মে ২৩, ২০১৯ ২০:২৮ Asia/Dhaka

ইরানে যদি আক্রমণ করে সেটি হবে আমেরিকার জন্য অশনি সংকেত। ইরানে হামলা চালালে চরম মূল দিতে হবে আমেরিকা ও ইউরোপকে। এরপর পৃথিবীতে আমেরিকার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন কবি অধ্যাপক আবদুল হাই শিকদার।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের এই প্রান্ত থেকে আমরা বলতে পারি, ইরান ইস্যুতে বর্তমান সংকটের জন্মদাতা আমেরিকা আর  জন্মদাত্রী ইসরাইল এবং এরসঙ্গে যুক্ত রয়েছে উপসাগরীয় কিছু দেশ। অতএব সংকটে সমস্যায় পৃথিবীর সমস্ত শান্তিকামী মানুষ ইরানের পাশে আছে।

আবদুল হাই শিকদার আরও বলেন, আমেরিকার অভ্যন্তরে ক্যালিফোর্ণিয়াসহ কয়েকটি স্টেট অলরেডি স্বাধীনতার জন্য কথা বলা শুরু করেছে। আমেরিকা নিজের ভেতর থেকেই ভাঙতে শুরু করেছে।

তারা বিশ্বব্যাপী তাদের মাস্তানি জারি রাখতে চায়। তাদের উদ্দেশ্যে মুসলিম বিশ্বকে একেবারে পঙ্গু করে দেয়া। তবে তাদের এই  উদ্দেশ্য সফল হবে না।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ, উপস্থাপনা ও তৈরি করেছেন গাজী আবদুর রশীদ

রেডিও তেহরান:  জনাব আবদুল হাই শিকদার, আবারো মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি তেঁতে উঠেছে এবং এবারো যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছে আমেরিকা। মার্কিন স্বার্থের জন্য ইরান মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে- এমন অভিযোগ তুলে পারস্য উপসাগরে যুদ্ধাজাহাজ পাঠিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। সামগ্রিক পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

আবদুল হাই শিকদার: দেখুন, ইরান কোনোসময় আক্রমণাত্মক ভূমিকায় যায় নি। আমেরিকা- ইসরাইলসহ উপসাগরীয় দেশগুলো ইরানের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ তুলে দেশটিকে আক্রান্ত করার চেষ্টা করছে। আর এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ ইরান যা করছে সেটি তাদের আত্মরক্ষামূলক অবস্থান। ইরান নিজের সীমার বাইরে গিয়ে কখনও কোনো দেশে আক্রমণ করেছে এমন কোনো অতীত নজরও নেই। ইরান ইসলাম এবং ইসলামি বিশ্বের একটি অবিসংবাদিত কন্ঠস্বর। ইরান যেহেতু মুসলিম বিশ্বের স্বার্থের প্রশ্নে কখনও আপোশ করে না-এটাই হচ্ছে ইরানের অপরাধ। ইরান–ইসরাইলকে সমর্থন করে না। আমেরিকার শয়তানিকে সমর্থন করে না। এটাই ইরানের অপরাধ। অতএব নানান ছুতায় ইরানকে কোণঠাসা করে, ইরানকে বিধ্বস্ত করে দেশটিকে ধ্বংস করে তাদের বিরুদ্ধে স্বার্থের ঝাণ্ডা উড়াতে চাচ্ছে আমেরিকা, ইসরাইলসহ উপসাগরীয় দেশগুলো। সারা বিশ্বের যারা মুক্তিকামী মানবতার সমর্থক, যারা গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থায় বিশ্বাস করে, যারা এখনও মনে করে ন্যায়-নীতি সবকিছুর উর্ধ্বে তারা কোনোমতেই আমেরিকা ও ইসরাইলের এ চক্রান্তের সাথে একমত হতে পারে না।

বাংলাদেশের এই প্রান্ত থেকে বলতে পারি, ইরান ইস্যুতে বর্তমান সংকটের জন্মদাতা আমেরিকা আর  জন্মদাত্রী ইসরাইল এবং এরসঙ্গে যুক্ত রয়েছে উপসাগরীয় কিছু দেশ। অতএব সংকটে সমস্যায় পৃথিবীর সমস্ত শান্তিকামী মানুষ ইরানের পাশে আছে।

রেডিও তেহরান:  সম্ভাব্য যেকোনো আগ্রাসনের মুখে ইরান রুখে দাঁড়াবে বলে ঘোষণা করেছে এবং ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অ্যারোস্পেস ডিভিশনের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ বলেছেন, আমেরিকা কোনো রকমের ভুল পদক্ষেপ নিলে তাদের মাথায় আঘাত করা হবে। ইরানের এই প্রতিক্রিয়াকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

