জীবনশৈলী (পর্ব-৯): জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে সময় ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিতে হবে
আমরা গত দুই আসরে সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এর নানা দিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা বলেছি জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে সময়-ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই।
সময় ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যখনের কাজ তখন সম্পন্ন করা এবং কোনো ভালো সুযোগ সামনে এলে তা ব্যবহার করা। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, যারা সময় ও সুযোগকে অবহেলা করে তারা পরবর্তীতে আফসোস করতে বাধ্য হয়। আর এ ধরণের পরিস্থিতি মানুষের জীবনকে কঠিন করে তুলতে পারে। পবিত্র ইসলাম ধর্মে ভালো সুযোগ কাজে লাগানোর ওপর অপরিসীম গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমিরুল মুমিনিন হজরত আলী (আ.) বলেছেন, সুযোগ হচ্ছে ভাসমান মেঘের মতো। ভালো সুযোগ সামনে এলে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। গোটা বিশ্বের সর্বোত্তম আদর্শ মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) সময় ও সুযোগ সঠিকভাবে কাজে লাগানোর ওপর বারবার গুরুত্ব দিয়েছেন।
মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) বলেছেন, পরবর্তী পাঁচটি অবস্থা আসার আগেই বর্তমান পাঁচটি অবস্থাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এগুলো হলো- ব্যস্ততার আগে অবসর সময়, অসুস্থতার আগে সুস্থতা, দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতা, বার্ধক্যের আগে তারুণ্য এবং মৃত্যুর আগে জীবন। অন্যভাবে বলা যায়, মানুষের জীবনে যখন সুযোগ আসে, তখন সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। সেই সুযোগ লাভজনক ও কল্যাণকর কাজে ব্যয় করতে হবে। মহানবী হজরত মোহাম্মাদ (স.)'র এই হাদিসে এ বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, মানুষের অবসর সময় দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ব্যস্ততা যেকোনো সময় আসতে পারে। তাই অবসর সময়কে যদি নিয়ম অনুযায়ী কাজে লাগানো হয়, সময়ের যদি মূল্য দেয়া হয়, তাহলে পরে যখন ব্যস্ততা আসবে, তখন আফসোস করতে হবে না। শরীর যখন সুস্থ থাকে, তখন প্রয়োজনীয় কর্তব্য সম্পন্ন করে নেয়া উচিত।
অসুস্থতার মতো এমন অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলো জানান দিয়ে আসে না। তাই সুস্থ সময়ের মূল্য অনুধাবন করে অসুস্থতার আশঙ্কা মাথায় রেখে কর্তব্য পালনে তৎপর হতে হবে। বার্ধক্যকালে মানুষের কর্মক্ষমতা কমে যায়। তারুণ্যে যত উদ্যম ও চাঞ্চল্য নিয়ে কাজ করা যায়, বার্ধক্যে তা পারা যায় না। তাই তরুণ বয়সের সদ্ব্যবহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। তেমনি সচ্ছল সময়ে শান্ত মনে অনেক ভালো কাজের চিন্তা করা যায়। প্রয়োজনে অর্থ ব্যয় করার সুযোগ থাকে। এ সচ্ছলতার সুযোগ ভালো কাজে ব্যয় করতে হবে। মৃত্যুর আগে জীবনকালের মূল্য দেওয়া উচিত। দুনিয়ার জীবন আখিরাতের জন্য পাথেয় সংগ্রহের সময় ও সুযোগ। আমাদের জীবনকালের একটা সীমা আছে। জীবনের একটা সমাপ্তি আছে। প্রতিটি মানুষের জীবনকালে কোনো কোনো কাজ একাধিকবার করার সুযোগ থাকলেও বেশিরভাগ কাজ কেবল একবারই করার সুযোগ থাকে। যে কাজগুলো একাধিকবার করার সুযোগ হয়, সেগুলোও প্রথম সুযোগেই করে ফেলা উচিত। কোন যৌক্তিক কারণ ছাড়া সুযোগ ও সময় হাতছাড়া করা গ্রহণযোগ্য নয়।
