জীবনশৈলী (পর্ব-৮): প্রতিনিয়ত ভালো কিছু করার চেষ্টা থাকতে হবে
জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর কৌশল বিষয়ক ধারাবাহিক অনুষ্ঠান জীবনশৈলীতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। জীবনশৈলীর গত আসরে আমরা জীবনকে আরও সুন্দরভাবে সাজাতে সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি।
সুস্থ মস্তিষ্কের সব মানুষই সুন্দর ও সফল জীবন চায়। জীবনকে আরও সুন্দর করে সাজাতে চায়। মানুষের এই চাওয়া বা আকাঙ্খা খুবই স্বাভাবিক, তবে এই আকাঙ্খা শুধু লালন করলেই হবে না বরং তা অর্জনে নিজেকেই উদ্যোগী হতে হবে, অন্যথায় সফলকাম হওয়া সম্ভব নয়। এই আকাঙ্খা পূরণে প্রথমে নিজের মধ্যেই পরিবর্তন আনতে হবে। আর সে পরিবর্তন হতে হবে ইতিবাচক। চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ ও শিক্ষার্জন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে এগোতে হবে। তবে সাফল্যের জন্য পরিকল্পনা যেমন দরকার তেমনি দরকার সময় ব্যবস্থাপনা। সময়ের গুরুত্ব উপেক্ষা করে কারো পক্ষেই সফল হওয়া সম্ভব নয়। সঠিক সময় ব্যবস্থাপনা ছাড়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সময় ব্যবস্থাপনার জন্য তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হলো-এক: বিদ্যমান পরিস্থিতি ভালোভাবে উপলব্ধি, দুই: লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নির্ধারণ ও তিন: পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। তবে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা তা মূল্যায়নের জন্য মাপকাঠি নির্ধারণ করাও জরুরি। যেকোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা ও বাধা-বিপত্তির বিষয়টি পর্যালোচনা ও উপলব্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন বুঝতে পারব, ঠিক কোথায় অবস্থান করছি এবং লক্ষ্যস্থল থেকে আমাদের অবস্থানের দূরত্ব কতটুকু কেবল তখনি সঠিক ও কার্যকরি পরিকল্পনা প্রণয়ন করা সম্ভব। সময় ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বিদ্যমান পরিস্থিতি ও অবস্থান সম্পর্কে সঠিক ধারণা পেতে কয়েক দিনের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা কাগজে লিখে রাখার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এটা করলে একজন মানুষ বুঝতে পারেন, সে আসলে সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে কিনা। সময় অপচয় করে থাকলেও তা ব্যক্তির কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সময় অপচয় হচ্ছে কিনা একজন ব্যক্তি যখন তা বুঝতে পারেন তখন তার জন্য সময় ব্যবস্থাপনা সহজ হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন ঠিক কোথায় সময় অপচয় হচ্ছে এবং কীভাবে এই অপচয় রোধ করা যায়।
আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী, আমি কোথায় যেতে চাই, আমার কোথায় যাওয়া উচিত, আমার আকাঙ্খা বাস্তবসম্মত কিনা- ভালোভাবে ভেবেচিন্তে এসব প্রশ্নের বাস্তবসম্মত জবাব বের করতে হবে। এরপর জীবনের স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছার পরিকল্পনাও রয়েছে। যেমন ধরুণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র এক বছরের মধ্যে একটি বিদেশী ভাষা ভালোভাবে শিখতে চায়। ভাষা শেখার পরিকল্পনাটি তার স্বল্পমেয়াদি একটি পরিকল্পনা। আর তার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করা। এর বাইরে জীবনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা প্রনয়ণের ক্ষেত্রে চিন্তা-গবেষণা ও শিক্ষার প্রভাব রয়েছে।
