সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৬ ১০:০৯ Asia/Dhaka

‘হজ ও মিনা ট্রাজেডি’ শীর্ষক ধারাবাহিকের গত পর্বে আমরা ২০১৫ সালের হজ মৌসুমে ঘটে যাওয়া দু’টি মর্মান্তিক ঘটনা অর্থাৎ মসজিদুল হারামে হাজিদের মাথার উপর ক্রেন ভেঙে পড়া এবং মিনার গণহত্যা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করেছি। সেই সঙ্গে মিনার বিয়োগান্তক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইরানি হাজি মোহাম্মাদের স্মৃতিচারণ জেনেছি। এ পর্বে মোহাম্মাদের বর্ণনায় গত বছরের হজের বাকি ঘটনাগুলো জানা যাক:

মোহাম্মাদ বলেন, “বিমানবন্দর থেকে বের হয়ে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)’র শহর মদীনায় প্রবেশ করলাম। সবার মন তখন পড়ে রয়েছে মসজিদে নববীর কাছে। অচিরেই আমরা পৌঁছে গেলাম রাসূলুল্লাহ (সা.)’র স্মৃতি বিজড়িত এই মসজিদে। আমাদের দলনেতা মসজিদের প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে এটির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস, এর গুরুত্ব এবং আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে এই পবিত্র স্থাপনার মাহাত্ম বর্ণনা করেন। কিন্তু আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে সৌদি পুলিশ এসে আমাদের জটলাকে ভেঙে দেয়। একদল হজযাত্রীর সমবেত হওয়া এবং তাদের দলনেতার পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়ায় কি এমন ক্ষতি হলো যে, পুলিশ আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে দিলে তা বুঝে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। এর পরবর্তী দিনগুলোতেও মদীনার অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থান জিয়ারতের সময়ও আমাদের সঙ্গে সৌদি পুলিশ একই ধরনের আচরণ করে। এখান থেকে আমরা বুঝতে পারি মদীনা শহরকে তারা সেনানিবাসের মতো কঠোর নিরাপত্তা এলাকায় পরিণত করে রেখেছে।

মসজিদে নববী

মসজিদে নববীর ভেতরেও পুলিশ হজযাত্রীদের শান্তিতে ইবাদত করতে দেয়নি। হজযাত্রীরা বহু বছরের প্রতীক্ষার পর মদীনায় এসেছেন রাসূলের রওজা মুবারক জিয়ারত এবং দোয়া-দরুদ পাঠ করার আশা নিয়ে। কিন্তু সৌদি পুলিশ নিরাপত্তা রক্ষার অজুহাতে দোয়া পড়ার কোনো সুযোগই আমাদেরকে দেয়নি। তারা আমাদেরকে রাসূলের পবিত্র রওজার কাছেই ঘেঁষতে দেয়নি। ফলে আমরা দূরে দাঁড়িয়ে বিশ্বনবীর রুহ মুবারকের প্রতি দরুদ ও সালাম জানিয়ে দোয়া ইস্তেগফার পাঠ করেছি।

সৌদি পুলিশের এই কড়াকড়ি আরো বেড়ে যায় ‘বাকী’ কবরস্থানে। ওই কবরস্থানে শুয়ে আছেন অনেক মহান ইসলামি ব্যক্তিত্ব। বিশ্বনবীর স্ত্রীগণ, তাঁর একাধিক সন্তান, তাঁর একজন চাচা এবং দুই চাচাতে ভাইসহ বহু সাহাবীর কবর রয়েছে বাকি কবরস্থানে। এ ছাড়া, এখানে শুয়ে আছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)’র চার পবিত্র বংশধর ও ইমাম। ১৯২৬ সালের আগ পর্যন্ত এসব কবরের উপর নির্মিত ছিল সুদৃশ্য মাজার। কিন্তু ওই বছর ওয়াহাবিরা তাদের নিজস্ব মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে সেই পবিত্র মাজারগুলোকে গুঁড়িয়ে দেয়।

