সেপ্টেম্বর ২৬, ২০১৯ ১৭:৪৬ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা গিয়েছিলাম কেরমানশাহ প্রদেশের সঙ্গে লাগোয়া আরেকটি প্রদেশ হামেদানে। হামেদান প্রদেশে রয়েছে ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক নানা নিদর্শন।

বিশেষ করে এখানকার আলিসাদর গূহার প্রাকৃতিক বিস্ময়ের সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হয়েছি আমরা। বলেছিলাম যে ১৯৯৪ খৃস্টাব্দে ফ্রান্সের স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক বিস্ময়কর এই আলীসাদ্‌র গুহার উপর গবেষণা চালিয়ে বলেছেন,এটি বিশ্বের অন্যান্য গুহার তুলনায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী এবং নিশ্চিতভাবে এই গুহাটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ পানিগুহা। প্রকৃতপক্ষে, আলোর ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হওয়ায় কিংবা আধুনিক যুগে বিদ্যুৎ আবিষ্কার হওয়ার পর এ গুহার গভীরতা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। বিদ্যুৎ আবিষ্কারের আগে মানুষ জানতেই পারেনি এ গুহা এত দীর্ঘ হবে। ১৯৯১ সালে আলিসাদ্‌র ট্যুরিজম কোম্পানি পুরো এলাকার উন্নয়নকাজ শুরু করে। গুহা মুখের বাইরে হোটেল, অতিথিশালা, কাঠনির্মিত ভিলা এবং তাঁবু গাড়ার মতো প্রশস্ত জায়গা অহরহ এবং সহজলভ্য। এছাড়াও আছে বিনোদনের জন্যে সিনেমা-থিয়েটার ও খেলারমাঠ। খাওয়া-দাওয়ার জন্যে আছে রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা। সবমিলিয়ে আলীসাদ্‌র গুহা মনোরম একটি অবকাশ যাপন কেন্দ্র হিসেবেও বিখ্যাত। এ ধরনের গুহা পৃথিবীতে খুবই বিরল। আমেরিকায় এ রকম একটি গুহা আছে কিন্তু তার নীচে পানি নেই। আরেকটি আছে ইন্দোনেশিয়ায়। তবে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পানিগুহা হিসেবে এই আলীসাদ্‌রের খ্যাতি আজও অম্লান।

আলিসাদর গূহা নিয়ে ব্যাপক কৌতূহল এখনো সবার মাঝে আছে। গূহার ভেতরে প্রায় চৌদ্দ কিলোমিটার আবিষ্কৃত হয়েছে। যদিও মাত্র চার কিলোমিটার পর্যন্ত বিদ্যুৎ লাইন টানা হয়েছে এবং সে পর্যন্তই ভ্রমণকারীরা দেখতে পান। গূহার ভেতরে ঢুকলেই অন্যরকম এক সৃজনশীলতার বিস্ময়কর ভুবনের মুখোমুখি হবেন যে কেউই। ভেতরের চ্যান্ডেলিয়রের পাশাপাশি তৃতীয় এবং চতুর্থ দ্বীপ, পাথর এবং বিভিন্ন আকৃতির ভাষ্কর্যের মতো ডিজাইন ইত্যাদি চোখ ধাঁধিয়ে দেবে দর্শকদের। আকৃতির সঙ্গে মিল রেখে ওইসব ভাষ্কর্যের বিভিন্ন নামও দেওয়া হয়েছে। যেমন ঈগলের নখরের পাঞ্জা, দুই মাথা বিশিষ্ট বাঘসহ আরও বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে এগুলোর। এর ভেতরের এমন সব দেখার জিনিস রয়েছে যেসবের বর্ণনা দিয়ে আসলে ফুটিয়ে তোলা পুরোপুরি সম্ভব নয়। শুধুমাত্র ভেতরে যাওয়া এবং স্বচক্ষে দেখার মধ্যেই রয়েছে দৃষ্টির পরিতৃপ্তি।

আমরা এবার আলিসাদর গূহা থেকে একটু ভিন্ন দিকে যাবো। কারণ হামেদান শহরে এবং এর আশেপাশে রয়েছে আরও বহু দেখার মতো বিভিন্ন স্থাপনা ও ঐতিহাসিক নিদর্শন। হামেদান শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আব্বাসাবাদের শ্যামল উপত্যকার শেষ প্রান্তে রয়েছে ঐতিহাসিক গাঞ্জনমে এবং তার পাশে বিদ্যমান চমৎকার ঝরনার পাশে স্থাপিত গাঞ্জনমে টেলিকেবিন। আলিসাদর গূহা দেখার পর টেলিকেবিনে বেড়াতে ভালোই লাগবে। ফুরফুরে একটা মন নিয়ে গূহা অভ্যন্তরের বিস্ময় নিয়ে ভাবতে ভাবতে টেলিকেবিনে চড়ার মজাই অন্যরকম লাগবে। আশা করা যায় পুরোটা দিনই চমৎকার কাটবে, আনন্দের কাটবে, রোমাঞ্চ মানে শিহরিত মানসিক অবস্থার মধ্যে কাটবে। টেলিকেবিনটি মিশন স্কোয়ার এলাকার দিকে। এলাকাটি আলভান্দের সবুজ শ্যামল উচ্চতার দিকে অবস্থিত। গাঞ্জনমে ক্রীড়া ও পর্যটন কমপ্লেক্সটি এখানকার গুরুত্বপূর্ণ একটি দর্শনীয় স্থান।

