রংধনু আসর: গন্ডারের চামড়া
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই চিড়িয়াখানায়, টেলিভিশনের পর্দায় কিংবা বইয়ের পাতায় গন্ডার দেখেছো। একসময় বাংলাদেশের সুন্দরবনেও গন্ডার ছিল। কিন্তু সেখান থেকে এই প্রাণিটি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের কাছাকাছি সাঙ্গু নদীতে ১৮৬৭ সালের নভেম্বর কিংবা জানুয়ারি মাসে সর্বশেষ গন্ডার ধরা পড়েছিল।
গন্ডারের চামড়া মোটা বলে দিয়ে তা দিয়ে ঢাল বানানোর রেওয়াজ দুনিয়ার অনেক দেশেই ছিল। বাংলার বারো ভূঁইয়াদের অন্যতম রাজা প্রতাপাদিত্যের সৈন্যদের ঢালগুলোও তৈরি করা হতো গন্ডারের চামড়া দিয়ে। সুন্দরবনের গন্ডার বিলুপ্ত হওয়ার এটাও একটা অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন।
বন্ধুরা, গন্ডার কোথায় পাওয়া যায়, এই প্রাণির প্রকৃতি কেমন- এসব বিষয়ে কিছু জানা-অজানা তথ্য জানাবো আজকের অনুষ্ঠানে। তবে তার আগে গন্ডারের চামড়া নিয়ে একটি গল্প শোনাতে চাই। এছাড়া, থাকবে একটি গান ও এক নতুন বন্ধুর সাক্ষাৎকার। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটি তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান। তাহলে আর কথা না বাড়িয়ে প্রথমেই গল্পটি শোনা যাক:

অনেক অনেক দিন আগের কথা। লোহিত সাগরের মাঝখানে ছিল এক দ্বীপ। সেখানে বাস করত পারস্যের এক লোক। তার ছিল একটা ঝলমলে টুপি, একটা ছুরি আর একটা চুলা। একদিন লোকটা পিঠা বানাবে বলে ঠিক করল। আটা, পানি, আলুবোখারা, কিশমিশ, চিনি আরও নানা জিনিসপত্র নিয়ে সে শুরু করল রান্না।
পিঠাও কিন্তু যেনতেন পিঠা নয়, তিন ফুট পুরু আর দৈর্ঘ্যে প্রায় দুই ফুট! পিঠার উপাদান সব একসঙ্গে মিশিয়ে সে বসিয়ে দিল চুলায়। পিঠা বানানোর পর যখনই সে খেতে গেল, তখন ঘটে গেল এক বিপদ। কোথা থেকে যেন একটা গন্ডার এসে হাজির। গন্ডারটার চোখা শিং আর লোভাতুর চোখ।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন গন্ডারের চামড়া গায়ের সঙ্গে শক্ত হয়ে লেপ্টে থাকত। চামড়া ছিল মসৃণ, কোথাও কুঁচকানো ছিল না। তো গন্ডারটা করল কি, লোকটার সামনে এসে বলল, 'হাউ'!
গন্ডারের শব্দ শোনামাত্র লোকটা পিঠা ফেলে একটা তালগাছ বেয়ে তরতর করে উঠে গেল। সঙ্গে নিল শুধু তার ঝলমলে টুপিটা।
এদিকে গন্ডার তার নাক দিয়ে চুলায় দিল এক গুঁতা। সঙ্গে সঙ্গে পিঠা ধুপ করে পড়ল সৈকতের বালুতে। গন্ডারটা আরাম করে সেই পিঠা খেল। তারপর লেজ নাড়তে নাড়তে বিদায় নিল।
গন্ডার চলে যাওয়ার পর তালগাছ থেকে নেমে এল পারস্যের লোকটা। চুলাটা আবার দাঁড় করাল। তারপর আবৃত্তি করল একটা শ্লোক। শ্লোকটি এরকম-
পিঠা আমার খেয়ে ফেলে করল যে ভুল
দিতে হবে তাকে ঠিক কঠিন মাশুল।
এ ঘটনার পাঁচ সপ্তাহ পর লোহিত সাগরে এমন তাপপ্রবাহ শুরু হলো যে, সবাই গায়ের জামা খুলে রাখল। পারস্যের লোকটা তার টুপি খুলে ফেলল। আর গন্ডার তার চামড়ার জামাটা খুলে, কাঁধে ঝুলিয়ে, হেলেদুলে এগোল সমুদ্রের দিকে- গোসল করবে বলে।
আমরা যে সময়ের কথা বলছি, সে সময় গন্ডারের পেটের কাছে তিনটা বোতাম থাকত। তো গন্ডার করল কি, জামা খুলে সমুদ্রের পানিতে নেমে গেল। সাগরে ডুবে নাক দিয়ে বুদ্বুদ ওঠাতে লাগল।