যাইহোক মানুষের জন্য সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে এর বিকল্প নেই। পরিকল্পনা এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে প্রতিটি ক্ষণ ও মুহূর্ত সঠিক উপায়ে কাজে লাগানো যায়। গতকাল ও আজকের মধ্যে যেন স্পষ্টভাবেই পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পবিত্র ইসলাম ধর্মের নির্দেশনা অনুযায়ী আমাদেরকে ক্রমান্বয়ে পূর্ণতার দিকে এগোতে হবে।

আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) বলেছেন, যে ব্যক্তির গতকালের সঙ্গে আজকের কোনো পার্থক্য নেই সে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে এবং কোনো ব্যক্তির আজকের দিনটি যদি গতকালের চেয়ে ভালো না হয় তাহলে সে নিজের ক্ষতি করলো। হজরত আলী (আ.) এই মহামূল্যবান বক্তব্যের মাধ্যমে সময়কে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ভালো কিছু করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। আমরা নিজেরাই প্রতিদিনের কাজের পর্যালোচনা করে দেখতে পারি- আসলেই আমরা পূর্ণতা ও উন্নতির পথে এগোচ্ছি কিনা। সময় যত গড়াচ্ছে আমরা ততই উন্নতি করছি নাকি ক্রমেই আরও পিছিয়ে পড়ছি তা খতিয়ে দেখা দরকার। আর ভুল-ত্রুটি থাকলে তা সংশোধন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়াই হলো বুদ্ধিমানের কাজ। শুধু বৈষয়িক উন্নতি নয় আধ্যাত্মিক উন্নতির বিষয়টিও মনে রাখতে হবে। আধ্যাত্মিকতা মানুষের মনে যে প্রশান্তি দেয় তা অন্য কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই গভীর করতে হবে। এর ফলে মৃত্যুপরবর্তী অনন্ত জীবনের পাথেয়ও অর্জিত হবে।
আমরা পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ে কথা বলছিলাম। অনেকের মতে, কোনো কাজের সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের অর্থ হলো সেই কাজটির প্রায় অর্ধেক সম্পন্ন হয়ে যাওয়া। পরিকল্পনা প্রণয়নের পর তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দৃঢ়তার অভাব থাকলে লক্ষ্যে পৌঁছা কঠিন হয়ে পড়ে। অলসতা দূর করতে হবে। মনে রাখতে হবে, পরিকল্পনা শতভাগ বাস্তবায়িত নাও হতে পারে, শতভাগ সাফল্য নাও আসতে পারে। বিশেষকরে প্রথম প্রথম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার আশঙ্কা বেশি থাকে। এই বাস্তবতা মেনে নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা থাকতে হবে। সময় ব্যবস্থাপনা বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে ধাপে ধাপে এবং প্রতিটি ধাপ সম্পন্ন হওয়ার তা মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতিটি ধাপেই সাফল্য ও ব্যর্থতা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ কারণে সাফল্য ও ব্যর্থতার মাপকাঠিও স্পষ্ট করা জরুরি। একেকটি ধাপ সম্পন্ন করার পর মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রয়োজনে পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে হবে। সব ধাপ শেষ করার জন্য বসে থাকলে চলবে না।
কোনো কাজে সাফল্যের জন্য দরকার কাজ করার মানসিকতা, ওই কাজের প্রতি আগ্রহ। যেকোনো কাজের প্রতি আগ্রহ ও আকর্ষন সেটাকে যেমন সুন্দর ও নিখুঁত হতে সহায়তা করে তেমনি কাজে গতিও এনে দেয়। তিনিই হলেন একজন দক্ষ সময় ব্যবস্থাপক যিনি তার স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী দৈনন্দিন রুটিন তৈরি করেন। রুটিন তৈরির ক্ষেত্রে অতি আবেগি হওয়া চলবে না। এছাড়া সাময়িক লাভজনক কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অকল্যাণকর-এমন বিষয় কার্যতালিকায় রাখা যাবে না। শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত না থেকে বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান, আত্মীয় ও পাড়া-প্রতিবেশীর সাথেও কিছু সময় ব্যয় করার পদক্ষেপ নিতে হবে। আসলে পৃথিবীতে তারাই স্মরণীয় ও বরণীয় যারা সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়েছেন এবং সময়ের কাজ সময়মতো করেছেন।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।