জানুয়ারি ০৪, ২০২০ ২১:২৬ Asia/Dhaka

ইরানের আইআরজিসি'র কুদস ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে মার্কিন সন্ত্রাসী হামলায় হত্যার বিষয়টি এখন বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। এ বিষয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, ইরানের কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে সন্ত্রাসী হামলায় হত্যার মধ্য দিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মূলত যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এর জবাবে ইরানের প্রতিক্রিয়াও হবে অত্যন্ত কঠিন। যুদ্ধের আশঙ্কাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না।

পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব সিরাজুল ইসলাম, ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি'র কুদস বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল কাসেম সোলাইমানি মার্কিন বিমান হামলায় বাগদাদ বিমান বন্দরের কাছে শুক্রবার ভোর রাতে শাহাদত বরণ করেছেন। তো আপনি জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত নিয়ে কি বলবেন?

জেনারেল  কাসেম সোলাইমানি

সিরাজুল ইসলাম: ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসির কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল কাসেম সোলাইমানি ছিলেন এই মুহূর্তে বিশ্বের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সেনা ব্যাক্তিত্ব। জেনারেল কাসেম সোলাইমানি এমন একজন সেনা নায়ক ছিলেন যাঁর কারণে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে ইরাক এবং সিরিয়ায় উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর পরাজয় তরান্বিত হয়েছে। তাঁর রণ কৌশলের কারণে এসব এলাকায় সন্ত্রাস নির্মূল হয়েছে। আর ঠিক এ বিষয়টি আমেরিকার ভালো লাগছিল না। কারণ এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তৈরি করেছিল; তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল, অর্থ -সমর শক্তি ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিল আমেরিকা-ইসরাইল এবং তাদের আঞ্চলিক কিছু মিত্র। সেখানে জেনারেল কাসেম সোলাইমানি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন এবং যুদ্ধ করে তাদের নির্মূল করার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। আর এই সন্ত্রাসীগোষ্ঠীকে রুখে দেয়া বা মোকাবেলা করার অর্থ হচ্ছে আমেরিকাকে রুখে দেয়া এবং মোকাবেলা করা। এসব অঞ্চলে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী তৈরি করার অর্থ ছিল আমেরিকার কিছু স্বার্থ হাসিল করা। সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ইরানের অকুতোভয় সমর নায়ক জেনারেল সোলাইমানি। তাঁর শাহাদত ইরানের জন্য অনেক বড় ক্ষতি। মার্কিনবিরোধী বড় একটি বলয় রয়েছে তাদের জন্যও বড় ক্ষতি। জেনারেল কাসেম সোলাইমানির সন্ত্রাসবাদবিরোধী প্রচণ্ড রকমের প্রতিরোধমূলক অবস্থানের কারণে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন সমর নায়ক। আর সেই সমর নায়ককে হত্যা করার কারণে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একরকমের শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আমি ব্যক্তিগত বলছি এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক, দুঃখজনক ও দুভার্গ্যজনক। তাঁর শহিদ হওয়া ইসলামের জন্য, ইরানের জন্য এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী যে ফ্রন্ট ময়দানে কাজ করছিল সেই ফ্রন্টের জন্য বড় রকমের ক্ষতি হয়ে গেল। 

আইআরজিসি'র কুদস ফোর্সের প্রধান শহীদ জেনারেল কাসেম সোলাইমানি

রেডিও তেহরান:  জ্বি জনাব সিরাজুল ইসলাম আপনি যেকথা বলছিলেন যে, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে অনড় প্রতিরোধের একটি নজিরবিহীন প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন সমর নায়ক লে.জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। সেই কাসেম সোলাইমানির শাহাদাতের মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্বে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আপনি একথা বলছিলেন। এ ঘটনার পর আপনি জানেন যে ইরানে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। তো এরপর ইরানের প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে?

