হজ ও মিনা ট্র্যাজেডি-২
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়গুলো ঘটেছে মিনা অঞ্চলে।
এ অঞ্চলটি পবিত্র মক্কা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত। কখনও অগ্নিকাণ্ড ও কখনও ভিড়ের চাপে দেখা দিয়েছে মানবীয় বিপর্যয়। এসব ট্র্যাজেডিতে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার হাজি বা হজযাত্রী। সৌদি হজ-কর্তৃপক্ষ ও সরকারের উদাসীনতার কারণেই বার বার ঘটছে এসব বিপর্যয়।
মিনায় হাজিরা আসেন দশ জিলহজ তথা পবিত্র কুরবানির ঈদের দিন। এখানে তারা ১২ জিলহজ পর্যন্ত থাকেন এবং শয়তানের তিন প্রতীকী স্তম্ভে তিন দফায় পাথর নিক্ষেপ করেন। পশু কুরবানি দেয়ার পর তারা ফিরে আসেন মক্কায়। [এখানেই তথা মিনায় হযরত ইব্রাহিম (আ) মহান আল্লাহর নির্দেশে নিজ পুত্র ইসমাইল (আ)-কে কুরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। আর পথে শয়তান (মানুষের বেশ ধরে) একাজে ইব্রাহিম (আ)-কে বিরত রাখার জন্য কুমন্ত্রণা দেয়ার চেষ্টা করায় তিনি তার দিকে ছোটো ছোটো পাথর নিক্ষেপ করেছিলেন কয়েকবার।]
১৯৭৫ সালে মিনায় গ্যাসের ক্যাপসুল বিস্ফোরণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ২০০রও বেশি হাজি এবং আহত হন আরও কয়েক শত হাজি। এ ঘটনায় সৌদি ত্রাণ ও উদ্ধার-কর্মীরা ছিল নীরব দর্শক। মিনায় ১৯৯৫ সালেও অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ১০০ জন হতাহত হন। অর্থাৎ ২২ বছর পরও মিনার নিরাপত্তা-পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে ব্যর্থ হয় সৌদি কর্তৃপক্ষ।
সৌদি সরকার হাজিদের জান-মালের নিরাপত্তার প্রতি উদাসীন হলেও নানা প্রচারণার কাজে বিপুল অংকের অর্থ খরচ করে থাকে।
হজ পরিচালনায় সৌদি সরকারের ব্যর্থতার খতিয়ান অত্যন্ত দীর্ঘ। যেমন, ২০০৬ সালে মিনায় পদদলিত হওয়ার ঘটনায় নিহত হয় ৩৫০ জন হজযাত্রী। সে বছর হজ শুরুর আগের দিন মসজিদুল হারামের পাশে একটি ৮ তলা হোটেল ভবন ভেঙ্গে পড়ার ঘটনায় নিহত হয় ৭৩ জন। ২০০৪ সাল মিনায় হজের শেষ দিনে নিহত হয় ২৪৪ জন হজযাত্রী। ২০০১ সালে হজের শেষ দিনে মিনায় পদদলিত হয়ে নিহত ৩৫ জন হাজি। ১৯৯৮ সালে মিনার একটি ওভারপাস থেকে কয়েকজন হজযাত্রী পড়ে যাওয়ার ফলে সৃষ্ট আতঙ্কের ফলে পদদলিত হয়ে মারা যান ১৮০ জন হাজি। ১৯৯৭ সালে মিনার তাবুতে আগুন লাগার ঘটনায় নিহত হন ৩৪০ জন হজযাত্রী। আহত হন ১৫০০ জন। ১৯৯৪ সালে মিনায় পদদলিত হয়ে মারা যান প্রায় ২৭০ জন। ১৯৯০ সালে মক্কাগামী একটি সুড়ঙ্গ পথে পদদলিত হওয়ার ঘটনায় নিহত হন এক হাজার ৪২৬ জন হজযাত্রী।
১৯৮৭ সালে হজযাত্রীরা কাফির ও মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়ার ফরজ দায়িত্ব পালন করার সময় মার্কিন ও ইসরাইল-বিরোধী শ্লোগান দেয়ায় সৌদি সেনাদের গুলিতে প্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ হাজি শহীদ হন। শহীদদের বেশিরভাগই ছিলেন ইরানি নারী ও পুরুষ হজযাত্রী।
গত বছরের হজের সময় পবিত্র ঈদের দিন মিনায় ভিড়ের চাপে বিপুল সংখ্যক হাজি নিহত হন। নিহতের সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার ও নিখোঁজ ছিলেন প্রায় ১৬০০ জন। সৌদি নিরাপত্তা-কর্মীদের ভুল পদক্ষেপ বা উদাসীনতার ফলে সৃষ্ট এ ঘটনায়ও সৌদি উদ্ধারকর্মী ও নিরাপত্তা কর্মী চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে বলে বিশ্বের বহু দেশ থেকে তীব্র সমালোচনা উঠেছে।
উল্লেখ্য, এর অল্প কয়েকদিন আগে ১১ সেপ্টেম্বর মক্কার মসজিদুল হারামে ক্রেন ভেঙে পড়ার ঘটনায় বেশ কয়েকজন ইরানি হজযাত্রীসহ প্রায় ১১০ জন হজযাত্রী নিহত ও কয়েক শত হজযাত্রী আহত হন।
আর কেবল মিনার ঘটনায় নিহত হয়েছেন ইরানের প্রায় ৫০০ হাজি। তাই এটা স্পষ্ট যে সৌদি সরকারের একার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে হজ পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
পারস্য উপসাগরীয় বিষয়ক ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর আলী আল আহমাদ জানিয়েছেন, ১৯৮৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত প্রায় দশ হাজার হজযাত্রী সৌদি অব্যবস্থাপনার কারণে নিহত হয়েছেন। তাই বহুজাতিক হজ ব্যবস্থাপনা চালুর দাবি জোরদার করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। আলী আল আহমাদ আরও বলেছেন, পদদলিত হয়ে মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনাগুলোর আলোকে শান্তির নগরী মক্কা এখন সম্ভবত মানব-ইতিহাসে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক শহর।
মিশরের ওয়াকফ বা দান বিষয়ক মন্ত্রী শেইখ সালমান মুহাম্মাদ মিনার সর্বশেষ বিপর্যয়সহ সাম্প্রতিক কয়েক দশকে হজ পরিচালনায় নানা ভুলের কথা তুলে ধরে বলেছেন, হজ-প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় একটি বিপ্লব না আনা পর্যন্ত ভবিষ্যতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
আর কারা হজ করতে আসবে বা কারা হজ করতে পারবে না তাও সৌদি সরকারের একদেশদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তর মাধ্যমে নির্ধারণ করা ইসলাম-সম্মত নয় বলে ইসলাম বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যেমন, সৌদি সরকার গত বছর ইয়েমেনি ও সিরিয়দের হজ করতে দেয়নি। #