মার্চ ২৪, ২০১৬ ১৯:৩৫ Asia/Dhaka
  • 'ইরানিরা নওরোজকে নতুনভাবে গ্রহণ করেছে'

নওরোজ বিশ্বের প্রাচীনতম উৎসবগুলোর মধ্যে অন্যতম। জনপ্রিয় এ সংস্কৃতি ও উৎসব আজ শুধু ইরানের জাতীয় উৎসব নয়, আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, তুরস্ক ও ইরাকেও এ উৎসব জাতীয় পর্যায়ে পালিত হয়। এ উৎসব কম-বেশি পালিত হচ্ছে জর্জিয়া, পাকিস্তান ও ভারতেও। সাধারণত ২০ বা একুশে মার্চ ফার্সি নববর্ষ শুরু হয়। বসন্ত ঋতু শুরু হওয়ার সাথে সাথে শুরু হয় এ নববর্ষ।

নওরোজ উৎসবের নানা দিক নিয়ে আমরা কথা বলেছি রেডিও তেহরানের বাংলা বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও বিশিষ্ট লেখক মুহাম্মদ ফরিদউদ্দিন খান।

রেডিও তেহরান : জনাব মুহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন খান, আপনি দীর্ঘদিন ইরানে ছিলেন। ইরানি জনগণের সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে আপনি ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত। নওরোজ হচ্ছে- ইরানিদের প্রধান সামাজিক উতসব। তো প্রথমেই আপনি বলুন, এ উতসবকে আপনি কেমন দেখেছেন?

ফরিদ উদ্দিন খান : দেখুন! আমার জীবনের প্রায় ১৯ বছরের মত সময় ইরানে কাটিয়েছি। ফলে এতগুলো ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজ ইরানিদের মাঝে থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। নওরোজ সম্পর্কে অনেক স্মৃতি আছে আমার। তার সব হয়ত বলা সম্ভব নয়। তবে একটি কবিতার ভেতর দিয়ে নওরোজের বিষয়টিকে আমি তুলে ধরতে চাই। আর ফার্সি কবিতাটির বাংলা রূপ এ রকম- 'যেদিন সত্য বিজয়ী হবে সেদিনই আমাদের নওরোজ'।

আসলে শাহের আমলে আমরা নওরোজকে যেভাবে দেখেছি তার অনেক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে ইসলামী বিপ্লবের পর। কারণ শাহের আমলে নওরোজে নানা ধরনের কুসংস্কার ও বেলেল্লাপনা থাকত। কিন্তু হযরত ইমাম খোমেনী (রহ.)’র নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সাধিত হওয়ার পর আমরা দেখেছি ইসলামী বিপ্লবের আলোকে ইরানীরা নওরোজকে নতুনভাবে গ্রহণ করেছে। নওরোজকে বিপ্লবপন্থীরা ধর্মান্ধদের মত বাদ দেননি। বরঞ্চ নওরোজ মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনে, মানুষকে নতুনভাবে সাজায়, বছরের হিসাব-নিকাশ করা, সুন্দরভাবে নিজেকে আবার গড়ে তোলার প্রত্যয় সেই শিক্ষা দেয়। নওরোজে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে, আহলে বাইতের ঈমামগণ যে দোয়া শিখিয়েছেন সেই দোয়ার মাধ্যমে নওরোজ পালন- এটি একটি আধ্যাত্মিক পরিবর্তন। কুরআনকে সামনে নিয়ে, প্রকৃতির নানাকিছু সামনে নিয়ে নতুন উদ্যমে ইরানের প্রতিটি পরিবারের মধ্যে নববর্ষ পালনের যে সংস্কৃতি এবং সাধনা- এটি একইসঙ্গে বাহ্যিক নানা পরিবর্তনের মত মনোবিপ্লবও ঘটায়। তাছাড়া আধ্যাত্মিকভাবে প্রতিটি মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার বিরাট প্রত্যয় আমরা লক্ষ্য করেছি নওরোজে। ইরানের যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছেন- বিশেষ করে সর্বোচ্চ নেতা 'রাহবার' প্রতিবছরই নববর্ষ বা নওরোজের শুরুতে যে বাণী দিয়ে থাকেন তা গোটা ইরানি জাতির জন্য অত্যন্ত প্রেরণাদায়ক। বলা যায় সামনের বছরটাকে কিভাবে পরিচালনা করবেন- 'রাহবারের' বাণী থেকে তারা সে ব্যাপারে মনোবল লাভ করেন।

 রেডিও তেহরান : ফার্সি নববর্ষের সঙ্গে বাংলা নববর্ষের পার্থক্য এবং সামঞ্জস্য আছে?