সিরাজুল ইসলাম: দেখুন, আমার মনে হয় জেনারেল কাসেম সোলাইমানি তো ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতিরোধ ফ্রন্টে লড়াই করছিলেন না; তিনি ইরানের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্তেই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন। আর কাসেম সোলাইমানির শাহাদত ইরানের জন্য মর্যাদার প্রশ্ন; জয় পরাজয়ের প্রশ্ন ও ইরানের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন। সেক্ষেত্রে এ ঘটনায় ইরান একেবারে ছাড় দেবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। আমি বিশ্বাস করি এবং ধারনা করি  জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদতের পর ইরানের প্রতিক্রিয়া অনেক কঠিন হবে। আর ইরানের কঠিন প্রতিক্রিয়ার ফলাফল আমেরিকাকে ভোগ করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে ইরান কোনোরকম ছাড় দেবে না আপোশ করবে না। কাসেম সোলাইমানি যেভাবে ইরানের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল ঠিক তেমনই আমেরিকার বিরুদ্ধে ইরানের প্রতিক্রিয়াটাও হবে সেরকম গুরুত্বপূর্ণ। আর ফলশ্রুতিতে মার্কিন বাহিনীকে অনেক বড়রকমের খেসারত দিতে হবে মধ্যপ্রাচ্যে। আপনি জানেন যে এরইমধ্যে মার্কিন বাহিনীকে ইরান সন্ত্রাসী বাহিনী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। অতএব উগ্র তাকফিরি সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইরান যেভাবে লড়াই করেছে আমি মনে করি মার্কিন বাহিনীর সামনে সেরকমই পরিণতি অপেক্ষা করছে। 

রেডিও তেহরান: জনাব সিরাজুল ইসলাম, নানাকারণে এমনিতেও আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের সাথে ইরানের একটা উত্তেজনা ছিল তাছাড়া এরইমধ্যে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে গেছে। তারমধ্যে এ ঘটনায় কী আপনি যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন?

জেনারেল সোলাইমানির মরদেহকে লাখ লাখ মানুষের শ্রদ্ধা

সিরাজুল ইসলাম: দেখুন, যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। এর কারণ হচ্ছে মার্কিন ঘরোয়া রাজনীতি এই মুহূর্তে বেশ টালমাতাল অবস্থায়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থাও টালমাতাল। তার জনপ্রিয়তা ভাটার দিকে এবং তিনি ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি। তাছাড়া ইরাকের সাম্প্রতিক ঘটনায় ডেমোক্রাটদের চাপের মুখে রয়েছেন তিনি এবং ডেমোক্রাটদের অনেক সরাসরি ট্রাম্পকে দায়ী করে বলেছেন তার কারণেই ইরাকে মাকির্নিরা নেতিবাচক অবস্থায় পড়েছে। এররকম পরিস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজের অবস্থা ঠিক রাখার জন্য এবং তার ওপর যে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির চাপ রয়েছে তা ঠিক রাখার জন্য তিনি এরকমের একটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে জনপ্রিয়তার পারদ কিছুটা উপরের দিকে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। 

সেক্ষেত্রে ইরান হয়তো এইমুহূর্তে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে চাইবে না। কারণ এই মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অনেক অনেক কাজ রয়েছে। আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করাটাই আসল কথা নয়। এ অঞ্চলে সন্তাসবাদীঘোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ইরানকে লড়াই করতে হচ্ছে। এরকম একটা পরিস্থিতিতে ইরান হয়তো সহজে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে চাইবে না। আমেরিকার পক্ষ থেকে কি করা হচ্ছে সেরকম আরও বেশ কিছু পদক্ষেপ হয়তো ইরান বিবেচনায় নেবে। তবে আমেরিকা হয়তো যুদ্ধে জড়িয়ে মতো একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে ফেলতে পারে। যদি তারা সেরকম একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে সেক্ষেত্রে ইরান প্রস্তত আছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ইরান সবধরনের ফ্রন্টে লড়াই করতে প্রস্তুত রয়েছে। তিনি সামরিক বাহিনীকে সবসময় প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে আমেরিকার উদ্যোগ দেখে ইরান পদক্ষেপ নেবে। তবে একথা বলা যায় ইরান আগ থেকে যুদ্ধ শুরু করবে না। পাশাপাশি একথাও ঠিক আমেরিকা জেনারেল সোলাইমানিকে সন্ত্রাসী কায়দায় যেভাবে হত্যা করেছে সেটি যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। সেক্ষেত্রে ইরান বুঝেশুনে পদক্ষেপ নেবে। আমি আবারও বলছি যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

যুদ্ধের আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না

রেডিও তেহরান: জ্বি সিরাজুল ইসলাম, আপনি বললেন যে সামগ্রিকভাবে যুদ্ধের আশঙ্কার বিষয়টি উড়িয়ে দেয়া যায় না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বেগতিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে তার সুনামের পারদ কিছুটা উপরে উঠানোর জন্য এধরনের ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে এবং বিরোধী ডেমোক্রাটদের চাপ সেখানে রয়েছে। তো ইরাকে এই যেসব ঘটনা ঘটছে সামগ্রিকভাবে ভবিষ্যতে এর কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?