সৌদি কর্তৃপক্ষের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী, শুধুমাত্র পুরুষ হজযাত্রীদের দিনের নির্ধারিত কিছু সময়ে বাকি কবরস্থানে যাওয়ার অনুমতি রয়েছে। সেখানে কোনো কবরের কাছে দাঁড়ানো বা দোয়া করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা শিয়া মুসলমানদের ইমামদের কবরের সামনে সবচেয়ে কঠোরভাবে বলবৎ রয়েছে। চার ইমামের কবরের সামনে মোতায়েন পুলিশ সেখানে রীতিমতো আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সৌদি আরবে ধর্মীয় স্বাধীনতা বলে কিছু নেই এবং আলে সৌদ সরকার মক্কা ও মদীনায় তাদের ওয়াহাবি চিন্তাধারার প্রচার ও প্রসারে ব্যস্ত।”

জান্নাতুল বাকী কবস্থান

ইরানি হাজি মোহাম্মাদ নিজের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আরো বলেন, “এভাবে মদীনায় কয়েকদিন অবস্থানের পর পবিত্র মক্কা নগরীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। মরু পথে কয়েক ঘন্টার ভ্রমণ শেষে আল্লাহর ঘর সমৃদ্ধ মক্কা নগরীতে পৌঁছে যাই। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এই শহরকে ‘নিরাপদ নগরী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আমরা হোটেলে পৌঁছেই সেখান থেকে মসজিদুল হারামে যাওয়ার প্রস্তুতি নেই। অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে মুসলমানদের পবিত্রতম মসজিদের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি। মসজিদুল হারামের প্রবেশপথের বিশালতা, পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিক মাহাত্ম আমাদেরকে মুগ্ধ করে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করার পর কাবাশরীফের চারপাশে নির্মিত সুউচ্চ ভবনগুলো দেখে আমাদের মধ্যে তীব্র বিরক্তি সৃষ্টি হয়। আল্লাহর ঘরে চারপাশে কী উদ্দেশ্যে এত উঁচু ভবন নির্মাণ করা হয়েছে তা আমাদের বোধগম্য নয়। অনেক ক্ষেত্রেই এসব স্থাপনা কাবাঘর তাওয়াফকারী হাজিদের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটায়।

মাকামে ইব্রাহিমের পেছনে ক্রেন ভেঙে পড়ার দৃশ্য

যাই হোক, আমরা আল্লাহর ঘর তাওয়াফ এবং নামাজ শেষে মসজিদুল হারাম থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু পায়ে হেঁটে কিছুদূর যেতে না যেতেই প্রচণ্ড ও বিকট শব্দে আমরা সবাই কেঁপে উঠি। এ শব্দ ভেসে আসে মসজিদুল হারামের ভেতর থেকে। কী হয়েছে তা দেখার জন্য সবাই শব্দের উৎসস্থলের দিকে দৌড়ে যাই। সেখানে গিয়ে এক মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখতে পাই। মসজিদুল হারামের আঙিনার আকাশে যেসব বিশাল ক্রেন বসানো ছিল তার একটি মাকামে ইব্রাহিমের ঠিক পেছনে ভেঙে পড়েছে। এর ফলে কাবাঘর জিয়ারতকারী বহু হাজি হতাহত হয়েছেন। যাদের মাথার উপর এটি ভেঙে পড়েছে তাদের অনেকের পুরো শরীর থেঁতলে গেছে। অনেকের হাত-পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমরা তখন হতাহতদের সাহায্যে এগিয়ে যাই। কিন্তু সৌদি পুলিশ আমাদেরকে সে অনুমতি দেয়নি। তারা দ্রুততার সঙ্গে মসজিদুল হারাম থেকে সব হাজিকে বের করে দেয়। কাউকে ছবি তোলার বা ভিডিও করার অনুমতি দেয়া হয়নি।

ওই রক্তাক্ত পরিবেশ দেখার পর কয়েকদিন ধরে মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। কোনো কাজেই মন বসছিল না। সৌদি সরকার এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ১০৭ এবং তাদের প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষ আহত হয় বলে ঘোষণা করে। সৌদি কর্তৃপক্ষ যথারীতি এ ঘটনায় তাদের দোষ অস্বীকার করে এবং প্রচণ্ড বাতাস ও ‘আল্লাহর ইচ্ছা’কে এ মর্মান্তিক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে।”

(মিনা বিপর্যয়ের অন্যতম ইরানি প্রত্যক্ষদর্শী মোহাম্মাদের স্মৃতিচারণ বাকি অংশ পরের পর্বে)  

ট্যাগ