আমরা সাধারণত একটু কঠিন কাজ হলে সেটা পরে করব বলে ফেলে রাখি। অবহেলা ও আলসেমিতে সময় পার করলে এবং জরুরি কাজ পরবর্তী সময়ের জন্য রেখে দিলে হতে পারে সে কাজটি করার সময় আর পাওয়া যাবে না। ‘একটু পরে করব’, ‘কালকে করব’, ‘এখন ভাল লাগছে না’ এ ধরনের কথা বলে যারা কাজকে পিছিয়ে দেয়, তারা ইহকাল ও পরকাল দুই জগতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে লাভজনক কাজে ব্যবহার করা প্রয়োজন। তবে জীবনের প্রতিটি ভালো অবস্থা বা সুযোগকে কাজে লাগাতে হলে মানুষের ইচ্ছাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ। ইচ্ছাশক্তি থাকলে যেকোনো চেষ্টা সফল হয়। বর্তমান বিশ্বে সভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছে, তার পেছনে রয়েছে মানুষের ইচ্ছা ও আগ্রহ। দৃঢ় ইচ্ছাই কোনো কিছু সফল করার সুযোগ এনে দেয়। কাজ করার জন্য ইচ্ছাশক্তিই যেকোনো কাজ বাস্তবায়নে মানুষকে প্রত্যয়ী করে তোলে। যে ব্যক্তি ইচ্ছাশক্তিকে যত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে লাগাতে পেরেছে, সেই ব্যক্তিই তত সফল মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এ জন্য উদ্দেশ্য ঠিক রেখে দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে।

জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে মানুষের জন্য আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, আর তাহলো শৃঙ্খলা। জীবনে শৃঙ্খলার অভাব থাকলে নানা ক্ষেত্রে এর প্রভাব পড়ে। যেমন ধরুন আপনার কাজের টেবিলের জিনিসপত্র যদি এলোমেলো থাকে, বাসার আসবাবপত্র যদি সাজানো-গোছানো না থাকে তাহলে আপনার মধ্যে একাগ্রতার ঘাটতি দেখা দিতে পারে। কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়াটা কঠিন হয়ে যেতে পারে। এর ফলে আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে এবং নিজেকে দুর্বল ও অক্ষম মনে হতে পারে। সাধারণত যারা সুশৃঙ্খল তারা সময়ানুবর্তীও হয়ে থাকে। যারা ইতিহাসের পাতায় বরেণ্য ও ধন্য হয়েছেন তাদের জীবনে সময়ানুবর্তিতা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় কীভাবে তারা সময়কে মূল্য দিয়েছেন। বর্তমানে মানবজীবনের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হলো সময়ের কাজ সময়ে না করা।
সময়কে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে বিশেষজ্ঞদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া যেতে পারে। তাদের অভিজ্ঞতা ও গবেষণাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। কানাডীয় গবেষক ব্রায়ান ট্রেসি এমনই একজন ব্যক্তিত্ব যিনি টাইম ম্যানেজমেন্ট বা সময় ব্যবস্থাপনা নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি বই লিখেছেন। ব্রায়ান ট্রেসি তার বই ‘টাইম ম্যানেজমেন্টে’ লিখেছেন, কাগজে লিখে পরিকল্পনা তৈরি করুন। মুখে মুখে পরিকল্পনা তৈরি করা বন্ধ করুন।
আমরা সাধারণত আমাদের পরিকল্পনা কাগজে লিখে রাখি না। এ কারণে দেখা যায় পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা এগোতে পারি না। অনেক কিছু ভুলে যাই। আমরা পরিকল্পনা লিখে সে অনুযায়ী বাস্তবায়ন করতে পারলে সাফল্যের সম্ভাবনা বাড়বে। চলুন আমরা পরিকল্পনা কাগজে লেখার অভ্যাস গড়ে তুলি।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।