সিরাজুল ইসলাম: দেখুন, এই মুহূর্তে আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যে অনেকগুলো ঘটনা ঘটিয়েছে বিশেষ করে ইরাকে। আর কেন ঘটিয়েছে-তার কারণ হিসেবে তাদের অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি কিছু প্রসঙ্গ আমি এর আগে অন্য প্রশ্নের জবাবে আমি বলেছি। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইরাকে যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে তার প্রেক্ষাপটে ইরান থেকে ১৯৭৯ সালে  আমেরিকা যেভাবে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল আমার মনে হয় সামনের দিনগুলোতে ইরাক থেকে একইভাবে বের হয়ে যেতে বাধ্য হবে। সেরকম দিন তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ইরাকের মার্কিন দূতাবাসে সেখানকার সাধারণ জনগণ এবং জনপ্রিয় হাশদ আশ শাবি বাহিনীর সমর্থকদের যে হামলা হয়েছিল সেটি ছিল খুবই তীব্র হামলা। আর সেই হামলা থেকে এই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে ইরাকের সাথে মার্কিনিদের কোনো সম্পর্ক থাকবে কি না !  আমার ধারনা এ বিষয়টি আগামী কিছুদিনের মধ্যে নির্ধারিত হয়ে যাবে। আমাদের একটি বিষয় জানা দরকার সেটি হচ্ছে জনপ্রিয় স্বেচ্ছাসেবী হাশদ আশ শাবি বাহিনী সেই বাহিনী যারা মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে ইরাক ও সিরিয়ায়  উগ্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করেছে এবং ইরাকের সরকারি বাহিনীর সাথে তারা কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। তাদের লড়াই কিন্তু সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে। আর তাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে আমেরিকা। আর সেই হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইরাকের হাজার হাজার, লাখো মানুষ জেগে উঠেছে। তারা মার্কিন দূতাবাসে হামলা চালিয়েছে। এরমানে হচ্ছে একটি দেশের সাধারণ মানুষ যখন কোনো ঘটনায় জড়িয়ে যায় তখন সাধারণ মানুষকে সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যায়। আমার মনে মার্কিন সরকারের জন্য আগামী দিনগুলো একইরকমের কঠিন হয়ে যাবে। যেরকম কঠিন হয়েছিল ১৯৭৯ সালে ইরানে।

রেডিও তেহরান: জনাব সিরাজুল ইসলাম সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার হিসেবে কাসেম সোলাইমানির শাহাদাত-যা বিশ্বে নাড়া দিয়েছে। সেই ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষের কি প্রতিক্রিয়া আপনি দেখছেন?

সিরাজুল ইসলাম: দেখুন, জেনারেল কাসেম সোলাইমানি একজন আন্তর্জাতিক সেনা ব্যক্তিত্ব, একজন সমর নায়ক।সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি। তাছাড়া ইরানের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একটা আলাদা ভালোবাসা, দরদ এবং সম্মানের একটা জায়গা আছে। সেকারণে ইরানের যেকোনো ঘটনার সাথে বাংলাদেশের মানুষের একটা সম্পর্ক থাকে। ইরানের যেকোনো সাধারন ঘটনাও বাংলাদেশের সাধারন মানুষকে মারাত্মকভাবে ছুঁয়ে যায়। জেনারেল কাসেম সোলাইমানির শাহাদতের ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দারুণভাবে বেদনার সৃষ্টি করেছে বেদনার ছায়া নামিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের বহুসংখ্যক মানুষ বিশেষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখা যাচ্ছে যে মানুষ শোকার্ত হয়ে পড়েছে। তারা জেনারেল সোলাইমানি এবং ইরানের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছে।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৪
 

ট্যাগ