আগস্ট ০৪, ২০১৬ ১৬:১৮ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশটির প্রাচীন এবং বেশ সমৃদ্ধ হস্তশিল্প সামগ্রীর সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। এগুলোর আকর্ষণীয় সৌন্দর্য নিশ্চয়ই আপনাদের মুগ্ধ না করে পারে না। আজ আমরা যাবো পশ্চিম আজারবাইজানে। সেখানকার সুন্দর সুন্দর এবং সমৃদ্ধ স্থান, স্থাপনার সাথে পরিচিত হবো আমরা। চলুন তাহলে যাওয়া যাক।

ইরানের একেবারে উত্তর পশ্চিমে আজারবাইজান প্রজাতন্ত্র, তুরস্ক, ইরাকের সীমান্তবর্তী এলাকাজুড়ে ইরানের অপূর্ব সুন্দর যে প্রদেশটি রয়েছে তার নাম পশ্চিম আজারবাইজান। অপূর্ব সুন্দর বললাম এজন্যে যে এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যেমন অদ্ভুত তেমনি এখানকার আবহাওয়াও অত্যন্ত মনোরম। এই প্রদেশের দক্ষিণ এবং পূর্বদিকে রয়েছে কুর্দিস্তান, পূর্ব আজারবাইজান এবং যানজন প্রদেশ। পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশটি উরুমিয়ে হ্রদের কারণেই বেশিরভাগ পরিচিত এবং বিখ্যাত। বিশাল এই হ্রদটির আয়তন তেতাল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটার। এই হ্রদটি অবশ্য ইরানের পূর্ব এবং পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশ দুটির মাঝখানে পড়েছে। তবে পশ্চিম আজারবাইজানেই উরিুমিয়ে হ্রদটির বেশিরভাগ অংশ পড়েছে। পশ্চিম আজারবাইজান ইরানের পার্ব ত্য অঞ্চলগুলোর অন্যতম। এই এলাকাটির অন্তত সত্তর ভাগ ভূখণ্ডই পার্বত্য। বাকি এলাকা উপকূলীয় সমতল অথবা পর্বত মধ্যবর্তী সমতল অঞ্চল। এ অঞ্চলই জনসংখ্যাবহুল এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।

সারদাশত

পশ্চিম আজারবাইজানের আবহাওয়া খুবই উপভোগ্য। কেননা আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভূমধ্যসাগরের বুক ছুঁয়ে আসা কোমল ও সতেজ বাতাস এ অঞ্চলের ওপর দিয়ে রেশমি পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়। ঈষৎ আর্দ্র সেই ছোঁয়া মনের ভেতর জাগিয়ে তোলে নির্মল সতেজতা। তবে শীতের মাসগুলোর কোনো কোনোটিতে উত্তর দিক থেকে আসা কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস ভূমধ্যসাগরীয় আবহাওয়াকে ছাপিয়ে যায়, যার ফলে এখানকার আবহাওয়ার উষ্ণতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। পশ্চিম আজারবাইজানের আবহাওয়াও পূর্ব আজারবাইজানের মতোই ঠাণ্ডা এবং আর্দ্র। শীতকালে এখানে ব্যাপক বরফ পড়ে এবং দীর্ঘ সময় ধরে এই বরফ জমাট বেঁধে থাকে। তবে গ্রীষ্মে এখানকার আবহাওয়া থাকে যথেষ্ট উপভোগ্য, নাতিশীতোষ্ণ এবং বেশ মোলায়েম। ইরানের উত্তরাঞ্চলীয় কাস্পিয়ান সাগরের তীরবর্তী উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ইরানের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় একটি বেশি।

তবে এ এলাকার পরেই পশ্চিম আজারবাইজানের অবস্থান। এখানেও প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয়। এই বৃষ্টিপাতের কারণে যে ব্যাপারটি লক্ষ্যনীয়ভাবে পশ্চিম আজারবাইজানে গড়ে উঠেছে তা হলো সবুজ বনানী আর ঘাস-লতাগুল্মময় বিস্তীর্ণ চারণভূমি। প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপশহরগুলো আর সীমান্তের পার্বত্য উপকূলীয় এলাকাতেই বেশিরভাগ জঙ্গল দেখা যায়। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জঙ্গলটি পড়েছে এই প্রদেশের “সারদাশ্‌ত” এলাকাতে। এখানকার বনাঞ্চলের সর্বমোট আয়তন প্রায় তিন শ বিশ হেক্টরের মতো। এই তো গেল বনাঞ্চলের কথা। এখানে যে বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর চারণভূমিও রয়েছে সে ব্যাপারে একটু আগেই ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। এইসব চারণভূমিতে বিচিত্র উদ্ভিদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এতো বিচিত্র উদ্ভিদ আর ঘাস-লতাপাতা থাকার কারণে চারণভূমিটি হয়ে উঠেছে পশুপালনের জন্যে উৎকৃষ্ট একটি স্থান।

