ডিসেম্বর ১৯, ২০১৭ ১৪:৪৭ Asia/Dhaka

রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই জানো যে, শারীরিক সুস্থতার জন্য রোগ প্রতিরোধের পাশাপাশি সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন। আর সে জন্য সব যুগেই চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা ব্যাপক চেষ্টা ও গবেষণা চালিয়ে গেছেন। বর্তমানে বিশ্বে গুটিকয়েক রোগ ছাড়া প্রায় সব রোগেরই চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে।

চিকিৎসা শাস্ত্রের এ উন্নতির পথে যার অবদান সবচেয়ে বেশী তিনি হলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনা। তার পুরো নাম আবু আলী আল-হুসাইন ইবনে আব্দিল্লাহ ইবনে আল হাসান ইবনে আলী ইবনে সিনা। তিনি 'আল কানুন ফি আত-তিব' নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যারা চিকিৎসা শাস্ত্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পাঠ্যপুস্তক হিসেবে প্রায় পাঁচশ বছর গণ্য করা হতো। তিনিই প্রথম মানব চক্ষুর সঠিক এনাটমি করেন। যক্ষ্মা রোগ নিয়ে তিনি অভিমত দেন যে, যক্ষ্মা একটি ছোঁয়াচে রোগ।

ইবনে সিনার মৃত্যুর পর পশ্চিমা চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এ অভিমত প্রত্যাখ্যান করলেও পরে তা সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়। ইবনে সিনা এতই খ্যাতিমান চিকিৎসা বিজ্ঞানী ছিলেন যে, পশ্চিমা বিশ্বে তিনি ‘দ্য প্রিন্স অব ফিজিশিয়ানস’ নামে পরিচিত। আরবিতে ইবনে সিনাকে 'আশ-শায়খ আর-রাঈস' তথা 'জ্ঞানীকুল শিরোমণি' হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আর ইউরোপে তিনি 'আভিসিনা' নামে সমধিক পরিচিত।

বন্ধুরা, রংধনুর আজকের আসরে আমরা ইবনে সিনার সংগ্রামী জীবন, কঠোর অধ্যবসায় ও বিস্ময়কর সাফল্য এবং তার চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে একটি মজার গল্প শোনাব। আজ গল্প শেষে থাকবে একটি গান। আমাদের আজকের অনুষ্ঠানটিও তৈরি করেছেন আশরাফুর রহমান।

ইরানের হামেদানে অবস্থিত ইবনে সিনার সমাধি

ইবনে সিনা ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কুরআনের ৩০ পারা মুখস্ত করে ফেলেন। কুরআনের পাশাপাশি তিনি তিনজন গৃহ শিক্ষকের কাছে ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ্‌, তাফসীর, গণিত শাস্ত্র, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, জ্যামিতি প্রভৃতি বিষয়ে পড়াশুনা শুরু করেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি তখনকার দিনে প্রচলিত প্রায় সকল জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হন। এ সময় তিনি ‘হাকিম' অর্থাৎ বিজ্ঞানী বা প্রজ্ঞাবান উপাধিতে ভূষিত হন।

সকল বিষয়ে জ্ঞানার্জন করার পর ইবনে সিনার শিক্ষক বিখ্যাত দার্শনিক আল নাতেলী তাকে স্বাধীনভাবে গবেষণা করার পরামর্শ দেন। ইবনে সিনা তখন চিকিৎসা বিজ্ঞানে পারদর্শীতা অর্জনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চিকিৎসার মাধ্যমে দুঃস্থ মানবতার সেবা করার জন্য মনস্থির করেন। অল্পদিনের মধ্যেই একজন বিখ্যাত চিকিৎসক হিসেবে তার নাম সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় বোখারার বাদশাহ ছিলেন নূব বিন মানসুর। তিনি একবার কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। কোনো ডাক্তারই তার রোগ সারাতে পারছিল না। এসময় বাদশাহ ইবনে সিনাকে ডেকে পাঠালেন। ইবনে সিনা বাদশাহকে ভালোভাবে পরীক্ষা করে রোগ সম্পর্কে অবহিত হলেন। পরে মাত্র কয়েকদিনের চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ওঠলেন।

বাদশাহ ইবনে সিনার ওপর খুব খুশী হলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন-আপনি কি পেলে খুশী হবেন? ইবনে সিনা বললেন, আমি আপনার কাছে তেমন কিছুই চাই না। আপনার লাইব্রেরীর বইগুলো পড়ার সুযোগ দিলেই আমি বেশী খুশী হব। বাদশাহ তা-ই করলেন৷

ইবনে সিনা লাইব্রেরীতে পড়ার সুযোগ পেয়ে রীতিমত অধ্যয়ন শুরু করলেন এবং লাইব্রেরীর সব বই মুখস্থ করে ফেললেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, জ্যামিতি, ন্যায়শাস্ত্র, খোদাতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য ও সাহিত্য বিষয়ে অসামান্য পান্ডিত্য অর্জন করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি আল মুজমুয়া নামে একটি বিশ্ব কোষ রচনা করেন। এতে তিনি গণিত ছাড়া সব বিষয় লিপিবদ্ধ করেন।

