মে ১৭, ২০১৭ ১৬:২৫ Asia/Dhaka

মদীনায় মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠার পর এটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিচার-আচার এবং ইসলাম শিক্ষার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এই মসজিদের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত বেলালকে আজান দেয়ার নির্দেশ দেন।

ইসলামের সোনালি যুগের সব শাসনামলে মসজিদে নববীর সাদামাটা গঠনকাঠামো ধরে রাখা হয়েছে। বিশ্বনবী (সা.)’র ওফাতের পর প্রথম খলিফার শাসনামলে এই মসজিদে কোনো ধরনের পরিবর্তন আনা হয়নি। দ্বিতীয় খলিফার আমলে শুধুমাত্র মসজিদের আয়তন এবং এর দরজার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। তৃতীয় খলিফার আমলে মসজিদের গঠনকাঠামোয় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এর পিলারগুলোতে টিনের পাত বসানো হয়। তবে উমাইয়ারা ক্ষমতায় আসার পর ইসলামি শাসনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয় যার প্রভাব মসজিদ নির্মাণের ওপরও পড়ে। মসজিদে নববীও এই পরিবর্তনের বাইরে থাকেনি।

মসজিদে নববীর গঠনকাঠামো ছিল অত্যন্ত সাদামাটা। এটির দেয়াল নির্মিত হয় পাথর ও রোদে পোড়ানো ইট দিয়ে। ছাদ দেয়া হয় খেজুর পাতা বিছিয়ে। মসজিদের মেঝেতে নুড়ি পাথর ও বালুর মিশ্রণ ছড়িয়ে দেয়া হয় যাতে ছাদ দিয়ে বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে পড়লে তা দ্রুত শুকিয়ে যায়। ইতিহাসে এসেছে, মসজিদে নববী তৈরির কিছুদিন পরই মসজিদের ভেতরে বৃষ্টির পানি পড়ে জমে গিয়েছিল। এ অবস্থায় সাহাবীরা নুড়ি পাথর ও বালু এনে মসজিদের মেঝেতে ছড়িয়ে দেন যার ফলে পানি শুকিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সা.) এটি দেখে বলেন, খুব ভালো কাজ হয়েছে। তখন থেকে বহুকাল পর্যন্ত মসজিদে নববীর মেঝেতে বালু ও নুড়ি পাথর বেছানো ছিল। অবশ্য বর্তমানে এই মসজিদের মেঝেতে রয়েছে বিশালাকৃতির দামী কার্পেট।

বাবে জিবরাইল বা জিবরাইলের দরজা

মসজিদটি নির্মাণের সময় এটিতে যাতায়াতের জন্য তিনটি দরজা রাখা হয়। অবশ্য পরে মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদুল হারামের দিকে কেবলা পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার পর মসজিদের পেছনের দিকের দরজাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। এর পরিবর্তে উত্তর দিকে আরেকটি দরজা খোলা হয়। মসজিদের পশ্চিম দিকে ছিল আরেকটি দরজা যার নাম ছিল বাবে আতিকা। আতিকা ছিলেন মক্কার এক নারী যিনি ইসলাম গ্রহণের পর হিজরত করে মদীনায় চলে এসেছিলেন। দরজাটি এই নারীর বসবাসের ঘরের দিকে মুখ করা ছিল বলে এর নাম দেয়া হয় বাবে আতিকা বা আতিকার দরজা। এই দরজাটি বাবে রহমত নামেও প্রসিদ্ধ। এই নামকরণ সম্পর্কে ইতিহাসে এসেছে- একবার এক ব্যক্তি মসজিদে নববীতে এসে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র কাছে বৃষ্টির জন্য দোয়া করার অনুরোধ জানান। আল্লাহর রাসূল দোয়া করলে টানা সাতদিন ধরে মদীনায় প্রবল বর্ষণ হয়। এ অবস্থায় বন্যার আশঙ্কায় লোকজন তাঁর কাছে এসে আবার বৃষ্টি বন্ধ করার জন্য দোয়া করার অনুরোধ জানায়। এবার বিশ্বনবী আবার দোয়া করলে বৃষ্টি থেমে যায়। বৃষ্টি যেহেতু আল্লাহর রহমত তাই এই দরজার নাম রাখা হয় বাবে রহমত বা রহমতের দরজা।