ঠিক সেই সময়ে সমুদ্রের পাড়ে এল পারস্যের লোকটা। সৈকতে গন্ডারের জামাটা পড়ে থাকতে দেখে তার সে কী আনন্দ! খুশিতে দুই হাত কচলাতে কচলাতে সে গন্ডারের জামাটা ঘিরে তিন পাক নেচে নিল। এরপর সে ফিরে গেল তার ডেরায়। টুপির ভেতর ঠেসে ভরল পিঠা তৈরির উচ্ছিষ্টগুলো। ফিরে এল আবার সৈকতের কাছে।
তারপর গন্ডারের চামড়াটা ইচ্ছেমতো ঝাঁকালো, বাঁকালো এবং মোচড়ালো। পুরোনো, শুকনো পিঠা তৈরির উপকরণগুলো ভালোমতো চামড়ার ওপর দলাইমলাই করল। পোড়া আলুবোখারাগুলো খুব করে ডলে দিল। তারপর একটা তালগাছের ওপর বসে গন্ডারটার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
একটু পর গন্ডার সাগর থেকে উঠে তার চামড়ার জামাটা গায়ে চড়াল। তিনটা বোতাম লাগাতেই পিঠার গুড়ো তার গায়ে চেপে বসল। বেচারা শরীর চুলকানোর চেষ্টা করল, তাতে ফল হলো আরও খারাপ। সে তখন মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি খেল।
পিঠার উচ্ছিষ্ট তার গায়ে মেখে গেল। গড়াগড়ি করতে করতে তার সারা গা মাখামাখি, এমনকি বোতামগুলো কোন ফাঁকে ঢেকে গেল, সে টেরও পেল না। গন্ডারটা রেগে আগুন, কিন্তু তাতে তো আর কোনো লাভ নেই। রেগেমেগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে গন্ডারটা বাড়ি ফিরল। সেদিন থেকেই গন্ডার তার রাগী মেজাজ আর মোটা চামড়ার জন্য পরিচিতি পেল।

গন্ডার সম্পর্কে কিছু জানা-অজানা তথ্য
- গণ্ডার এক প্রকার স্তন্যপায়ী প্রাণী। এটি রাইনোসেরোটিডি (Rhinocerotidae) পরিবারের অন্তর্গত। এটি একটি শক্তিশালী প্রাণী। বদরাগীও বটে। এর নাকের ওপর একটা শিং থাকে। এই শিং আসলে পুরু লোমের তৈরি। গন্ডারকে ভীষণ ভয় পায় বনের আর সব প্রাণী। গন্ডারের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ কিন্তু ঘ্রাণশক্তি প্রখর।
- গন্ডার তার বিরাট শরীর নিয়ে চমৎকার সাঁতার কাটতে পারে। সে দাঁড়িয়ে কাত হয়ে বা হাঁটু মুড়ে উপুড় হয়ে ঘুমায়। গন্ডার ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৪০ মাইল বেগে ছুটতে পারে।
- এক সময় পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে গণ্ডারের বসবাস ছিল। তবে অধিকাংশ স্থান থেকে গণ্ডার বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীজুড়ে গণ্ডারের মাত্র পাঁচটি প্রজাতি পাওয়া যায়। এর তিনটি প্রজাতি রয়েছে ভারত, নেপাল ও মালয় অঞ্চলে, বাকি দুটি প্রজাতি রয়েছে আফ্রিকায়।
- আকৃতির দিক থেকে আফ্রিকার সাদা গন্ডারই বৃহত্তম। এদের ঘাড়ের উচ্চতা প্রায় ৫.৯ থেকে ৬.১ ফুট হয়ে থাকে। এদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১ থেকে ১৪ ফুট। ভারতীয় গন্ডারের ঘাড়ের উচ্চতা ৫.৫ থেকে ৬.১ ফুট হয়ে থাকে। ইন্দোনেশিয়ার জাভা অঞ্চলের গন্ডারের উচ্চতা ভারতীয় গন্ডার অপেক্ষা কিছুটা কম।
- গন্ডার তৃণভোজী। ঘাস ছাড়াও ছোটো ছোটো গাছের পাতাও আহার করে থাকে। বিশাল শরীরের কারণে গন্ডার প্রচুর পরিমাণ আহার করে থাকে। সে কারণে এরা তৃণসমৃদ্ধ অঞ্চলে বসবাস করে।
- গন্ডার অত্যন্ত বদরাগী ও একগুঁয়ে স্বভাবের হয়ে থাকে। এদের দৃষ্টি শক্তি অত্যন্ত কম থাকে। তবে এরা তীক্ষ্ম ঘ্রাণ ও শ্রবণশক্তির অধিকারী হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রজাতির গন্ডারের মধ্যে আফ্রিকান কালো গন্ডার অপেক্ষাকৃত অধিক ভয়ঙ্কর।
পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/২৮