অক্টোবর ১৩, ২০১৮ ১৮:১৫ Asia/Dhaka

ঐশী দিশারীর গত কয়েক পর্বে আমরা নবী-নন্দিনী হযরত ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার মূল্যবান জীবনীর উল্লেখযোগ্য কিছু দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। আজকের আসরে আমরা এই মহীয়সী নারীর জীবনী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করব।

বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) হযরত জাহরাকে নিজের প্রাণের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। আল্লাহর রাসূল যখনই কোনো সফরে যেতেন তখন সবশেষে হযরত জাহরার কাছ থেকে বিদায় নিতেন এবং সফর শেষে সবার আগে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন। হযরত ফাতিমা নিছক সন্তান হওয়ার কারণে রাসূলের কাছে এতটা মর্যাদা লাভ করেননি বরং ঈমান ও আমলের দিক দিয়ে তিনি আল্লাহর দরবারে অনেক উঁচু মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। এ ছাড়া, আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আহলে বাইত বা নবী পরিবারের সদস্যদের ভালোবাসতে তাঁর উম্মতকে নির্দেশ দিয়েছেন। সূরা শুরার ২৩ নম্বর আয়াতের একাংশে বলা হয়েছে: “বলুন,আমি আমার (রিসালাতের) দাওয়াতের পরিবর্তে তোমাদের কাছে আত্মীয়স্বজনের (নিকটজনদের) প্রতি সৌহার্দ ছাড়া আর কিছু চাই না।”

আল্লাহ তায়ালা এই আয়াতে দেয়া নির্দেশের উদ্দেশ্য পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াতে ব্যাখ্যা করেছেন। সেখানে তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে উদ্দেশ করে বলেছেন: আপনি বলুন আমি (আমার রিসালাতের বিনিময়ে) তোমাদেরকে আল্লাহর রাস্তায় পরিচালিত করা ছাড়া তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাই না।” অর্থাৎ এই দুই আয়াতকে পাশাপাশি রাখলে যে বিষয়টি বোঝা গেল তা হচ্ছে, রাসূলুল্লাহর আহলে বাইতের প্রতি ভালোবাসার অর্থ আল্লাহর রাস্তায় অটল থাকা।  এ কারণে একদিন আল্লাহর রাসূল হযরত ফাতিমার হাত ধরে বলেন: ফাতিমা আমার কলিজার টুকরা। যে কেউ তাকে কষ্ট দেবে সে যেন আমাকে কষ্ট দিল এবং যে আমাকে কষ্ট দিল সে যেন আল্লাহকেই কষ্ট দিল। রাসূলুল্লাহ (সা.) আরেকদিন হযরত জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহাকে উদ্দেশ করে বলেন: হে ফাতিমা, তোমার খুশিতে আল্লাহ খুশি এবং তোমার ক্রোধে আল্লাহ ক্ষুব্ধ হন।

আল্লাহর রাসূলের জীবনের আরেকটি ঘটনায় প্রমাণ হয় আহলে বাইতের প্রতি এই মহামানবের ভালোবাসা নিছক আবেগতাড়িত ছিল না বরং এর মধ্যে নিহিত ছিল মুসলমানদের বিশ্বাসগত ভিত্তি। একবার নাজরানের খ্রিস্টান পণ্ডিতদের সঙ্গে বিশ্বনবী সংলাপে বসেন। তিনি তাদের সব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার পরও তারা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে মুবাহেলার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের পক্ষ থেকে এবং আমি আমার পক্ষ থেকে আমাদের সন্তান ও নারীদের পাশাপাশি যাদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি তাদের সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আবার একত্রিত হব। এরপর পরস্পরের প্রতি অভিশাপ দেব এবং আল্লাহর কাছে চাইব তিনি যেন আমাদের মধ্যে যে পক্ষ মিথ্যাবাদী তার ওপর গজব নাজিল করেন। পরবর্তীতে মুবাহেলার দিন দেখা গেল আল্লাহর রাসূল তাঁর সন্তানদের মধ্য থেকে হাসান ও হোসেনকে, নারীদের মধ্য থেকে হযরত ফাতিমাকে এবং পুরুষদের মধ্য থেকে হযরত আলীকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। খ্রিস্টান পণ্ডিতরা এ দৃশ্য থেকে মুবাহেলায় অংশ না নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল থেকে সরে পড়ে।

এ ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, আহলে বাইতের প্রতি বিশেষ করে হযরত ফাতিমা জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার প্রতি আল্লাহর রাসূলের ভালোবাসার ভিত্তি ছিল আল্লাহর নির্দেশ। 