ইবনে সিনার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে গজনীর সুলতান মাহমুদ তাকে তাঁর রাজসভায় আনতে চাইলেন। ইবনে সিনা ছিলেন অত্যন্ত আত্ম মর্যাদাবান একজন মানুষ। তিনি ভাবলেন, গজনীতে গেলে হয়তো স্বাধীনতাভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না-তাই তিনি খাওয়ারিজম ছেড়ে প্রথমে আবিওয়াদি, পরে তুস, নিশাপুর ও শেষে গুরগান যান। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে এক জায়গায় বেশী দিন থাকা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না। নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তিনি এরপর কাজভীন ও হামেদান শহরে যান। হামেদানে ইবনে সিনা তার বিখ্যাত গ্রন্থ আশ শিফা ও আল কানুন লেখায় হাত দেন। হামেদানের বাদশাহ শামস্‌-উদ-দৌলা সে সময় মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হন। ইবনে সিনা ৪০ দিন চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করে তোলেন। খুশী হয়ে বাদশাহ তাকে মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন।

ইবনের সিনার একটি বিখ্যাত গ্রন্থের নাম আল কানুন ফি আত-তিব। পাঁচটি বিশাল খণ্ডে বিভক্ত গ্রন্থটির পৃষ্ঠা সংখ্যা ছিল ৪ লাখেরও বেশী। সে যুগে এতবড় গ্রন্থ আর কেউই রচনা করতে পারেনি। বইটিতে ৭৬০টি জটিল রোগের কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়। ইউরোপের মেডিকেল কলেজগুলোতে এই গ্রন্থটি বহুকাল পাঠ্য ছিল। সম্ভবত এসব কারণেই পশ্চিমা পণ্ডিত ড. উইলিয়াম ওসলের ‘আল কানুন'কে ‘মেডিকেল বাইবেল' বলে ঘোষণা করেন।

চিকিৎসার তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক নিয়ম নীতিকে সহজে আত্মস্থ করার জন্যে ইবনে সিনা একটি কাব্যগ্রন্থও লেখেন। এই গ্রন্থটি 'উরজুযাতুন ফিত-তিব' নামে প্রসিদ্ধ। ইবনে সিনার কবিতা হিসেবে তাঁর এই বইটি খ্রিস্টিয় তের শতক থেকে সতের শতক পর্যন্ত বেশ কয়েকবার ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়। ইরানের বিশিষ্ট চিকিৎসাবিদ ও গবেষক ডক্টর বেলায়েতি ইবনে সিনার কবিতাকে কাব্যের আঙ্গিকে লেখা কানুন গ্রন্থেরই সারসংক্ষেপ বলে মন্তব্য করেছেন।

ইবনে সিনা চিকিৎসা বিষয়ে, পেটের বৃহদন্ত সম্পর্কে, হার্টের বিভিন্ন রোগব্যাধি সম্পর্কে এবং সেইসাথে অন্যান্য রোগ বহু বিষয়ে অনেক চিঠিপত্র, গবেষণামূলক প্রবন্ধও লিখে গেছেন। তাঁর সমসাময়িককালে তো বটেই, পরবর্তীকালেও সেইসব লেখা নিয়ে গবেষকগণ ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণার এই ধারা এখনো আগের মতোই অব্যাহত রয়েছে।

ইবনে সিনা একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ ছিলেন। তিনি নিজেকে জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও একনিষ্ঠ মুসলিম বলে দাবি করতেন। তিনি রীতিমত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। তিনি কোন বিষয় যখন বুঝতে পারতেন না তখন দু'রাকাত নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতেন। কান্নাকাটি করে বলতেন, "হে আল্লাহ! তুমি আমার জ্ঞানের দরজা খুলে দাও।" কান্নাকাটির পর তিনি যখন ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তেন তখন স্বপ্নের মধ্যে অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো তার মনের পর্দায় ভেসে উঠত। তার জ্ঞানের দরজা খুলে যেত। ঘুম থেকে ওঠে তিনি সমস্যার সমাধান করে ফেলতেন।

বন্ধুরা, ইবনে সিনার জীবন ও সাফল্য সম্পর্কে কিছু কথা শুনলে। এবার আমরা তার চিকিৎসা জীবনের একটি মজার ঘটনা শোনাব।

ইবনে সিনার আল কানুন গ্রন্থ

ইবনে সিনার আজব চিকিৎসা

একবার পারস্যের এক শাহজাদার আজব এক অসুখ দেখা দিল। শাহজাদা কিছুই খায় না। না খেয়ে খেয়ে তার শরীর একদম শুকিয়ে যেতে লাগল। সে শুধু্ চিতকার করে আর বলে,  ‘আমাকে জবাই কর, জবাই করে আমার গোশত দিয়ে কাবাব বানাও।'

শাহজাদা ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তার অসুখে তাই বাদশাহ ও বেগমের মন একদম ভেঙে পড়ল। তাদের দুঃখে আমীর-উমরাহর মুখও ভার হয়ে ওঠে। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ে শাহজাদার চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য। একে একে রাজ্যের সব হেকিম, কবিরাজ ডাকা হল শাহজাদার চিকিৎসার জন্য। কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