ফরিদ উদ্দিন খান : জ্বি ফার্সি নববর্ষ ও বাংলা নবর্ষের মধ্যে কিছু পার্থক্য ও সামঞ্জস্য আছে। সময়ের দিক থেকে ইরানে নওরোজ বা নববর্ষ, বসন্ত শুরু হয় শীতের পরপরই। কিন্তু আমাদের এখানে শুরু হয় আরেকটু আগে। আমাদের বাংলা নববর্ষ শুরু হয় গরমের মধ্যেই। তাছাড়া ইরানিদের বছর গণনাটা আসলে শুরু হয় হিজরি শামসি বা সৌর বছরের হিসেবে। তারা জিরো পয়েন্ট থেকে বছর গণনা শুরু করেছে। আমাদের বাংলা সন গণনা শুরু হয়েছে মোঘল আমল থেকে। আর তখন থেকেই সূচনা লগ্ন ধরেই চন্দ্র বছর ও সৌরবছর গণনা করা হয়। সেদিক থেকে ইরানি এবং বাংলা নববর্ষের মধ্যে কিছুটা তফাত রয়েছে। আর নববর্ষের রেওয়াজ রীতির মধ্যে তো কিছু স্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এখানে নওরোজ উদযাপনের বিষয়টি খানিকটা আমি আগে তো বলেছি। তবে ইরানের মতো আমাদের দেশেও নববর্ষের সময় সুফী সাধকদের মাধ্যমে তাহজিব-তমদ্দুন সংস্কৃতি ছিল। তাছাড়া কয়েকশ’ বছর ধরে আমাদের এখানে ফার্সি ভাষার যে প্রচলন ছিল জনগণের মাঝে এবং সরকারি মহলে- তারও একটা প্রভাব রয়েছে আমাদের নববর্ষের মধ্যে। নওরোজকে বা নববর্ষকে গ্রহণ করার সেই দিকটা ইরানের ধারাবাহিকতায় আমাদের এখানে নববর্ষ শুরু হয়। তবে এ কথাও বলব ইরানে যেভাবে নওরোজ পালিত হয় আমাদের দেশে এখনও আমরা সেভাবে নববর্ষকে  মূল্যায়ন করতে পারি না। আমাদের চিন্তাশীল ব্যক্তিরা বা ধর্মীয় নেতারা এ ব্যাপারে এখনও মনোযোগী হননি।

রেডিও তেহরান : আচ্ছা ফার্সি নববর্ষের এমন কোনো দিক কি আছে যেটি বাংলা নববর্ষ বা সংস্কৃতিতে গেলে সেটি সমৃদ্ধ হতে পারে?

ফরিদ উদ্দিন খান :  ফার্সি নববর্ষ বা নওরোজে কুরআনকে সামনে রেখে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং দোয়ার মাধ্যমে ইরানি যে নববর্ষ শুরু হয়, সেটা অত্যন্ত ভালো  দিক। তাছাড়া নববর্ষের লগ্ন কখন শুরু হবে সে ব্যাপারে একটা বিশেষ হিসাব-নিকাশ দেখা যায় ইরানে, তবে আমাদের দেশে নববর্ষের ক্ষেত্রে কিন্তু এসব বিষয়ে সচেতনতা নেই। যদিও বাংলাদেশে হিন্দু বা বৌদ্ধদের পঞ্জিকায় এ ধরনের একটা হিসাব আছে। কিন্তু আমরা মুসলমানরা ওই ধরনের গাণিতিক নিয়মে করি না। যদি আমরা ইরানের মত নববর্ষে আল্লাহপাককে হাজির-নাজির জেনে তাঁর সামনে নিজেদেরকে উপস্থিত করে কুরআন তেলাওয়াত ও দোয়ার মাধ্যমে নতুন বছরকে গ্রহণ করতে পারি তাহলে ইরানের মত নববর্ষের সুফলগুলো আমরাও পেতে পারি এবং সেটি আমাদের সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করবে।   

রেডিও তেহরান : আপনি জানেন যে, ফার্সি নওরোজ শুধু ইরানে নয় প্রতিবেশি আরো কয়েকটি দেশে এটি উদযাপিত হয়। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।

