এপ্রিল ০১, ২০২০ ১৫:৪১ Asia/Dhaka

আমেরিকায় করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সোমবার পর্যন্ত সেখানে ৩৫ বাংলাদেশিসহ প্রায় চার হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে ১ লাখ ৯০ হজার মানুষ। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হোয়াইট হাউজে দেয়া বক্তব্যে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি ভয়াবহ খারাপের দিকে যাচ্ছে। দেশবাসীকে তিনি ‘খবুই বেদনাদায়ক’ সপ্তাহের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। ট্রাম্প আরো বলেছেন, আগামী কয়েক সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় আড়াই লাখের মতো মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

আমেরিকায় করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি এবং সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো অধ্যাপক আলী রীয়াজের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি রেডিও তেহরাানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আমেরিকায় এতবেশি এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার নানা কারণের মধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে- ট্রাম্প প্রশাসনের এক ধরনের উদাসীনতা।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।

রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক আলী রিয়াজ, আপনি আমেরিকায় আছেন। সেখানে করোনভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে এবং এখন সারা বিশ্বের মধ্যে আমেরিকাতেই আক্রান্তের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে- চীনে ছড়িয়ে পড়ার এতদিন পর আমেরিকাতে এ ভাইরাস এতটা মারাত্মকভাবে কেন ছড়িয়ে পড়লো?

আমেরিকায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব

অধ্যাপক আলী রিয়াজ: দেখুন, আমেরিকাতে এভাবে এতবেশি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার নানারকম কারণ আছে। এরমধ্যে প্রধান কারণ হচ্ছে মার্কিন সরকার তথা ট্রাম্প প্রশাসনের একধরনের উদাসীনতা। করোনা বিষয়ে তাদের একধরনের দায়িত্বহীন আচরণ। গোড়ার দিকে যখন এই করোনা মহামারির বিভিন্ন রকম লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, তার প্রশাসনের কেউ কেউ বা অনেকেই এটাকে অস্বীকার করেছেন। অস্বীকার করার বিষয়টা হচ্ছে- আসলে তিনি নেতৃত্ব দিতে পারেন নি। আসলে তার নেতৃত্বের অভাবের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। করোনাভাইরাস নিয়ে যে ধরনের নেতৃত্ব দেয়ার দরকার ছিল তিনি সেটা দিতে পারেন নি বা দিতে চান নি।

এরআগেও কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। যেমন ধরুন হোয়াইট হাউজে একটা প্যানডেমিক অফিস ছিল। সেটা করা হয়েছিল সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার সময়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর সেটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে হোয়াইট হাউজের কাছে করোনাভাইরাস সম্পর্কে কোনো তথ্য ছিল না এবং তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করে নি। 

Image Caption

পাশাপাশি সিডিসি'র (Centers for Disease Control and Prevention) যে দায়িত্ব ছিল সেক্ষেত্রেও বড় রকমের ব্যত্যয় হয়েছে। যখন প্রথমে কিট তৈরি হয় এবং পাঠানো হয়, দেখা গেছে সেগুলো ছিল ক্রটিপূর্ণ। সেগুলো ফেরত এসেছে। তারপর যত দ্রুত কাজ করা দরকার ছিল বা যে প্রস্তুতি দরকার ছিল সেটাও তারা করতে পারে নি। তাছাড়া, 'CDC' র বাজেটেও ঘাটতি আছে। গত বছরগুলোতে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, infectious disease'র জন্য ট্রাম্প প্রশাসন বরাদ্দ কমিয়েছে। এ সবকিছু মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রায় তিন মাসের মতো সময় পাওয়ার পরও ট্রাম্প প্রশাসন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার এ ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ নেয় নি, নেতৃত্ব দেয় নি,বরাদ্দ করে নি এবং যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল তা নেয় নি। তারই ফলে আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি যে, করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে।

রেডিও তেহরান: জ্বি অধ্যাপক আলী রিয়াজ, আপনি করোনা মোকাবেলায় মার্কিন সরকারের বা ট্রাম্প প্রশাসনের উদাসীনতার কথা বললেন। তো ট্রাম্প প্রশাসনের এই উদাসীনতা এবং ব্যর্থতাকে আমেরিকার জনগণ কীভাবে দেখছে? 

