সুরা ইউনুসের নানা আলোচ্যসুচিসহ এর প্রাথমিক পরিচিতি
সুরা ইউনুস পবিত্র কুরআনের দশম সুরা। মক্কায় অবতীর্ণ এ সুরায় রয়েছে ১০৯টি আয়াত ও ১১টি রুকু। এ সুরার প্রধান শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হল : সৃষ্টিজগত ও সৃষ্টিকর্তার মহত্ত্ব , কুরআনের সত্যতা, মানব জীবনের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে পরকালকে গুরুত্ব দেয়া, কাফির ও মুশরিকদের নানা সন্দেহের জবাব দেয়া এবং তাদেরকে সতর্ক করা ও বিশ্বনবী (সা.)’র জীবনের কয়েকটি ঘটনা।
এ ছাড়াও হযরত আলী (আ.)-এর বেলায়াত বা নেতৃত্ব, সূর্য-চন্দ্রের রাশি ও তিথি, বেহেশতের প্রশংসা, মানুষের দশা, কাফিরদের অভিনব দাবি ও তার জবাব, উপকার বা ক্ষতির সঙ্গে মূর্তির সম্পর্কহীনতা, আদিতে মানুষের একই জাতি হওয়া, মানুষের অসহায় অবস্থায় বিনম্র হওয়া এবং সুখের সময় দম্ভ করা- এসবও এই সুরার কয়েকটি আলোচ্য বিষয়। দুনিয়ার উপমা, দুনিয়ার স্থান, কিয়ামতে অপরাধীদের মুখ কালিমালিপ্ত হওয়া, আল্লাহ কারও ওপর জুলুম করেন না, দুনিয়ার অবস্থান ক্ষণিকের জন্য, কোন লোক নিজের লাভ-ক্ষতির মালিক নয়, দুনিয়ার সমগ্র সঞ্চয় গুনাহ'র বিনিময় হতে পারে না, কুরআন মনোরোগের আরোগ্য, আল্লাহর সর্বজ্ঞ হওয়া, আল্লাহর আউলিয়ার পরিচয়- এসব এই সুরার আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়।
এ ছাড়াও আল্লাহর কোন সন্তান না থাকা, প্রতিটি বিষয়ের অবশ্যই প্রমাণ থাকা, হযরত নূহ ও মূসা (আ.)-এর ঘটনা, মসজিদের বিশেষ মর্যাদা, ফিরআউন বাহিনী ও তার নিমজ্জিত হওয়া, ইউনুস (আ.)-এর সম্প্রদায়ের ঘটনা -এসবও সুরা ইউনুসের আলোচ্য বিষয়।
বিশ্বনবী (সা.)’র নবুওত লাভের প্রথম দিকে সুরা ইউনুস নাজিল হয়েছিল। এই সুরার ৯৮ নম্বর আয়াতে ইউনুস নামটি উল্লেখিত হয়েছে। পবিত্র কুরআনে মোট চার বার ইউনুস নামটি এসেছে।
এই সুরার প্রথম দুই আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেছেন:
' ১. মহান দাতা ও পরম করুণাময় আল্লাহর নামে (শুরু করছি), 'আলিফ-লাম-র', এগুলো হেকমতপূর্ণ কিতাবের আয়াত।
২. মানুষের কাছে কি আশ্চর্য লাগছে যে, আমি ওহী পাঠিয়েছি তাদেরই মধ্য থেকে একজনের কাছে যেন তিনি মানুষকে সতর্ক করেন এবং সুসংবাদ শুনিয়ে দেন ঈমনাদারগণকে যে, তাঁদের জন্য সত্য মর্যাদা ও সুনিশ্চিত পুরস্কার রয়েছে তাঁদের পালনকর্তার কাছে। কাফেররা বলতে লাগল, নিঃসন্দেহে এ লোক প্রকাশ্য যাদুকর।'
এখানে পবিত্র কুরআনকে মহান আল্লাহ হাকিম বা প্রজ্ঞাময় বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, কুরআনের বাক্যগুলো এতো শক্তিশালী ও চূড়ান্ত যে তা সব ধরনের ভুল, মিথ্যা ও কল্পনা এবং কুসংস্কার দূর করে দেয়। কুরআন সত্য ছাড়া অন্য কিছু বলে না এবং কেবলই মানুষকে সত্যের দিকে আহ্বান করে।
মক্কার মুশরিকরা প্রায়ই এটা বলতো যে, কেনো কুরআন কোনো ফেরেশতার কাছে নাজিল না হয়ে একজন মানুষের কাছে নাজিল হয়েছে? তারা বিষয়টিকে একটি ত্রুটিপূর্ণ বা দোষের বিষয় বলে উল্লেখ করতো। তাদের এই অদ্ভূত ধারণার জবাবে মহান আল্লাহ বলছেন, মানুষের কাছে কি আশ্চর্য লাগছে যে, আমি ওহী পাঠিয়েছি তাদেরই মধ্য থেকে একজনের কাছে.. ?