আবদুল হাই শিকদার: আমি মনে করি ইরানের এই প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ সঠিক এবং যথার্থ। কারণ আপনি গায়ে পড়ে আমার ওপর আক্রমণ করবেন, বোম্বিং করবেন, আমাকে নাস্তানাবুদ করার চেষ্টা করবেন আর আমার অপরাধ শান্তিকামী। তাহলে কি আমার আত্মরক্ষা করার অধিকার থাকবে না। যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর অ্যারোস্পেস ডিভিশনের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আমির আলী হাজিজাদেহ ওই বক্তব্য দিয়েছেন সেটা সম্পূর্ণ সঠিক বলে আমি মনে করি।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আবদুল হাই শিকদার,  বর্তমানে ইরান ও আমেরিকার মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে তার মূলে রয়েছে মার্কিন সরকারের যুদ্ধংদেহী মনোভাব ও পরমাণু সমঝোতা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা। এর জবাবে ইরানও গত ৮ মে বলেছে, পরমাণু সমঝোতার কিছু প্রতিশ্রুতি তারা এখন আর বাস্তবায়ন করবে না। ইরানের এ সিদ্ধান্ত কতটা ন্যায্য?

আবদুল হাই শিকদার: এ বিষয়েও আমি ইরানের সিদ্ধান্ত ও অবস্থানকে সমর্থন করি। আমি কোনো অন্ধ সমর্থক নই। ন্যায়-নীতির বিচারে ইরান যে কাজটি করছে সেটি সঠিক। কারণ পরমাণু ইস্যুতে সমঝোতা হয়েছিল সবগুলো পরাশক্তি একসাথে এক টেবিলে বসে। কি এমন কারণ ঘটল যে সেই সমঝোতা থেকে আমেরিকা একতরফাভাবে বেরিয়ে গেল। তারা এ ব্যাপারে কোনো কারণ দর্শায় নি। শুধুতাই নয় সমঝোতা থেকে কোনো কারণ ছাড়াই বেরিয়ে গিয়ে আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যত রকম যড়যন্ত্র করা যায় তা করছে। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয় সেটি হচ্ছে, আমেরিকার যারা পরিক্ষীত বন্ধু –বৃটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি- তারা কেউ কিন্তু এ ব্যাপারে আমেরিকাকে সমর্থন করছে না। তারা ইরানকে সমর্থন করছে সেটাও আমি বলব না

তবে তারা আমেরিকার অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে চাচ্ছে না। কারণ তারা মনে করে ইরাক ও আফগানিস্তানকে তারা যেভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে- ইরানের ক্ষেত্রে সেই কাজটি সহজ হবে না।

ইরানে যদি আমেরিকা আক্রমণ করে সেটি হবে আমেরিকার জন্য অশনি সংকেত। কারণ এরপর পৃথিবীতে আমেরিকার কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। কারণ আপনারা দেখুন, সোভিয়েত ইউনিয়ন ৭০ বছরের বেশি সময় কমিউনিজমের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। তারপর একটা সময় আসলো যখন তাসের ঘরের মতো খসে পড়ল। আমেরিকাও তার যুদ্ধংদেহি অবস্থা প্রকাশ করছে শুধুমাত্র টিকে থাকার জন্য। এটিই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার শেষ প্রয়াস।

দেখুন, আমেরিকার অভ্যন্তরে ক্যালিফোর্ণিয়াসহ কয়েকটি স্টেট অলরেডি স্বাধীনতার জন্য কথা বলা শুরু করেছে। আমেরিকা নিজের ভেতর থেকেই ভাঙতে শুরু করেছে। দেউলিয়া হয়ে গেছে। কাজেই ইরানের অবস্থান, বক্তব্য অত্যন্ত সঠিক। অন্যদিকে আমেরিকার অস্ত্রব্যবসায়ীদের অস্ত্র বিক্রি করতে হবে। বিশ্বব্যাপী তাদের মাস্তানি জারি রাখতে হবে। তাদের উদ্দেশ্যে মুসলিম বিশ্বকে একেবারে পঙ্গু করে দেয়া। আর মুসলিম বিশ্বের দেশ বলতে মাত্র কয়েকটি দেশ আছে। ইরান, মালেয়েশিয়া, তুরুস্ক এরকম হাতে গোণা কয়েকটি দেশ বলা চলে মুসলিম বিশ্বের বুকে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি সব দেশকে তো সাম্রাজ্যবাদ শুইয়ে দিয়েছে। ফলে আমি মনে করি যে ইরান যা বলছে এবং যা করছে তা সম্পূর্ণ সমর্থনযোগ্য এবং সঠিক।