গাদিরে খোমে রাসূলুল্লাহ (সা.) হযরত আলী (আ.)কে ইমামত ও খেলাফতের দায়িত্ব দেয়ার পর স্বামীর প্রতি হযরত জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহার বিশেষ দায়িত্ব অনুভূতি সৃষ্টি হয়। তখন থেকে আলী (আ.)কে শুধু স্বামী হিসেবে নয় বরং ইমাম ও নেতা হিসেবে ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তাঁর আনুগত্য করেন। হযরত জাহরা যেসব আলামত দেখতে পান তাতে নিজের দূরদর্শী ভাবনার মাধ্যমে এই আশঙ্কা করতে থাকেন যে, সব মুসলমান গাদিরে খোমে হযরত আলীর হাতে বায়াত করার পরও আল্লাহর রাসূলের মৃত্যুর পর তারা চুক্তি ভঙ্গ করতে পারে। তাঁর এ আশঙ্কা সত্যি হতে বেশিদিন সময় লাগেনি। বিদায় হজ ও গাদির থেকে ফেরার কিছুদিনের মধ্যে আল্লাহর রাসূল অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে অনন্তকালের পথে পাড়ি জমান।

আল্লাহর রাসূলের রেহলাতের সঙ্গে সঙ্গে হযরত আলী (আ.), সালমান ফারসি, মিকদাদ ও আবু যরের মতো মুষ্টিমেয় কয়েকজন সাহাবী ছাড়া বাকি সবাই রাসূলের দেহ মুবারক ফেলে রেখে মুসলিম সমাজের জন্য খলিফা নির্বাচনে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তারা গাদিরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে ঘোষিত নির্দেশের কথা বেমালুম ভুল যান।

এই দৃশ্য সহ্য করা হযরত ফাতিমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থতা সত্ত্বেও দ্বীনে ইসলামের এতবড় একটি নির্দেশ পালিত হচ্ছে না দেখে মুসলিম সমাজকে তার দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্য বনি হাশিম গোত্রের নারীদের সঙ্গে নিয়ে তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন। তাঁর সামনে পর্দা টানিয়ে দেয়া হয়। অশ্রুসজল চোখে তিনি বক্তৃতা দিতে থাকেন। হযরত জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহা বলেন: আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)কে রিসালাতের গুরুদায়িত্ব দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। সে সময় মানুষ আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল।

মানুষ আল্লাহকে বাদ দিয়ে মূর্তিপূজায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু রাসূলের বরকতময় উপস্থিতিতে সে অন্ধকার কেটে গিয়ে আলো ফুটে ওঠে এবং মানুষ আল্লাহকে চিনতে পারে। এরপর আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয় হাবিবকে নিজের কাছে নিয়ে যান।

একটু থেমে হযরত জাহরা বলতে থাকেন: হে লোকসকল! রাসূলুল্লাহর নিজ হাতে আপনারা দ্বীনি শিক্ষা অর্জন করেছেন এবং আল্লাহর নির্দেশ ও বিধিনিষেধ সম্পর্কে আপনাদের স্পষ্ট ধারণা আছে। আপনারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন। বিশ্বনবীর নিযুক্ত প্রকৃত খলিফা হচ্ছেন আলী। আল্লাহ আপনাদের কাছ থেকে তার আনুগত্যের শপথ নিয়েছেন। আলীর আনুগত্য মানুষকে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত পিতার প্রতি গভীর আকর্ষণ এবং আহলে বাইতের প্রতি অবিচারের জের ধরে হযরত জাহরা সালামুল্লাহি আলাইহা মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং জমাদিউস সানির তিন তারিখ অথবা মতান্তরে রবিউস সানি মাসের ১৩ তারিখ ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমান। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর মৃত্যুর পর মাত্র ৭৫ বা ৯৫ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বনবীর রেহলাতের পর তাঁর আহলে বাইতের প্রতি এতটা কঠোর আচরণ করা হয় যে, হযরত ফাতিমা সালামুল্লাহি আলাইহা স্বামী আলী (আ.)কে অসিয়ত করে যান:স্বামী আমার! আমার মৃত্যুর পর আপনি রাতের অন্ধকারে আমাকে দাফন করবেন। আমি চাই না আমার প্রতি যারা অত্যাচার করেছে তারা আমার জানাযায় অংশগ্রহণ করুক।

২০ বছরেরও কম বয়সে ধরাধম ত্যাগ করলেও এত অল্প বয়সেই তিনি নিজেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শস্থানীয় করে রেখে গেছেন। তিনি ছিলেন একজন মমতাময়ী মা ও বিশ্বস্ত স্ত্রী। সাধাসিধে জীবনযাপন এবং একাগ্রচিত্তের ইবাদতে তাঁর জুড়ি ছিল না। চরম বিপদে হযরত জাহরার ধৈর্য ছিল অনুকরণীয়। সার্বিকভাবে আল্লাহ তায়ালা অনন্তকাল ধরে তাকে মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/১৩

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