হবেই বা কেমন করে? শাহজাদাকে কোনো কিছুই খাওয়ানো যায় না। এমনকি কোনো ওষুধও সে খেতে চায় না। ছেলের অবস্থা দেখে বেগম সাহেবাও খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলেন। বাদশাহর মন আরো ভেঙে গেল।

দেশ-বিদেশের বড় বড় হেকিম-কবিরাজ মনে দুঃখ নিয়ে মাথা হেঁট করে চলে যেতে লাগলেন। কারণ যে রোগীকে ওষুধ খাওয়ানো যায় না, পথ্য খাওয়ানো যায় না- তার চিকিৎসা হবে কি করে? কোনো উপায় না দেখে বাদশাহ আর বেগম আল্লাহর দরবারে হাত তোলেন আর ছেলের জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করেন।

এ অবস্থায় একদিন একজন আমির বাদশাহকে বললেন, ‘জাঁহাপনা! আপনার উযীরে আযম ইবনে সিনা শুধু একজন বড় আলেম ও শাসকই নন, তিনি একজন বড় হেকিমও বটে। একবার যদি তাকে শাহজাদার চিকিৎসার জন্য ডাকা হয় তাহলে নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা হবে।'

এ কথা শুনে বাদশাহ উজিরকে ডাকলেন। সব ঘটনা শুনে ইবনে সিনা বললেন, শাহজাদাকে গিয়ে খবর দাও যে, একজন ভালো কসাই এসেছে। তাকে জবাই করে গোশত দিয়ে কাবাব বানানো হবে।

লোকজন গিয়ে যখন শাহজাদাকে এই খবর দিল, তখন সে খুশিতে আটখানা! তাড়াতাড়ি সে লোকদের সাথে এসে হাজির হলো উজিরে আজমের কাছে। 
উজির একটা বড় চকচকে ছুরি নিয়ে শাহজাদার আগমনের অপেক্ষা করছিলেন। শাহজাদা এসেই লাফিয়ে বলে উঠল, ‘এই যে কসাই! এসো এসো, আমাকে জবাই করে গোশত দিয়ে কাবাব বানাও।'

উজির তাঁর লোকদের হুকুম দিলেন, ‘এই গরুটা খুব ভালো করে বেঁধে মাটিতে শুইয়ে দাও, জবাইটা শেষ করে ফেলি।’

এ কথা শুনে শাহজাদা নিজেই শুইয়ে পড়ল। লোকেরা তার হাত ও মাথা চেপে ধরল। ছুরি হাতে নিয়ে উজির তার দিকে এগিয়ে গেল। উপস্থিত সবাই এই কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে গেল! কেউ কেউ ভয়ে কাঁপতে লাগল। সত্যিই কি শাহজাদাকে জবাই করে ফেলবেন উজিরে আযম!

ইবনে সিনা ‘বিসমিল্লাহে আল্লাহু আকবার' বলে ছুরি চালাতে গিয়ে সাথে সাথে থেমে গেলেন। চোখে-মুখে একটা ঘৃণার ভাব এনে বললেন, 'নাহ! গরুটা একদম শুকিয়ে গেছে। এর গোশত দিয়ে মোটেও কাবাব হবে না। একে জবাই করে কোনো লাভ নেই। আগে বেশি করে খাইয়ে-দাইয়ে একে মোটা-তাজা কর। তারপর নিয়ে এসো, জবাই করে দেব।'

উজিরের কথা শুনে দুঃখিত মনে শাহজাদা ওঠে দাঁড়ালো। মনে মনে ভাবল, ‘সত্যিই কি আমি এত শুকিয়ে গেছি যে, কসাইও আমাকে ঘৃণা করল? মোটা-তাজা হওয়ার জন্য এখন থেকে আমাকে তাহলে ভালো ভালো খাবার খেতে হবে।'

এই ফাঁকে উজির গোপনে লোকজনকে পরামর্শ দিলেন, ‘শাহজাদাকে পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে। আর তাতে মিশিয়ে দিতে হবে আমার দেওয়া কিছু ওষুধ।'

মোটা-তাজা হওয়ার লোভে শাহজাদা এবার খেতে শুরু করল। তাতে মিশিয়ে দেওয়া হলো ইবনে সিনার ব্যবস্থামত নানা পুষ্টিকর ওষুধ। অল্পদিনেই শাহজাদার চেহারা ফিরে এলো। শাহজাদা এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। সে আর বলে না, ‘আমাকে জবাই কর, আমার গোশত দিয়ে কাবাব বানাও।' 

ছেলেকে সুস্থ হতে দেখে বাদশাহ-বেগমের মুখে আবার হাসি দেখা দেয়। আমির-ওমরাহ আর প্রজাদের খুশি আর ধরে না। শাহজাদার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে সবাই আল্লাহর কাছে মুনাজাত করেন।#

পার্সটুডে/আশরাফুর রহমান/১৯

ট্যাগ