পথপ্রদর্শক ও নেতা এবং অনুসারীদেরকে একই জাতির হতে হয় যাতে নেতা তাদের সমস্যাগুলোকে বুঝতে পারেন ও তাদের চাহিদাগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে পারেন। যদি এমনটি না হয় তাহলে নেতৃত্ব দেয়াটা খুবই কঠিন হয়ে পড়বে। আয়াতের শেষাংশে বলা হয়েছে: কাফেররা বলে এই ব্যক্তি প্রকাশ্য জাদুকর। আসলে তারা মহানবী (সা.)’র মুখে কুরআনের অলৌকিক বক্তব্য ও আলোকিত বিধানগুলোসহ তাঁর নানা অলৌকিকতার মোকাবেলায় কোনো যৌক্তিক কথা বলতে পারছিল না। আর এ জন্যই তারা ওইসব মু’জেজা ও কুরআনকে জাদু বলে উল্লেখ করেছে।
সুরা ইউনুসের পঞ্চম ও ষষ্ঠ আয়াতে মানুষের মধ্যে খোদা- পরিচিতি'র ভিত্তি জোরদারের জন্য সৃষ্টি জগতের নানা ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর কৌশলী পরিকল্পনার দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে।
মহান আল্লাহ বলছেন: 'তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সুর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে এবং অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনযিলগুলো, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ এইসব কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেননি, তিনি যথার্থতা ও প্রজ্ঞাময়তার সাথে এসব সৃষ্টি করেছেন। তিনি প্রকাশ করেন (কুরআনসহ) নিজের নানা নিদর্শন সে সমস্ত লোকের জন্য যাদের জ্ঞান আছে।' (ইউনুস-৫)
সূর্যের আলো জীবন্ত প্রাণী ও উদ্ভিদের প্রবৃদ্ধির জন্য আলো ও তাপের উৎস। বায়ু-প্রবাহ ও নদ-নদীর স্রোতধারাও এই সূর্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। সূর্য যদি কখনও নিষ্প্রভ বা আলো আর তাপহীন হয়ে পড়ে তাহলে মৃত্যু ও নীরবতা গ্রাস করবে বিশ্বকে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোও অন্ধকার রাতে আমাদের প্রাকৃতিক প্রদীপ। সমুদ্র ও মরুভূমিতে পথ দেখায় প্রশান্তিদায়ক এ আলো।
চাঁদ ও সূর্যের রয়েছে নিজস্ব ও সুনির্দিষ্ট চলার পথ বা কক্ষপথ। এর মাধ্যমে মানুষ মাস ও বছরের হিসেবসহ অন্য অনেক হিসেব সংরক্ষণ করে এবং সম্পন্ন করে নানা কাজ।
মাসের প্রথম দিনে চাঁদ সবচেয়ে ক্ষীণ থাকে এবং এরপর থেকে প্রতিদিন এর আলো বাড়তে থাকে ও ১৫তম দিনে পূর্ণতম আকৃতি নিয়ে দেখা দেয়। এরপর চাঁদ আবারও ক্ষীণ হতে থাকে ও মাসের শেষে অমাবশ্যার রাতে পরিপূর্ণ আঁধারে ছেয়ে যায় বিশ্ব। এরপর আবার ওঠে নতুন চাঁদ। আবারও একই কক্ষপথে ফিরে যায় চাঁদ। নির্ভুল এই প্রক্রিয়াটি অর্থহীন কোনো প্রক্রিয়া নয়। এর মাধ্যমে মানুষ সময় ও দিনপঞ্জীর হিসাব রাখতে সক্ষম হয়। পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের ঘূর্ণন ও সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘূর্ণন চন্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার ভিত্তি। নির্ভরযোগ্য প্রাকৃতিক পঞ্জিকার মাধ্যমে মানুষ তাদের নানা কর্মকাণ্ড যথাসময়ে সম্পন্ন করতে পারে ও জীবনকে করতে পারে সুশৃঙ্ক্ষল।
সুরা ইউনুসের ৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: 'নিশ্চয়ই রাত-দিনের পরিবর্তনের মাঝে এবং যা কিছু তিনি সৃষ্টি করেছেন আসমান ও জমিনে, সবই হল নিদর্শন সেসব লোকের জন্য যারা ভয় করে।'
দিন ও রাতের আবর্তন খোদাভীরুদের বাস্তবতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা দেয় । কিন্তু উদাসীন মানুষেরা এইসব নিদর্শনকে লক্ষ্য করে না। ভেবে দেখার মতো বিষয় হলো, যদি সূর্য একাধারে আলো বিকিরণ করে যেতো তাহলে প্রচণ্ড উত্তাপের কারণে পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়তো। আবার একটানা অনেক সময় ধরে যদি রাত থাকতো তাহলে প্রবল ঠাণ্ডার কারণে সব কিছু বরফের মত শীতল হয়ে জমে যেতো। কিন্তু মহান আল্লাহ যথাসময়ে দিনের পর রাত ও আবার রাতের পর দিনের আবর্তণ ঘটিয়ে পৃথিবীকে জীবন যাপনের উপযোগী করেছেন।#