এবার আসা যাক গাঞ্জনমে সম্পর্কে। কী এই গাঞ্জনমে? হাখামানেশিয় যুগের বাদশাহ খাশায়ারশাহ এবং দারিয়ুশের শাসনামলের একটি প্রস্তরলিপি। আব্বাসাবাদের সবুজ উপত্যকার শেষ প্রান্তে অবস্থিত এটি। এখানে রয়েছে একটি ঝরনাও। সবুজের সমারোহের মাঝে একটি ঝরনাধারা যে কী পরিমাণ উপভোগ্য তা সেখানে না গেলে উপলব্ধি করা কঠিন। শীতল পানির ঝরনায় নিজেকে শীতল করে বিশ্রাম নিতে পারেন সবুজ বৃক্ষ পরিবেষ্টিত বাগিচার ছায়ায়। যারা স্কি খেলা পছন্দ করেন, তারা স্কিও উপভোগ করতে পারেন এখানে।

হামেদানে রয়েছে বিখ্যাত দুই মনীষীর মাজার। একজন ইবনে সিনা অপরজন বাবা তাহের উরিয়নি। আবু আলি সিনা বা ইবনে সিনাকে চেনেন না এমন ব্যক্তি বিশ্বের সচেতন মহলে বিরল। বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব, কবি ও দার্শনিক ইবনে সিনার মাজারটি হামেদান শহরের একেবারে কেন্দ্রে অবস্থিত।

ইবনে সিনার মাজার কমপ্লেক্সের চারপাশের পরিবেশ বেশ মনোরম। বাগ-বাগিচা আর কৃত্রিম ফোয়ারায় নান্দনিক এবং উপভোগ্য করে তোলা হয়েছে। মাজারের ভেতরে প্রধান দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি মিউজিয়াম অপরটি লাইব্রেরি। দক্ষিণ দিকের অডিটোরিয়াম যেটি মিউজিয়াম হিসেবে পরিচিত সেখানে রয়েছে মৃৎশিল্প, প্রাচীন মুদ্রাসহ খ্রিষ্টপূর্ব সহস্রাধিক বছরের পুরোনো বিচিত্র সংগ্রহ। আর উত্তর দিকের অডিটোরিয়ামটি মূলত লাইব্রেরি। এখানে রাখা হয়েছে ইবনে সিনার লেখা যাবতীয় বই পুস্তকের সংগ্রহ।

বাবা তাহের উরিয়নির মাজার

 

বাবা তাহের উরিয়নির মাজারের কথাও বলেছিলাম। তিনি ছিলেন একজন কবি ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। দ্বিপদী কবিতার জন্য তিনি বিখ্যাত। হামেদান বেড়াতে গেলে বাবা তাহরে উরিয়নির মাজারটি না দেখে আসাটা হবে খুবই অন্যায়। মাজারের ভেতরের চব্বিশটি পাথরে তাঁর লেখা চব্বিশটি দ্বিপদী খোদাই করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই মাজারের পাশেই রয়েছে হামেদান প্রদেশের হস্তশিল্প মিউজিয়াম। মাজার ঘুরেফিরে দেখে ওই হস্তশিল্প যাদুঘরটিও দেখে আসতে পারেন।  

বন্ধুরা! ভাববেন না, হামেদান ঘুরে দেখার কাজ শেষ হয়ে গেছে। না। এখনও বাকি আছে। বিশেষ করে হেগমাতানে প্রাচীন টিলা ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক একটি নিদর্শন। সম্প্রতি জানা গেছে যে এই হেগমাতানে টিলার মাঝেই ছিল অসম্ভব সুন্দর কিছু প্রাসাদ। কর্তৃপক্ষ এখন এই এলাকাটির উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

হামেদানের নাহাভান্দ এলাকায় রয়েছে একটি হ্রদ। হ্রদটির নাম হলো গিয়ন। এ যেন এক হারানো বেহেশত। প্রাচীন চেনর বৃক্ষের সমারোহপূর্ণ বাগ বাগিচা ঘেরা পরিবেশ বলে দেবে এই এলাকাটি কত পুরোনো। বলাই বাহুল্য যে হ্রদের পানির সংকুলানের কারণেই এখানে গড়ে উঠতে পেরেছে এরকম সবুজ একটি পরিবেশ। এতো সুন্দর পরিবেশ বিরাজ করার পরও এই হ্রদটি কিন্তু খুব বেশি খ্যাতি লাভ করতে পারে নি। তবে এখানকার ইমামজাদা হোসাইন মানে নবীবংশের সন্তান হোসাইনের মাজারটি যথেষ্ট সম্মানীয় ও জিয়ারতকারীদের কাছে অন্যতম পবিত্র একটি স্থানের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/  ২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