অধ্যাপক আলী রিয়াজ: দেখুন, এ বিষয়টি নিয়ে প্রবল বিতর্ক হচ্ছে। সাধারণভাবে যেটা আলোচনার মধ্যে আসছে সেটা হচ্ছে, কেন এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো? এবং এখন যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে সেগুলো যথেষ্ট কি না? এসব নিয়েও বিতর্ক আছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প

একটা বিষয় মনে রাখতে হবে- সেটি হচ্ছে যে, মার্কিন সমাজ গত কয়েক বছরে বেশি মাত্রায় polarized হয়ে গেছে। একধরনের মেরুকরণ ঘটেছে। যে কারণে দেখা যাচ্ছে- প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমর্থক যারা তারা মনে করছেন যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে দোষ দেয়া যাবে না, তিনি  যা করছেন- ঠিক করছেন; প্রেসিডেন্ট সঠিক নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ক্ষেত্র বিশেষে তারা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রাপ্ত তথ্যকেও চ্যালেঞ্জ করছেন। ট্রাম্পের সমর্থকদের একটা অংশের মধ্যে এ ধরণের প্রবণতা দীর্ঘ দিন ধরে রয়েছে। তারা বিজ্ঞানকে অস্বীকার করেছে। শুধু তার সমর্থকরাই নয়; এমনকি আমরা মি. ট্রাম্পের মধ্যেও লক্ষ্য করেছি। তারা বলছেন, প্রেসিডেন্ট ঠিকই ছিলেন; এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি হচ্ছে। 

কিন্তু বিতর্কটা এতটাই প্রকট যে, বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সমাজে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। মার্কিন সমাজের প্রশ্ন- করোনাভাইরাস নিয়ে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছে শুধুমাত্র আশুবিবেচনায় নয় আসলে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ তৈরি হয়েছে বা প্রশ্নটি উঠছে যে, আসলে কেন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটা দেশের এইরকম একটি পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য সামান্য প্রস্তুতিও ছিল না!

রেডিও তেহরান: জ্বি আপনি যেমনটি বললেন, আমেরিকার মতো উন্নত দেশ, তারপরও তারা কেন করোনা মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে? এর প্রধান প্রধান ঘাটতি কী সে সম্পর্কেও আপনার আলোচনায় উঠে এসেছে। একটা বিষয় আমরা শুনতে পাচ্ছি- করোনা সংকটকে কেন্দ্র করে সেখানে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন আশংকায় লোকজন বন্দুক কেনা বাড়িয়ে দিয়েছে। বন্দুক কিনে কী জনগণ নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে? ওখানকার সমাজব্যবস্থার আলোকে বিষয়টি যদি আপনি একটু ব্যাখ্যা করতেন।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ: মার্কিন সমাজের একাংশের প্রবণতা সবসময় এরকম আছে যে, যেকোনো বিষয়ে একটা সংকট দেখা দিলে তারা মনে করে- দেশে বোধহয় একটা বিশৃংখলা তৈরি হবে। ফলে নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বন্দুক সংগ্রহ করতে হবে। এ প্রবণতা ৯/১১ পরও দেখা গেছে। তাদের ধারণা যে বন্দুক তাদের সুরক্ষা দেবে। কিন্তু এটা কতোটা ঠিক? করোনাভাইরাসের মতো পরিস্থিতির ক্ষেত্রে বন্দুক তাদের কেন এবং কিভাবে রক্ষা করবে? কেন মার্কিন সমাজে এই প্রবণতা? আমি মনে করি দুটো কারণে মার্কিন সমাজে এধরনের প্রবণতা।

