জীবনশৈলী (পর্ব-১০): সময় ব্যবস্থাপনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো শৃঙ্খলা
আল্লাহতায়ালা সৃষ্টিজগতকে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছেন। এ কারণে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষও অত্যন্ত সুশৃঙ্খল হবেন এটাই প্রত্যাশিত। বিশ্বের সব মানুষের আদর্শ ও সর্বশেষ রাসূল হজরত মুহাম্মাদ (স.)'র কথা, কাজ ও আচরণে শৃঙ্খলাবোধ স্পষ্ট ছিল।
বিভিন্ন বর্ণনায় এসেছে, মহানবীর জীবনের সব ক্ষেত্রে ছিল শৃঙ্খলাবোধের স্পষ্ট ছাপ। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) এতটাই সুশৃঙ্খল ছিলেন যে, কোনো মানুষই তা দেখে আকৃষ্ট না হয়ে পারতো না। সবাই তার প্রতি আকৃষ্ট হতো। তবে মনে রাখতে হবে, মানুষের ব্যক্তিগত ও অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা হঠাৎ করে অর্জিত হয় না। হঠাৎকরে সিদ্ধান্ত নিলেই তা পাওয়া যায় না। অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা অর্জন একটি প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়া হলো ইতিবাচক বা সুচিন্তা এবং মসৃন জীবন প্রণালীর ফসল। আত্মসংশোধন পক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা শৃঙ্খলাবোধ আত্মস্থ করতে পারি।
বিখ্যাত নাহজুল বালাগা গ্রন্থে উল্লেখ আছে হজরত আলী (আ.)-কে ঘাতক ইবনে মুলজাম আঘাত করার পর ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হোসেন (আ.)-কে তিনি যে দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন তা হলো, তাকওয়া অবলম্বন করবে এবং কাজের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা মেনে চলবে। এর মাধ্যমে তিনি মানুষের জীবনে শৃঙ্খলাবোধের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। অন্যান্য জীব থেকে তার পার্থক্য সে বুদ্ধিমান, বিবেকবান ও নিয়মের অধীন। এ কারণে মানুষের কথায় ও কাজে জীব হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ থাকতে হবে। শৃঙ্খলাবোধ মানুষের জীবনকে শান্তিময়, সুন্দর ও সার্থক করে তোলে। মানুষ কী করবে এবং কী করবে না এর একটা বিধিনিষেধের গণ্ডি ইসলাম তাকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। গণ্ডির বাইরে যাবার কোনো সুযোগ তার নেই। ইসলাম মানেই হলো আত্মসমর্পণ করা, মেনে চলা।
কেউ যখন একবার ইসলামের গণ্ডিতে চলে আসে তখন সে তার জীবনটাকে আর মনের ইচ্ছে অনুযায়ী চালাতে পারে না; ইসলাম যে বিধিনিষেধ দিয়েছে সেগুলো তাকে মেনে চলতে হয়। মানা বা শৃঙ্খলার বিধান যে শুধু ধর্মীয় ক্ষেত্রে এমনটা নয়; পার্থিব ক্ষেত্রেও সবখানে তাকে শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে এটা বান্দার জন্য ইবাদত। ধর্মীয় আইনের বাইরেও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলা মুসলমানের কর্তব্য। সামাজিক অনেক বিধিনিষেধ আছে যা কেবল সামাজিক কারণেই মেনে চলতে হবে এমনটি নয়; বরং ধর্মীয় অনুশাসন বজায় রাখার জন্যও তা মেনে চলা কর্তব্য। মানব জীবনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হযরত আলী (আ.) বলেছেন- ‘মানুষের জীবনটাকে যথার্থ ও সঠিকভাবে যাপন করার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা এবং শৃঙ্খলা। সে জন্য তার জীবনের সময়টাকে তিনটি খাতে ব্যয় করা উচিত- ১. জীবনের কল্যাণের জন্য, ২. আত্মিক শান্তি এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য, এটা অর্জিত হবে কেবল আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী ও তার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে, এবং ৩. শারীরিক এবং মানসিক শক্তি লাভের জন্য।’