রেডিও তেহরান:  পরমাণু সমঝোতা থেকে আমেরিকা বেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপের তিন প্রধান শক্তি ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি বলেছিল তারা পরমাণু সমঝোতার প্রতি অনুগত থাকবে এবং ইরানের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। কিন্তু গত এক বছরে সে রকম কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা  যায় নি;  যাও বা নিয়েছে তাতে গড়িমসি করেছে ইউরোপের দেশগুলো। ইউরোপীয়দের এই ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আবদুল হাই শিকদার: দেখুন, ইউরোপীয় দেশগুলো হচ্ছে রসুনের মতো। একটি মূল থেকে নানা শাখা প্রশায় বিভক্ত। তবে মূলটা এক জায়গায়। ইউরোপীয় দেশগুলোও তো সাম্রাজ্যবাদী। তারাও সারা বিশ্বে মুসলিম নিধনের ইন্ধনদাতা। তবে এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে অভিন্ন আমেরিকার পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছে না। ইরানকে তারা সমর্থনও করছে না। তারা ইরানের সাথে তালবাহনা করে কালক্ষেপণ করছে একথাটাও ঠিক। কিন্তু আমেরিকার সাথে একেবারে নগ্নভাবে এখন কিন্তু তারা নেই। আর এটাই ইরানের বড় জয়। ফলে আমি মনে করি ইরান এক্ষেত্রে বিজয় লাভ করেছে। এখন ইরানের কাজ হবে বিশ্বব্যাপী শান্তিকামী সংগঠন, শান্তিকামী নেতা ও শান্তিকামী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক করা। ইরানের স্ট্যান্ডকে তুলে ধরা সবার কাছে। সবার কাছে তুলে ধরা যে আমরা আসলে কী চেয়েছি। আমরা তো পরমাণু সমঝোতা থেকে সরে যাই নি। আমেরিকা একতরফাভাবে পরমাণু সমঝোতা থেকে সরে গেছে। আবার ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউরোপীয় দেশগুলোর যে ভূমিকা সেটাও সামনে আনতে হবে।

রেডিও তেহরান: মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশের সঙ্গে মার্কিন সরকারের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হলেও বিপরীত অবস্থা দেখা যায় ইরানের ক্ষেত্রে। এ বিষয়ে ইরান সবসময় বলে আসছে ইসলামি বিপ্লবকে ধ্বংস করতে চায় আমেরিকা। আপনারও কী তাই মনে হয়?

আবদুল হাই শিকদার: অবশ্যই, আমিও সেটাই মনে করি। উপসাগরীয় কৃতদাস দেশগুলো আমেরিকা ও ইউরোপকে আল্লাহর ওপর স্থান দিয়েছে। এইসব দোযখের কীটগুলো আগাগোড়া আমেরিকার পারপাজ সার্ভ করার কাজ করছে। আপনারা নিশ্চয়ই কাতার সংকটের সময়ে দেখেছেন বিষয়টি। কি দোষ ছিল কাতারের! কাতারকে শিক্ষা দিতে হবে। সেসময় যদি ইরান ও তুরস্কের মতো দেশ কাতারের পাশে না দাঁড়াত তাহলে তারা কাতারকে ধ্বংস করে ফেলত। অতএব আমি মনে করি উপসাগরীয় দেশগুলো কি বলছে কি করছে সেটা এখন আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ এরা অলরেডি ধিকৃত এবং ঘৃণিত হয়ে চিহ্নিত হয়েছে। এখন পাশ্চাত্যের মিডিয়াও ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। আর মিডিয়াকে মিডিয়া দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। আজকের দিনে মিডিয়া যুদ্ধটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি মনে করি ইরান এ ক্ষেত্রে আরও সক্রিয় হলে উপসাগরীয় দেশগুলোর ভণ্ডামী স্পষ্ট করা যেত সবার কাছে।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আবদুল হাই শিকদার, সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, আমেরিকার সাথে যুদ্ধ হবে না। তিনি আরও বলেছেন আমেরিকা যুদ্ধ করতে চাইলে তাদের লাভ হবে না।  পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্টের আলোচনার প্রস্তাবকে নাকচ করে দিয়ে বলেছেন-আমেরিকার সাথে আলোচনার অর্থ হবে বিষপান করা। তো ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

আবদুল হাই শিকদার: ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সর্বোচ্চ নেতার এ বক্তব্যকেও আমি সমর্থন করি। আমি আবারও বলছি- এর অর্থ এই নয় আমি একজন অন্ধ সমর্থক। এখানে ঘটনাটি হচ্ছে- ইরান কি সত্যিই যুদ্ধ চায়? না, ইরান তো যুদ্ধ চায় না।অন্যদিকে আমেরিকা হুমকী ধমকি দিচ্ছে ইরানের ওপর। তারা বলছে এটা করব সেটা করব , ইরানকে দেখে নেব ইত্যাদি। তবে এটি যুদ্ধের পর্যায়ে নাও যেতে পারে। তার কারণ হচ্ছে ইরাক ও আফগানিস্তানে হামলা চালানো যত সহজ ইরানে হামলা চালিয়ে দেশটিকে কাবু করা অত সহজ না। ইরানে হামলা চালালে চরম মূল দিতে হবে আমেরিকা ও ইউরোপকে। হয়তো সে কারণেই ইরানের সর্বোচ্চ নেতা ওইসব কথা বলেছেন। তবে আমি একথা মনে করি না যে আমেরিকা শূন্য আস্ফালন করছে। তারা হয়ত তাদের বাস্তবতার জায়গা থেকে আস্ফালন করছে। তবে যেই আস্ফালন করুক না কেন আমি মনে করি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ীর বক্তব্য খুবই সময়োপযোগী এবং যুক্তিসঙ্গত।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৩

 

ট্যাগ