উরুমিয়ে হ্রদ

পশ্চিম আজারবাইজানে বেশ সমৃদ্ধ চারণভূমির অস্তিত্ব থাকার কারণে স্বাভাবিকভাবেই এ এলাকাটি যে পশুপালনের জন্যে সমগ্র ইরানের মধ্যেই উত্তম একটি কেন্দ্রে পরিণত হবে-তাতে আর আশ্চর্য হবার কী আছে। বৃষ্টির কারণে এবং এ অঞ্চলের মাটি বেশ উর্বর হবার ফলে এখানে ব্যাপক পরিমাণে কৃষিপণ্য উৎপন্ন হয়। কৃষিজ অর্থনীতির দিক থেকে ইরানের এ অঞ্চলটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার বাগানগুলোতেও ফলে বিচিত্র এবং প্রচুর ফল ফলাদি। বিশেষ করে এখানকার আঙ্গুর বাগানগুলোর নাম ডাক কেবল ঐ অঞ্চলেই নয় বরং সমগ্র ইরানের মধ্যেই সুপরিচিত। পশ্চিম আজারবাইজানের আঙ্গুর বাগানগুলোতে অন্তত বিখ্যাত বিশ জাতের আঙ্গুর পাওয়া যায়। তার বেশিরভাগই মোটামুটি ইরানের অভ্যন্তরেই চলে যায়, তবে বাকি অংশটি যায় দেশের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে।  এসব আঙ্গুর কেবল আঙ্গুর হিসেবেই নয় বরং বিভিন্ন জাতের কিশমিশরূপেও বিদেশে রপ্তানী করা হয়ে থাকে। আবার একটা অংশ দেশের ভেতরেই নির্যাস তৈরি কিংবা কৌটাজাত করার কাজে ব্যবহৃত হয়।

এখানে যেহেতু বিশাল বিশাল প্রান্তরে কৃষিকাজ হয় এবং রয়েছে অসংখ্য চারণভূমি, সেহেতু এইসব কৃষিক্ষেত আর চারণভূমিতে লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। অসংখ্য চারণভূমির থাকার কারণে একদিকে যেমন এখানে পশুপালনের একটি সমৃদ্ধ ধারা তেমনি গড়ে উঠেছে মধু চাষেরও প্রচলন। এই প্রদেশের প্রায় সবকটি উপশহরেই মধু উৎপাদিত হয়। তারপরও বলতেই হয় যে, মধু চাষের কেন্দ্র হিসেবে নাকদে শহর এবং আশনাভিয়ার নামই সবার আগে উঠে আসবে। অবশ্য এখানকার মধুর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো সরাসরি পাহাড়ের গাছ গাছালিতে একান্ত প্রাকৃতিক উপায়েই এখানে মধু উৎপাদিত হয়, কোনোরকম কৃত্রিম ব্যবস্থার মাধ্যমে মধুর চাষ করা হয় না।

জনসংখ্যার দিক থেকে পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশটি বেশ সমৃদ্ধ অর্থাৎ জনবহুল। এ এলাকার বিরাট একটা জনসংখ্যা হলো যাযাবর শ্রেণী। ইরানের পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে যাগরোস পর্বতমালার কোল ঘেঁষে পশ্চিম আজারবাইজানের যে অঞ্চলটি রয়েছে সেখানে যাযাবর শ্রেণীর বিশাল একটি অংশের বসবাস বেশ প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্যণীয়। পশ্চিম আজারবাইজানের লোকজন বেশিরভাগই ইসলাম ধর্মের অনুসারী। অজারি তুর্কি এবং কুর্দিরাই এখানে বিভিন্ন গোত্রবদ্ধ হয়ে বসবাস করে আসছে। কুর্দিরা বাস করেন প্রদেশের দক্ষিণ এবং পশ্চিমের উঁচু অংশে আর অজারি তুর্কিরা বাস করে উরুমিয়ে হ্রদের আশপাশ জুড়ে বিরাজমান অঞ্চল ও প্রদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর প্রান্তে। উরুমিয়ে শহরটি হলো পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের সবচেয়ে বড়ো এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর। অনেক আগে থেকেই এই শহরে বিভিন্ন শ্রেণী, গোত্র, ভাষা, বর্ণ এবং ধর্মের লোকজন শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ এই শহরটি নিয়ে আরেকটু আলাপ করা বোধ হয় অসমীচীন হবে না।

পশ্চিম আজারবাইজানের কেন্দ্রিয় শহর উরুমিয়ের আয়তন দুই হাজার এক শ’ বর্গ কিলোমিটার। উরুমিয়ে হ্রদের তীর জুড়ে শহরটি বিস্তৃতি লাভ করেছে। ককেশাস, আর্মেনিয়া এবং এশিয়া মাইনরের দিকে যাবার পথে অবস্থানের কারণে এবং হ্রদের পাশে গড়ে ওঠার কারণে শহরটি গুরুত্ব এবং সৌন্দর্য সেই প্রাচীনকাল থেকেই ছিল এবং এখনো অম্লান রয়েছে। এখানে রয়েছে বেশ কটি প্রাচীন টীলা। অন্তত দুই হাজার বছর আগে থেকেই এই টীলাগুলো তাদের অস্তিত্বের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছে বলে ইতিহাসের বিচিত্র তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে। ইসলামের ইতিহাস লেখকদের অনেকের মতে জরথ্রুস্ট (নবী)র জন্মস্থান ছিল এই উরুমিয়ে। রোমান সম্রাটরা বহুবার জরথ্রুস্টদের অগ্নিমন্দির দখল করার জন্যে উরুমিয়ে অতিক্রম করেছিল বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/৪/টি-৪৬/অ-৪৬