ফরিদ উদ্দিন খান : আসলে আগে যে গ্রেটার পার্সিয়া বা বৃহত্তর ইরান ছিল, যেটা ছিল ফার্সি প্রভাবিত এলাকা এছাড়াও উপমহাদেশের আফগানিস্তান,পাকিস্তান ওদিকে তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান এই সব এলাকা পড়ে। তাছাড়া আরো ফার্সি প্রভাবিত অঞ্চল হিসেবে আজারবাইজান, জর্জিয়া, কুর্দিস্তান, তুরস্ক ও ইরাকের কথা বলা যায়। এই বিশাল অঞ্চলেজুড়ে ইরানি নববর্ষের প্রভাব জোরালোভাবে ছিল, এখনও আছে এবং এসব অঞ্চলে নওরোজ উতসব পালিত হয়ে থাকে। যদিও এখন স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব ঘটেছে, রাজনৈতিকভাবে অনেক বিভাজন হয়েছে, স্বাধীন মানচিত্র হয়েছে-তারপরও সেই মন ও মনন রয়ে গেছে। হাজার হাজার বছর ধরে এসব অঞ্চলে নওরোজ পালনের ইতিহাস ছিল এবং এখনও আছে।


রেডিও তেহরান : আপনি জানেন যে, নওরোজকে ইরানের জনগণ ব্যাপক উতসাহ-উদ্দিপনার সঙ্গে পালন করে। বাস্তবতা হচ্ছে-ইরানে এটিই সবচেয়ে বড় উতসব। তো এর সামাজিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্বটা কোথায়?

ফরিদ উদ্দিন খান :  এর সামাজিক গুরুত্ব অনেক বেশি। নওরোজ বা নববর্ষের সময়  মানুষে মানুষে প্রেমের মেলবন্ধন তৈরি হয়। ইসলামে আত্মীয়তার ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব ও তাগিদ দেয়া হয়েছে। এই নওরোজের সময় এই চর্চাটা খুব বেশি হয়। আমি ইরানে এই বিষয়টা খুব বেশি দেখেছি। এই চর্চা বাংলাদেশেও আছে। সেখানে বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যোগাযোগ ও গিফট আদান-প্রদানের বিষয়টিও দেখা যায়। তবে ইরানে সেটা খুব জোরালোভাবে দেখা যায় এবং এ ব্যাপারে খুব তাগিদ দেয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে নওরোজ ব্যাপক প্রভাব ফেলে। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না এসব শেয়ার করার একটা সুযোগ ঘটে এই সময়ে। নওরোজের সময় ইরানে দেখা যায় পুরাতন যা কিছু আছে সেগুলোকে সংস্কার করে অথবা পুরনো জিনিস ফেলে দিয়ে নতুন জিনিস কেনা হয় প্রায় প্রতিটি পরিবারে অর্থাত নতুনকে গ্রহণ করার একটা সংস্কৃতি এই নওরোজের একটি বড় দিক। তবে এই নতুনকে গ্রহণ করার বিষয়টি কেবলমাত্র সামাজিক নয় এটি অর্থনৈতিক  ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও ঘটে থাকে।

রেডিও তেহরান : জনাব ফরিদউদ্দিন খান, সবশেষে এবারের ফার্সি নববর্ষ উপলক্ষে ইরানি জনগণের পাশাপাশি রেডিও তেহরানের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন।

ফরিদ উদ্দিন খান : আমি ফার্সি নববর্ষ নওরোজ ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে রেডিও তেহরানের সকল শ্রোতা ভাই-বোনদেরকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। সবার মঙ্গল কামনা করছি এবং সারা বিশ্বে যে অন্যায়, অশান্তি, অত্যাচার, অনিয়ম চলছে সেগুলো থেকে যেন আমরা মুক্তি পাই সেই তওফিক আল্লাহ পাকের কাছে কামনা করি। সবাই সুখে ও শান্তিতে থাকবে সেই আশা করি। সমাজে নানা অবিচার রয়েছে সেগুলো যেন দূর হয়, সন্ত্রাস, যুদ্ধের মত বিষয় শয়তানি শক্তিগুলো চালিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে- সেগুলোর যেন অবসান ঘটে সেই কামনাও করি। আল্লাহ পাক যেন আমাদের সবাইকে সঠিক পথে চালান এবং আমাদের জন্য যেন সঠিক নেতৃত্ব দান করেন এই কামনা করি সবার জন্য। #

ট্যাগ