এই দরজা দিয়েই রাসূলুল্লাহ মসজিদে যাতায়ত করতেন বলে এটিকে বাবে নববীও বলা হয়। মসজিদের পূর্বদিকে রয়েছে আরেকটি দরজা যেটিকে বাবে জিবরাইল বা জিবরাইলের দরজা বলে অভিহিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে, বনু কুরাইজার যুদ্ধের সময় আল্লাহর রাসূল এই দরজার কাছে হযরত জিবরাইলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন বলে এর নাম দেয়া হয় বাবে জিবরাইল।

অবশ্য ধীরে ধীরে মসজিদে নববীর দরজার সংখ্যা বাড়তে থাকে। কারণ, অনেক সাহাবী মসজিদের আশপাশে বসবাসের জন্য ঘর নির্মাণ করেছিলেন। এসব ঘরের দু’টি দরজা থাকত। একটি ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য আরেকটি ঘর থেকে মসজিদে যাতায়াতের জন্য। এই অবস্থা তৃতীয় হিজরি পর্যন্ত চলতে থাকে। ওই বছর আল্লাহর রাসূল নির্দেশ দেন, হযরত আলী (আ.)’র ঘর ছাড়া অন্য সবার ঘরের সঙ্গে মসজিদের দরজাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। অবশ্য বর্তমানে এই মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে সাতটি প্রধান ফটক এবং ছোটবড় ৮১টি দরজা।

হযরত ফাতেমা জাহরা (সা.আ.)-এর গৃহের দরজা

মসজিদে নববীর একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের নাম রওজায়ে মুতাহ্‌হারা। হাদিসে এই অংশে উপস্থিত হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। বিশ্বনবী (সা.)  এই স্থানকে বেহেশতের বাগান বলে উল্লেখ করেছেন। রাসূলের পবিত্র কবর, তাঁর মিম্বর ও মেহরাব এই স্থানে অবস্থিত। যে স্থান থেকে এই মহামানবের পবিত্র ও নূরানি আত্মা আল্লাহর সাক্ষাতে চলে গেছে সেই স্থানেই তাঁর দেহ মোবারক দাফন করা হয়েছে। পরবর্তীতে প্রথম ও দ্বিতীয় খলিফাকে রাসূলুল্লাহর কবরের পাশে দাফন করা হয়। এগুলোর উত্তর পাশের একটি স্থানের নামকরণ করা হয়েছে নবীনন্দিনী হযরত ফাতেমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার কবরের নামে। যারা মনে করেন হযরত ফাতেমাকে তাঁর নিজ ঘরে দাফন করা হয়েছে তারা এই নামকরণ করেছেন। অবশ্য ইতিহাসে তাঁকে জান্নাতুল বাকিতে দাফন করার কথা বলা হয়েছে এবং সুন্নী মুসলমানরা এই বর্ণনাকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করেন। রাসূলুল্লাহর কবর যে বিশাল কক্ষে অবস্থিত তাতে রয়েছে চারটি মজবুত পিলার  এবং এর উপরে রয়েছে সবুজ রঙের একটি সুদৃশ্য গম্বুজ।

মসজিদে নববীর আরেকটি পবিত্র অংশ হচ্ছে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র মিম্বর। বর্ণনায় এসেছে, প্রথম দিকে আল্লাহর নবী একটি খেজুর গাছে হেলান দিয়ে খুতবা দিতেন। একদিন একজন সাহাবী খুতবা দেয়ার জন্য মিম্বর তৈরির প্রস্তাব দিয়ে বলেন, এটি নির্মিত হলে আল্লাহর রাসূল যেমন দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হবেন না তেমনি সমবেত সব মুসল্লি উনাকে দেখতে পাবেন। বিশ্বনবী (সা.) এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন। তৈরি হয় ইসলামের ইতিহাসের প্রথম মিম্বর। এটিতে দুই ধাপ সিঁড়ি এবং এরপর রাসূলের বসার স্থান তৈরি হয়। পরবর্তীতে একজন কাঠমিস্ত্রি ওই তিন ধাপের মিম্বরের  উপর আরো ছয় ধাপ সিঁড়ি নির্মাণ করেন। ফলে এটি নয় ধাপের মিম্বরে পরিণত হয়।