এক হচ্ছে- ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা। তাদের ধারণা আমি আমাকে রক্ষা করব। দ্বিতীয়টি হচ্ছে- তাঁরা মনে করে সম্ভবত রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রকে তারা যেভাবে দেখে- সেভাবে। অর্থাৎ ওয়েলফেয়ার স্টেটের ধারণাটা যাদের কাছে স্পষ্ট নয় বা যারা এর বিরোধিতা করেন তাদের মধ্যে এই প্রবণতাটা আছে।

তবে প্রশ্ন হচ্ছে, অধিকাংশ মানুষ কী বন্দুক কিনতে গেছেন? না, অবশ্যই না। অধিকাংশ মানুষ বন্দুক কিনতে যান নি। স্বল্পসংখ্যক মানুষ বন্দুক কিনতে গেছেন। আর এ ধরনের প্রবণতাটা খুবই অগ্রহণযোগ্য একটা প্রবণতা। তবে এটা মার্কিন সমাজে আছে এবং এটাকে উসকে দেয়ার মতো লোকও আছে। এ ধরণের প্রবণতাকে মূলধারার মধ্যে আনার চেষ্টাও আছে। বিশেষ করে ‘এনআরে’র মতো প্রতিষ্ঠান আছে যারা এগুলোতে একধরণের উৎসাহ তৈরি করে। আর এগুলো খুব বিপজ্জনক প্রবণতা। তবে মার্কিন সমাজে এটা আছে।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আলী রিয়াজ আপনি সাংবাদিক, একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক। আপনার কাছে সবশেষে যে বিষয়টি জানতে চাইব সেটি হচ্ছে- করোনাভাইরাসের মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পরও মার্কিন সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শত্রুতাপূর্ণ আচরণ করে যাচ্ছে। যেমন ইরানের ওপর থেকে তাদের একতরফা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার না করে বরং নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন?

ইরানের উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত

অধ্যাপক আলী রিয়াজ: দেখুন, ইরানের ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসন বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের এখনকার নীতিমালার সঙ্গে আমি একমত নই। বিশেষ করে যখন ইরানের সঙ্গে করা নিউক্লিয়ার এগ্রিমেন্ট থেকে বেরিয়ে এসেছে আমেরিকা তখন থেকেই আমি এটার সাথে ভিন্নমত পোষণ করি এবং সমালোচনা করেছি। এখনও ইরানের ব্যাপারে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হচ্ছে বিশেষ করে যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে সেগুলোর ব্যাপারে আমি ভিন্নমত পোষণ করি। বরং এখন নিষেধাজ্ঞা আরও শিথিল করা দরকার। বিশেষ করে ওষুধপত্রের ক্ষেত্রে। ওষুধপত্র সরবরাহ করার ক্ষেত্রে যেসব দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে আমি মনে করি তা অবিলম্বে বাতিল অথবা শিথিল করা দরকার। আসলে ট্রাম্প প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গিটা হচ্ছে- ইরানের অভ্যন্তরে এরকম একটা পরিস্থিতি তৈরি হলে তাদের সরকারের ওপর জনগণের চাপ বাড়বে এবং দেশটির সরকার একধরণের বিব্রতকর বা বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে পড়বে। 

কিন্তু এগুলো খুব বিপজ্জনক এই কারণে যে, এখনকার পরিস্থিতি অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন। প্যানডেমিক তো কোনো সীমান্তের মধ্যে থাকবে না। ফলে ইরানে যেভাবে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে তাতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেটা মোকাবেলা করা খুব দুরূহ হবে। আর সেকারণেই মার্কিন প্রশাসনের ইরানের বিরুদ্ধে এ ধরণের সিদ্ধান্ত। বিশেষ করে ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরো কড়াকড়ি করার বিষয়ের আমি ঘোরতর সমালোচক।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আলী রিয়াজ  আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি রেডিও তেহরানকে সময় দেয়ার জন্য।

অধ্যাপক আলী রিয়াজ: ধন্যবাদ আপনাকেও ।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১

ট্যাগ