প্রাচীনকালে শহরটির ঔজ্জ্বল্য ছিল চোখে পড়ার মতো। এরকম একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা হলো ‘গোম্বাদে সোর্খ’ বা লাল গম্বুজ। শহরের দক্ষিণ পশ্চিম অংশে অবস্থিত এই গম্বুজটি মারা’গেহ’র প্রাচীনতম স্থাপনাগুলোর একটি। ঐতিহাসিক তথ্য-প্রমাণ অনুসারে আব্দুল আযিয বিন মাহমুদ বিন সাদের আদেশে ১১৪৭ খ্রিষ্টাব্দে গোম্বাদে সোর্খ গম্বুজটি নির্মিত হয়েছিল।
গোম্বাদে সোর্খ নামে গম্বুজটির পরিচিতির একটা কারণ আছে। কারণটা হলো এটি তৈরি করা হয়েছিল যেসব ইট দিয়ে, সেই ইটগুলো ছিল লাল রঙের। আর ফার্সি ভাষায় সোর্খ শব্দের অর্থ হলো লাল। গম্বুজটির উত্তরাংশের মূল প্রবেশদ্বারে কবরস্থান রয়েছে। এতে জ্যামিতির বিভিন্ন ফর্মে বিচিত্র আকৃতির ইটের ব্যবহার রয়েছে। এগুলো ইরানী স্থাপত্য শিল্পীদেরই আবিষ্কার। এছাড়াও এই গম্বুজ স্থাপনায় ব্যবহার করা হয়েছে নীল রঙের সিরামিক, ইটের কাজ, চক প্লাস্টারের সূক্ষ্ম কারুকাজ এবং অনেক রকম লিপীকর্ম। ঐতিহাসিক এই নিদর্শনটির অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হলো এইসব কারুকাজ। বিশেষ করে ফিরোযা রঙের টাউলসের ব্যবহারের ফলে ইসলামী যুগের শিল্প ও স্থাপত্য নিদর্শনের একটি ধারারই প্রকাশ ঘটেছে। ৯০০ বছর ধরে আজো এই গম্বুজটি কালের ইতিহাসের অটুট স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে।
মারা’গেহ’র আরেকটি নিদর্শন হলো আওহাদি মারা’গেয়ির কবর। এই নামে পরিচিত হলেও তাঁর প্রকৃত নাম ছিল রুকনুদ্দিন আবুল হাসান মারা’গি। সবুজে ঘেরা চমৎকার একটি স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। তিনি ছিলেন একদিকে একজন বড়ো আরেফ বা আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, অপরদিকে ছিলেন নামকরা কবি। তাঁর বিখ্যাত একটি মাসনাবির নাম হলো ‘জমেজাম’। আনুমানিক ৬৭০ হিজরিতে তিনি মারা’গেহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আরো দুটি বিখ্যাত বই হলো ‘দাহ নমে’ মানে দশ চিঠি এবং মানতেকুল এশাক।*
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/২৩/টি-৪১/অ-৪১