মেহরাব

আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনামলে এই মিম্বর কয়েকবার পুনর্নির্মাণ ও সম্পূর্ণ নতুনভাবে তৈরি হয়। ৬৫৪ হিজরিতে এক দুর্ঘটনায় মসজিদে নববীতে আগুন লেগে মিম্বরটি সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়ে যায়। ঐতিহাসিক দলিলে পাওয়া যায়, ওই পোড়া মিম্বরটির ভস্মীভূত ছাই বর্তমানে যে স্থানে মিম্বর আছে তার ঠিক নীচে দাফন করা হয়েছিল। বর্তমানে মসজিদে নববীতে যে মিম্বরটি আছে সেটি মর্মর পাথরের তৈরি এবং এর উপরের কারুকার্যগুলি স্বর্ণ দিয়ে করা হয়েছে। ১২ ধাপ সিঁড়ির এই মিম্বরটি ৯৯৯ হিজরিতে তৎকালীন ওসমানীয় সুলতান এ মসজিদকে উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন।

রাসূলুল্লাহ (সা.)’র জীবদ্দশায় মুসলমানরা মেহরাব নামক কোনো স্থানের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন না। পরবর্তীতে ওমর ইবনে আব্দুল আজিজের শাসনামলে রাসূলুল্লাহ (সা.)’র সিজদা দেয়ার স্থানে একটি মেহরাব নির্মিত হয়। বর্তমানে মসজিদে নববীসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মসজিদের সামনের দিকে ঠিক মাঝখানে ইমাম সাহেবের নামাজে দাঁড়ানোর জন্য যে স্থান নির্ধারিত রয়েছে সেটিকে মেহরাব বলা হয়। মেহরাবের ফজিলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি মসজিদে নামাজ আদায় করতে এসে মেহরাবের দিকে তাকান তিনি নিজের চোখে কাবা শরীফ দেখার সওয়াব লাভ করেন। মসজিদে নববীতে বর্তমানে মূল মেহরাবের পাশাপাশি আরো কয়েকটি ছোট মেহরাব রয়েছে। এগুলোর একটিকে ‘মেহরাবে তাহাজ্জুদ’ বলা হয়। হযরত ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরের পেছনে এই মেহরাবটি অবস্থিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো কোনো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে নফল ইবাদতে মশগুল হতেন।

মসজিদে নববী

মসজিদে নববীর আরেকটি মেহরাবের নাম মেহরাবে ফাতেমা (সা. আ)। এটি তখনকার সময়ে হযরত ফাতেমা সালামুল্লাহি আলাইহার ঘরে মধ্যে ছিল এবং এখানে দাঁড়িয়ে তিনি নামাজ আদায় করতেন। বর্তমানে এই মেহরাবটি রাসূলুল্লাহ (সা.)’র হুজরার মধ্যে পড়েছে। এ মসজিদের আরেকটি মেহরাবের নাম মেহরাবে ওসমানি। ওসমানীয় সুলতানদের নামে এটির নামকরণ করা হয়েছে। অবশ্য কেউ কেউ বলেন, তৃতীয় খলিফা ওসমান ইবনে আফফানের নামে এই নামকরণ হয়েছিল। রাসূলের মেহরাবের পেছনে অবস্থিত এই মেহরাবটি কিবলার দিকে মুখ করা। বর্তমানে মসজিদে নববীর ইমাম সাহেব এই মিহরাবে দাঁড়িয়ে জামাতের ইমামতি করেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/আশরাফুর রহমান/১৭

ট্যাগ