মার্চ ১৩, ২০১৭ ২১:৩৫ Asia/Dhaka
  • ধরণীর বেহেশত মসজিদ-১ (মসজিদুল হারাম)

মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর ঘর এবং এই মহান স্রষ্টার সামনে সেজদায় লুটিয়ে পড়ার স্থান। যুগে যুগে খোদা-প্রেমে ভক্তদের মিলনমেলা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে এই পবিত্র স্থান। একইসঙ্গে অনেক সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে এই মসজিদকে কেন্দ্র করে। এমনকি, এই মসজিদে বসেই নেয়া হয়েছে রাজনৈতিক ও সামরিক সব সিদ্ধান্ত। ইসলামি শিল্প, সংস্কৃতি ও সভ্যতার নিদর্শন হিসেবেও মসজিদ পালন করেছে এক অনন্য ভূমিকা।

মুসলিম বিশ্বে মসজিদের এই অপরিসীম গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা নতুন এই ধারাবাহিক নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। এ অনুষ্ঠানে আমরা মসজিদ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের আয়াত, রাসূলুল্লাহ (সা.)’র হাদিস এবং নিষ্পাপ ইমামদের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করব। সেইসঙ্গে এ অনুষ্ঠানে বিশ্বের কিছু বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মসজিদের সঙ্গেও পরিচিত হব আমরা।  

পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশেষ ঐশী ধর্ম ইসলাম মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের লক্ষ্যে মানুষের জন্য বিশেষ কিছু ইবাদতের ব্যবস্থা করেছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদপূর্ণ ইবাদত হচ্ছে নামাজ। আর 'মসজিদ' শব্দের উৎপত্তি হয়েছে সিজদা শব্দ থেকে। এই পবিত্র স্থানে মহান আল্লাহর সামনে তাঁর বান্দা সিজদায় অবনত হয় বলে এর নাম দেয়া হয়েছে মসজিদ। নামাজকে ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত বলে গণ্য করা হয় এবং সিজদা হচ্ছে নামাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে সিজদা করার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। সূরা নাহলের ৪৯ নম্বর আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে, “আল্লাহকে সেজদা করে যা কিছু নভোমন্ডলে আছে এবং যা কিছু ভুমন্ডলে আছে এবং ফেরেশতাগণ;তারা অহংকার করে না।” সিজদা হচ্ছে ইবাদতের সর্বোচ্চ পর্যায়। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় এমনকি নামাজেরই অন্যান্য অংশের তুলনায় সিজদার রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য ও মর্যাদা। ইসলামি সংস্কৃতিতে মসজিদ- বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর হিসেবেও বিবেচিত হয়।

মসজিদুল হারাম

আসমান-জমিনসহ বিশ্বজগতের সবকিছুর মালিক আল্লাহ তায়ালা। কিন্তু এর মাঝে একমাত্র মসজিদকেই তিনি নিজের ঘর বলে অভিহিত করেছেন। মানুষ যাতে এই পবিত্র স্থানের মর্যাদা যথাযথভাবে উপলব্ধি করে এবং এখানে সমবেত হয়ে ইবাদত-বন্দেগী করার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত হাসিল করতে পারে সেজন্যই এ নামকরণ করেছেন আল্লাহ তায়ালা। অবশ্য সব মসজিদের মর্যাদা আল্লাহর কাছে সমান নয় বরং কোনো কোনো মসজিদের গুরুত্ব তাঁর কাছে অন্যান্য মসজিদের তুলনায় বেশি। হাদিসে এসেছে, আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় মসজিদ হচ্ছে মক্কার মসজিদুল হারাম বা কাবাঘর। এরপর রয়েছে মদীনার মসজিদে নববী, কুফা মসজিদ ও আল-আকসা মসজিদের অবস্থান। এরপর আল্লাহ পছন্দ করেন প্রতিটি শহরের কেন্দ্রীয় বা মূল মসজিদ, তারপর পাড়া-মহল্লার মসজিদ এবং সবশেষে বাজারগুলোতে অবস্থিত মসজিদ। মসজিদুল হারামের মর্যাদা আল্লাহর কাছে এত বেশি যে, সারাবিশ্বের মুসলমানদেরকে এই কাবাঘরের দিকে মুখ করে নামাজ আদায় করতে হয়।

বিশ্বনবী (সা.) বলেছেন, ঘরে বসে নামাজ আদায়ের সওয়াব এক গুণ, এলাকার মসজিদে নামাজের সওয়াব ২৫ গুণ, শহরের প্রধান মসজিদে নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০০ গুণ, আল-আকসা মসজিদে নামাজের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ, আমার মসজিদে ( অর্থাৎ মসজিদে নববীতে) নামাজ আদায়ের সওয়াব ৫০ হাজার গুণ এবং মসজিদুল হারামে নামাজ পড়ার সওয়াব মহান আল্লাহ ১ লক্ষ গুণ বেশি দিয়ে থাকেন। ইমাম বাকের (আ.) পবিত্রতম এ মসজিদে নামাজ আদায়ের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, যদি কেউ মসজিদুল হারামে এক ওয়াক্ত ফরজ নামাজ আদায় করে তাহলে তার জীবনের আদায় করা অতীত ও ভবিষ্যতের সব ফরজ নামাজ আল্লাহর দরবারে নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে যায়।

হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, “জমিনে আমার ঘর অর্থাৎ মসজিদগুলো আসমানবাসীর কাছে সেইরকম জ্বলজ্বল করে ঠিক যেরকম আকাশের তারাগুলো জমিনবাসীর কাছে উজ্জ্বল মনে হয়। যারা মসজিদকে আপন করে নিয়েছে তারা সৌভাগ্যবান। সেই ব্যাক্তি ভাগ্যবান যে নিজের ঘরে ওজু করার পর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ লাভের জন্য আমার ঘরে আগমন করে। তোমরা জেনে রেখো, যারা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসে তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন আমার জন্য কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। যারা রাতের অন্ধকারে মসজিদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় তাদেরকে কিয়ামতের দিনের উজ্জ্বল আলোর সুসংবাদ দিন।”

মসজিদুল হারামের পরিচিতি

পাঠক, শুরুতে যেমনটি বলেছি,  প্রতিটি আসরে আমরা বিশ্বের কোনো না কোনো বিখ্যাত মসজিদের সঙ্গে পরিচিত হবো। আজ প্রথম পর্বে রয়েছে মসজিদুল হারামের পরিচিতি। মসজিদুল হারাম ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে পুরনো ও মর্যাদাসম্পন্ন মসজিদ। হাদিসে এসেছে, সৃষ্টির শুরুতে প্রবল বন্যার পানির নীচে গোটা পৃথিবী তলিয়ে গিয়েছিল। এরপর ভূপৃষ্ঠের যে স্থান সবার আগে পানির উপরে ভেসে উঠেছিল সেটি ছিল কাবা শরীফের এই স্থান। মহান আল্লাহ ভূপৃষ্ঠকে এখান থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে দিয়েছেন।

ইমাম বাকের (আ.) বলেছেন, মহান আল্লাহ যখন পৃথিবী সৃষ্টি করতে চাইলেন তখন বাতাসকে নির্দেশ দিলেন পানির উপরে প্রচণ্ড জোরে বয়ে যেতে যাতে তাতে ফেনা তৈরি হয়। এই ফেনাগুলোকে কাবার স্থানে এনে জড়ো করে তা দিয়ে একটি পাহাড় তৈরির আদেশ দেন।  এরপর এই পাহাড়ের নীচ থেকে ভূপৃষ্ঠকে চারিদিকে ছড়িয়ে দেন। সূরা আলে ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম ঘর যা মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে,সেটাই হচ্ছে এ ঘর,যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা জাহানের মানুষের জন্য বরকতময় ও হেদায়েতের উৎস।” কাজেই দেখা যাচ্ছে, পৃথিবীর বুকে প্রথম যে স্থাপনাটি তৈরি হয়েছিল সেটি ছিল কাবা শরীফ। ইমাম সাদেক (আ.) বলেন, “পৃথিবীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান হচ্ছে মক্কা। মহান আল্লাহর কাছে মক্কার মাটির চেয়ে প্রিয় মাটি, মক্কার পাথরের চেয়ে প্রিয় পাথর, মক্কার গাছের চেয়ে প্রিয় গাছ, মক্কার পাহাড়ের চেয়ে প্রিয় পাহাড় এবং মক্কার পানির চেয়ে প্রিয় পানি আর নেই।”

মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) এই পবিত্র ঘরকে উদ্দেশ করে আল্লাহর নামে শপথ করে বলেছেন, “আল্লাহর তৈরি শ্রেষ্ঠ জমিন তুমি, আল্লাহর কাছে প্রিয়তম ভূমিও তুমি। আল্লাহর শপথ! আমাকে যদি  মক্কা থেকে বের করে দেয়া না হতো তাহলে আমি কখনোই তোমাকে ছেড়ে যেতাম না।”  হাদিসে এসেছে, আদি পিতা হযরত আদম (আ.) প্রথম কাবা শরীফ নির্মাণ করেন। এরপর এটি নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজ পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)’র সহযোগিতায় এটি পুনর্নির্মাণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সা.)’র নবুওয়াত প্রাপ্তির আগে তাঁর উদ্যোগ ও দিক-নির্দেশনায় প্রাথমিক নকশার ভিত্তিতে কুরাইশ গোত্রের হাতে আবার কাবা শরীফ নির্মিত হয়। তখন থেকে এখন পর্যন্ত মসজিদুল হারাম বহুবার পুনর্নির্মাণ করার পাশাপাশি এর উন্নতি ও সমৃদ্ধির কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

বর্তমানে মসজিদটির আকার ও আয়তন বহুগুণ বেড়েছে এবং মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখনো বাড়ছে। যেসব কারণে এই মহান ঘরের পবিত্রতা ও মহত্ত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে সেগুলোর কয়েকটি হলো-  আল্লাহর নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল (আ.)’র হাতে এটির নির্মাণকাজ সম্পন্ন, কাবার মধ্যে হযরত আলী (আ.)’র জন্ম এবং কাবা সংলগ্ন ‘হিজরে ইসমাইল’-এ বিবি হাজেরা ও হযরত ইসমাইল (আ.)’র কবরের অবস্থান। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বর্তমানে এই পবিত্র স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনকারীরা সেখানে অসংলগ্নভাবে এত বেশি নতুন নতুন ভবন ও স্থাপনা তৈরি করেছেন যার ফলে মসজিদুল হারামের আধ্যাত্মিক পরিবেশ ও ইবাদতের স্থানে  বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে। কাবা শরীফের চারপাশের এলাকায় বর্তমানে তৈরি করা হয়েছে অনেক বড় বড় সুউচ্চ টাওয়ার এবং অসংখ্য সুইমিং পুল যা মসজিদুল হারাম এলাকাকে একটি পর্যটন ও বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। অথচ বিশ্বের যেখানেই এ ধরনের অতি প্রাচীন কোনো ধর্মীয় স্থাপনা রয়েছে সেখানে  বা তার আশপাশে ওই ভবনের চেয়ে উঁচু কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে দেয়া হয় না। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/১৩

ট্যাগ