ইরান-চীন অংশীদারিত্বে নবযুগ: স্থলপথে সিল্ক রোডের পুনর্জাগরণ
পার্সটুডে: বিশ্বে চলমান দ্রুতগতির পরিবর্তনের যুগে সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে ইরান ও চীনের পারস্পরিক সহযোগিতা আরও গভীর হওয়ার দিকে এগিয়েছে। দুটি দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মাধ্যমে নতুন স্থলপথ ব্যবহার করে তাদের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক শক্তিশালী করতে এবং পশ্চিম এশিয়ায় তাদের সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে।
ইরানের ফার্স বার্তা সংস্থার বরাত দিয়ে পার্সটুডে জানিয়েছে, বৈশ্বিক পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ইরান-চীন সহযোগিতা ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া উন্নত হয়েছে। দুই দেশেরই প্রাচীন ইতিহাস ও সভ্যতা রয়েছে এবং তারা দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো সিল্ক রোডের মাধ্যমে সহযোগিতার ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যা নতুন শতকের জন্য পুনঃসংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজন রয়েছে।
ইরান ও চীন সাম্প্রতিক বছরগুলিতে জ্বালানি, অবকাঠামো, বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও যৌথ বিনিয়োগের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক শক্তিশালী করেছে।
আন্তর্জাতিক নীতির পরিবর্তন ও ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়ন, বিশেষ করে ট্রাম্পের শুল্ক নীতি, পশ্চিমের একপাক্ষিকতা এবং ইরান ও ইহুদিবাদী রাষ্ট্রের মধ্যে ১২ দিনের যুদ্ধের পর, এই সম্পর্ক সম্প্রসারণের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে।
সাধারণ স্বার্থ ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায়, ইরান ও চীনের মধ্যে সম্পর্ক পুনর্ব্যাখ্যার জন্য ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।
চীনের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিম এশিয়ায় পৌঁছাতে ইরানের পূর্বদিক (পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) ব্যবহার করে সংযোগ স্থাপন—এটি দুই দেশের অর্থনৈতিক ও ট্রানজিট সম্পর্কের অন্যতম মূল স্তম্ভ হয়ে উঠতে পারে।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হিসেবে চীন, পশ্চিম এশিয়ায় তার অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে এবং এই অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে চায়। এই লক্ষ্যে, ইরানের মাধ্যমে চীনের পশ্চিম এশিয়ার সাথে সংযোগের জন্য দুটি প্রধান পথ চিহ্নিত করা হয়েছে: প্রথমটি চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর (CPEC) এবং দ্বিতীয়টি আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডোর।
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (CPEC) প্রায় ৬০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগে গঠিত এবং এটি চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ' (BRI)-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। করিডোরটি পাকিস্তানের গোয়াদর ও করাচি বন্দর থেকে শুরু হয়ে চীনের পশ্চিমাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এটি চীনের জন্য পশ্চিম এশিয়ায় প্রবেশের সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করতে পারে।
পরিবহন ও ট্রানজিট বিশ্লেষকদের মতে, ইরানের চবাহার বন্দর, পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের প্রাকৃতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং এটি কার্যকর পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে পারে। চাবাহার থেকে সিপিইসি-তে সড়ক ও রেল সংযোগ স্থাপন পণ্য পরিবহনের সময় ও খরচ কমানোর পাশাপাশি চীনের সরবরাহ শৃঙ্খলের নিরাপত্তাও জোরদার করবে।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানের ওয়াখান করিডোরও চীনের পশ্চিম এশিয়ার সাথে সংযোগের আরেকটি কৌশলগত পথ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এর বিশেষ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, এই করিডোর চীনকে মধ্য এশিয়া ও পশ্চিম এশিয়ার বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেয় এবং সম্প্রতি আরও বেশি মনোযোগ পেয়েছে।
এই দুই করিডোর মালাক্কা প্রণালীর উপর নির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি, চীনকে ইরান, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান হয়ে পশ্চিম এশিয়া এমনকি ইউরোপ পর্যন্ত সংযোগ গড়ে তোলার সুযোগ দিচ্ছে।
উল্লেখ, চীনের প্রায় ৯০% সমুদ্রপথে বাণিজ্য মালাক্কা প্রণালীর ওপর নির্ভরশীল—যা মার্কিন প্রভাবাধীন—এ কারণে স্থলপথের বিকল্প একটি কৌশলগত নিরাপত্তা পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এছাড়া, এই করিডোরের আওতাধীন বিভিন্ন প্রকল্প—যেমন: খাফ-হেরাত রেললাইন, ইরান-পাকিস্তান-ভারত গ্যাস পাইপলাইন, গোয়াদর ও করাচি বন্দরের চীনা বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ, চাবাহারে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আফগানিস্তানের খনিজ খনির উন্নয়ন ইত্যাদি—চীনের সঙ্গে ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাগত সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক হতে পারে।
আজকের প্রতিযোগিতাপূর্ণ বিশ্বে, ইরান ও চীন কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গিতে এই ঐতিহাসিক সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দুইপক্ষের জন্যই লাভজনক ও অংশীদারিত্বমূলক একটি নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে—যা ২০০০ বছর আগেকার সিল্ক রোডের আধুনিক পুনর্জাগরণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।#
পার্সটুডে/এমএআর/১৯