তিনি আরো বলেন- ‘মুমিনের জীবনের কর্মপরিকল্পনায় তিনটি সময় সুনির্দিষ্ট থাকা উচিত। আর এগুলো হলো ১. তার স্রষ্টার ইবাদতের জন্য, ২. হালাল জীবিকা উপার্জনের জন্যএবং ৩. সৎ ও বৈধ আনন্দ উপভোগের জন্য।

আমরা এর আগেও যেমনটি বলেছি, সৃষ্টিজগতের সর্বত্র রয়েছে নির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলা। আল্লাহর সৃষ্টির সবকিছুই সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত । প্রকৃতির সৃশৃঙ্খল নিয়মে সকালে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়। রাতের আকাশে উঁকি দেয় চাঁদ ও তারা। দিবারাত্রির এই পরিক্রমায় প্রকৃতিতে চলে ষড়ঋতুর আবর্তন। প্রকৃতির এই নিয়ম বন্ধনে বাঁধা মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব। তাই প্রকৃতির মতো মানুষেরজীবন অনিবার্যভাবে এসে পড়ে শৃঙ্খলার দায়ে ।
মানুষের ব্যক্তিজীবনের বিকাশ ও পরিচালনার সঙ্গে রয়েছে শৃঙ্খলার যোগ। জন্ম খেকে মৃত্যু পযন্ত মানুষের ব্যক্তিজীবন নানা নিয়ম-শৃঙ্খলার বন্ধনে বাঁধা। এই শৃঙ্খলাই আসলে মানুষের জীবনে চলার ছন্দ। যে ছন্দ ব্যক্তি জীবনকে শান্ত, সুস্থির, ফলপ্রসু করার অবলম্বন। এই শৃঙ্খলাবোধই সমাজ ও জাতীয় জীবনে অগ্রগতি নিশ্চিত করার চালিকাশক্তি। উন্নতি ও কল্যাণ নিশ্চিত করার স্বার্থেই মানুষের জন্য নিয়ম ও শৃঙ্খলা জরুরি। কারণ নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যদিয়ে বিকশিত হয় মানুষের ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ব ও প্রতিভা। শৃঙ্খলাবোধ আত্মস্থ করার জন্যে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে সামনে এগোতে হবে। প্রথমত প্রয়োজন সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলা। দ্বিতীয়ত আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত। মর্যাদা অনুসারে মানুষের সঙ্গে শ্রদ্ধা, প্রীতি ও স্নেহের সম্পর্ক অনুসরণ করতে শেখা সামাজিক শৃঙ্খলার একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। শৃঙ্খলাবোধ অর্জনের ক্ষেত্রে উত্তম নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের অনুশীলন দরকার।
বিপরীতে আসলে গোটা মানব জাতির অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে বিশৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খলা পরিহার করে জীবনকে সুন্দর করার জন্য নিয়ম-রীতির মধ্যে প্রবেশ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সুশৃঙ্খল জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই কাজে লাগে। সময়ের অপচয় হয় না। মহান ব্যক্তিদের জীবনে তা স্পষ্ট। চিন্তা ও কর্মে শৃঙ্খলা অনুসরণ করলে মানুষ মহৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। দায়িত্বের প্রতি সৎ ও একাগ্র থাকাটাও শৃঙ্খলার একটি মৌলিক অংশ। আসলে শৃঙ্খলাই হচ্ছে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের সৌন্দর্য। জীবন সুশৃঙ্খল করতে সময় ব্যবস্থাপনার বিষয়টি মনে রাখতে হবে। সময়ের সদ্ব্যবহার করলে সুশৃঙ্খল জীবনের অধিকারী হওয়া যায় খুব সহজে। #
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৬
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।