ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯ ১৬:৫০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইমাম হাসান আসকারি (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছি যে, তাঁর ইমামতের সময়কাল জুড়ে তিনজন আব্বাসীয় খলিফা শাসনকাজ পরিচালনা করেছেন। ওই তিনজনের মধ্যে মুয়াত্তাজ আব্বাসি ও মাহদি আব্বাসির চরম দুঃশাসন ও দমনপীড়ন সম্পর্কেও খানিকটা ইঙ্গিত দিয়েছি।

আব্বাসীয় ওই দুই খলিফাই ইমাম হাসান আসকারি (আ.)’র ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী বিদ্রোহী সেনাদের হাতে ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হয়। এরপর শুরু হয় মো’তামেদ আব্বাসির ভয়াবহ দুঃশাসন।  ক্ষমতা হাতে পেয়েই পূর্বপুরুষদের মতো জনগণের ওপর অত্যাচার, মাতলামি ও ইন্দ্রিয়পূজায় মেতে ওঠে সে। এ সময় ইমামের বহু ঘনিষ্ঠ সঙ্গীকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয়। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, মো’তামেদের শাসনামলে তার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে প্রায় পাঁচ লাখ লোককে প্রাণ দিতে হয়।

এতসব অত্যাচার ও নীপিড়ন সত্ত্বেও ইমাম হাসান আসকারি (আ.)’কে ঘিরে তাঁর অনুসারীদের ভিড় কখনো কমেনি। আব্বাসীয় খলিফাদের জন্য বিষয়টি ছিল চরম মনোকষ্টের কারণ। তারা সব সময় এই আশঙ্কায় থাকত কখন না জানি ইমামের নেতৃত্বে সাধারণ মানুষ বিদ্রোহ করে তাদের ক্ষমতার মসনদ কেড়ে নেয়। এ কারণে শাসকরা ইমামের গতিবিধিকে চরম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখত। কিন্তু ইমাম হাসান আসকারির ব্যক্তিত্ব ও সুমধুর ব্যবহারের কারণে শুধু তাঁর অনুসারীরা নন বরং তাঁর শত্রুরাও তাঁকে ভালোবাসত।

খলিফা মো’তামেদ আব্বাসি হযরত হাসান আসকারি (আ.)কে কারাগারে বন্দি করে রাখে এবং কারারক্ষীদের মাধ্যমে নির্যাতনের পাশাপাশি মাঝেমধ্যেই এই খবর নেয়ার চেষ্টা করে যে, ইমামের আচরণে কোনো পরিবর্তন এসেছে কিনা। অর্থাৎ ইমাম কি আগের মতো নিজের অবস্থানে অটল রয়েছেন নাকি খলিফার সঙ্গে আপোষ করতে রাজি হয়েছেন? কিন্তু তার কারারক্ষীরা তাকে খবর দেয়, ইমামের নীতিতে তো পরিবর্তন আসেইনি বরং তিনি কারাকক্ষে বসে দিনে রোজা রাখছেন এবং সারারাত আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগিতে কাটিয়ে দিচ্ছেন। কাজেই ইমামকে বন্দি করে রেখে কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জনগণকে ধোঁকা দেয়ার উদ্দেশ্যে মো’তামেদ আব্বাসি ইমাম হাসান আসকারি (আ.)কে মুক্ত করার নির্দেশ দেয়।

প্রকৃতপক্ষে ইমামের এই আচরণে সূরা বাকারার ১৫৩ নম্বর আয়াতের নির্দেশ বাস্তবায়নের বিষয়টি লক্ষ্য করা যায় যেখানে আল্লাহ বলছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমরা ধৈর্য এবং নামাজের (মাধ্যমে আল্লাহর) সাহায্য চাও, আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গেই রয়েছেন।”

এদিকে কারাগার থেকে মুক্তি দিলেও ইমামের গতিবিধির ওপর সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং তাঁর সঙ্গে তাঁর অনুসারীরা যাতে দেখা করতে না পারে সেরকম ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু এতসব কড়াকড়ি সত্ত্বেও ইমামের অনুসারীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে ইমামের সাহচার্য লাভ অব্যাহত রাখেন।

এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয় আর তা হলো- অন্যান্য সব যুগের মতো ইমাম আসকারি (আ.)’র সময়কার সব মানুষও একই মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিল না। ইমাম নিজে এ সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে মানুষকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে বলেন, কিছু মানুষ গুনাহমুক্ত জীবনযাপন এবং ইসলামের সব দিকনির্দেশনা নিজেদের জীবনে বাস্তবায়িত করে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অটল রয়েছেন। এ ধরনের মানুষ ইমামদেরকে তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে বেছে নিয়েছেন। কিন্তু আরেকদল মানুষ সঠিক পথের দিশারী চিনতে ভুল করার কারণে সিরাতুল মুস্তাকিম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। আর তৃতীয় আরেকদল মানুষ সরাসরি শয়তানের দলে যোগ দিয়েছে। এরপর ইমাম বলেন, নিঃসন্দেহে প্রথম দলের মানুষ সমাজকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.)’র একজন ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলেন: আমি একবার ইমামের কাছে চিঠি লিখে নিজের অভাব-অনটন নিয়ে তাঁর কাছে অভিযোগ করি। পরে আমার মনে হয় ইমাম জাফর সাদেক (আ.)’র কথা যিনি বলেছিলেন, আমাদের সাহচার্যে থেকে অভাব-অনটন ভোগা আমাদের শত্রুদের সঙ্গে থেকে প্রাচুর্যময় জীবনযাপনের চেয়ে উত্তম এবং আমাদের সাহচার্যে থেকে শাহাদাতবরণ করা আমাদের শত্রুদের সাহচার্যে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম। ততদিনে ইমাম আসকারির পক্ষ থেকে চিঠির জবাব আসে এরকম: আমাদের অনুসারীরা ভুলক্রমে গুনাহ’র কাজ করে ফেললে দারিদ্রের কষ্ট ভোগ করার বদৌলতে আল্লাহ তায়ালা সে গুনাহ মাফ করে দেন। এ ছাড়া, দারিদ্র আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য পরীক্ষা। ধৈর্যধারণের মাধ্যমে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়।

পাপকাজের প্রতি মানুষের আকর্ষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ। এই মোহ মানুষকে হকপথ থেকে বাতিলের পথে টেনে নিয়ে যায়, স্বাধীন মানুষ অপরের বন্দিত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয় এবং সে সম্মানিত জীবন ছেড়ে অবমাননাকর জীবন বেছে নিতেও কুণ্ঠিত হয় না। বর্তমান সময়ে বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশ এরকমভাবে সাম্রাজ্যবাদীদের বন্দিত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ রয়েছে। এসব দেশ যখন দেখতে পায় আধিপত্যকামী শক্তিগুলোর ছায়াতলে আশ্রয় নেয়া জাতিগুলো ধন-সম্পদে সুখে রয়েছে এবং স্বাধীনচেতা দেশগুলো পরাশক্তিগুলোর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার কারণে দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হচ্ছে তখন তারা স্বাধীনচেতা হয়ে সম্মানিত জীবন উপভোগ করার পরিবর্তে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ অথচ তাৎক্ষণিক প্রাচুর্যময় জীবনকে বেছে নিচ্ছে।

কিন্তু ইমামগণ এই ধরনের জীবন মেনে নিতে কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তারা সব মানুষকে সম্মানের সঙ্গে মৃত্যুবরণ করাকে অবমাননাকরভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে উত্তম হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ইমামদের এই বক্তব্য পবিত্র কুরআনের দিকনির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।  সূরা নিসার ১৩৯ নম্বর আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে: “যারা মুসলমানদের বর্জন করে কাফেরদেরকে নিজেদের বন্ধু বানিয়ে নেয় এবং তাদেরই কাছে সম্মান প্রত্যাশা করে, অথচ যাবতীয় সম্মান শুধুমাত্র আল্লাহরই জন্য।” #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