এপ্রিল ১২, ২০২০ ১৬:৪৬ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী, কবি, লেখক, চিন্তাবিদ ও সুশাসক আমির আলীশির নাওয়ায়ি'র জীবন, চিন্তাধারা এবং তার অবদান সম্পর্কে আলোচনা করব।

সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রেমিক বিশিষ্ট কবি এবং তৈমুরি-যুগের বিশিষ্ট সুশাসক বা মন্ত্রী  আমির আলীশির নাওয়ায়ি শিল্পী-সাহিত্যিক, গুণী ও পণ্ডিতদের সব ধরনের সহযোগিতা করতেন। তৈমুরি যুগের ইরানি শিল্প ও সাহিত্যের ইতিহাসে শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আর কেউই যদি কোনো গুরুত্ব না-ও দিতেন তাহলেও এক্ষেত্রে কেবল আলীশির নাওয়ায়ির সক্রিয় উপস্থিতি ও পৃষ্ঠপোষকতাই ইরানের এ অঙ্গনকে সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় উপহার দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল বলে মনে করা যায়।

আমির আলীশির নাওয়ায়ি শিল্প ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব শাখার গুণীদের সরাসরি সহযোগিতা করতেন। শিল্পী-সাহিত্যিক, কবি ও গুণীদের প্রতিভার বিকাশ ঘটানো এবং তাদের মাধ্যমে সৃষ্টিশীল শিল্প-কর্ম গড়ে তোলার জন্য যা যা দরকার তার সব কিছুরই ব্যবস্থা করতেন বা এ জন্য উপযুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতি গড়ে তুলতেন তিনি। কবি জামি কিংবা বাহযাদ এবং ওয়ায়েজ কাশেফির মত পণ্ডিত ও গুণী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আলীশির নাওয়ায়ির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযোগিতার  সম্পর্ক থাকার কারণেই তারা এত বেশি খ্যাতির অধিকারী হতে পেরেছিলেন। একইসঙ্গে তাদের সৃষ্টিশীলতা ও নানা গুণের বিকাশও  আলীশির নাওয়ায়ির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও সহযোগিতার কাছে ঋণী।

আমির আলীশির নাওয়ায়ি ছিলেন চিত্র-শিল্পের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক। এই শিল্পের প্রতি তার বিশেষ গুরুত্ব ও দৃষ্টির কারণে সে যুগের চিত্র-শিল্প ও বইয়ের চিত্রকলা-শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছিল এবং এই শিল্পের গুণী আর পণ্ডিতরা সর্বোচ্চ খ্যাতির অধিকারী হতে পেরেছিলেন। হেরাতের যেসব চিত্রশিল্পী প্রথম দিকেই আলীশির নাওয়ায়ির সুদৃষ্টি ও সহযোগিতা পেতে সক্ষম হয়েছিলেন সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ মিরাক তাদের অন্যতম। তিনি সুলতান হুসাইনের লাইব্রেরির পরিচালক ছিলেন। বইয়ের সাজ-সজ্জা ও চিত্রকলা ছাড়াও সুন্দর হস্তাক্ষরের লিখন-শিল্প, খোদাই-করা লিপি-শিল্প ও ক্যালিওগ্রাফিতেও অসাধারণ দক্ষ ছিলেন রুহুল্লাহ মিরাক। সুলতান হুসাইন বয়কারোর আমলে প্রাচীন ইরানের খোরাসান প্রদেশের অংশ হিসেবে খ্যাত হেরাতের বেশিরভাগ প্রাসাদের মধ্যে অঙ্কিত বা খোদাই-করা লেখনীগুলো  সাইয়্যেদ রুহুল্লাহ মিরাকেরই অনন্য শিল্প-কর্ম।

হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী ও প্রশাসক আমির আলীশির নাওয়ায়ির মদদে দক্ষ ও খ্যাতিমান হয়ে-ওঠা আরেকজন চিত্রশিল্পী হলেন কামালউদ্দিন বেহজাদ। বেহজাদ ছিলেন হিজরি নবম শতকের শ্রেষ্ঠ ও ইরানের ইতিহাসের শীর্ষস্থানীয় চিত্রশিল্পী। সুলতান হুসাইন বয়কারো'র দরবারে চিত্র-শিল্পের বিকাশ ও ব্যাপক চর্চার প্রধান কারিগর ছিলেন এই মহান শিল্পী এবং হেরাতে এ শিল্পের বিকাশ অনেকাংশেই আমির আলীশির নাওয়ায়ির কাছে ঋণী। আলীশিরের সহায়তা ও উৎসাহের ফলেই এ শিল্পের ক্ষেত্রে নিজ প্রতিভা ও সৃষ্টিশীলতার সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটাতে পেরেছিলেন কামালউদ্দিন বেহজাদ। তিনি এক্ষেত্রে  আলীশির নাওয়ায়ি ও সুলতান হুসাইন বয়কারো'র লাইব্রেরিগুলোও ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং চিত্রাঙ্কন শিল্পে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। কামালউদ্দিন বেহজাদ জন্ম নিয়েছিলেন হিজরি ৮৫৪ থেকে ৮৬৪ সালের মধ্যে কোনো এক বছরে। তার সঠিক জন্ম-তারিখ ও জন্মের সন নির্ধারণ নিয়ে বর্ণনাকারীদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।

বাহজাদ শৈশবেই বাবা-মাকে হারিয়েছিলেন। আমির রুহুল্লাহ মিরাক হন তার অভিভাবক। আমির রুহুল্লাহ ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। মিরাক ছিলেন সুলতান হুসাইন বয়কারোর পাঠাগারের ও বইয়ের নক্সা, বাধাই বা সাজ-সজ্জা সংক্রান্ত কারখানার প্রধান। তাই চিত্রশিল্প বা নক্সা করার আর্ট সম্পর্কে শৈশবেই অভিজ্ঞতা হয়েছিল বেহজাদের। তিনি হেরাতেই তার শিল্প তৎপরতা শুরু করেন এবং বড় মাপের শিল্পীদের সান্নিধ্য পান। তার প্রধান উৎসাহদাতা ছিলেন আমির আলীশির নাওয়ায়ি। তিনিই বেহজাদের মধ্যে প্রতিভার আলো দেখতে পেয়ে তাকে সুলতানের কাছে পরিচয় করিয়ে দেন। ফলে বেহজাদ সুলতানের পৃষ্ঠপোষকতা ও সাহায্য পেতে থাকেন। আমির আলীশির নাওয়ায়ি নিজেও ছিলেন বড় মাপের চিত্রশিল্পী ও এ শিল্পের গভীর অনুরাগী। সে যুগের বড় বড় ইঞ্জিনিয়ার ও চিত্রশিল্পীরা তারই উৎসাহ, মদদ আর গাইড পেয়ে এ শিল্পকলা শিখতেন বলে খ'ন্দমির তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন।  যাই হোক রুহুল্লাহ মিরাক ছাড়াও চিত্রশিল্পে কামালউদ্দিন বেহজাদের অন্যতম শিক্ষক ছিলেন সাইয়্যেদ আহমাদ তাবরিজি। আমির আলীশির নাওয়ায়ি ও সুলতান বয়কারোর দরবারে বেহজাদের ছিল বিশেষ অবস্থান।

হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী ও প্রশাসক আমির আলীশির নাওয়ায়ি শিল্পী, জ্ঞানী-গুণী ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে মাঝে-মধ্যে জ্ঞানগত বিতর্কের আসর জমাতেন। একবার এমনই এক আসরে বেহজাদ তার একটি চিত্র-শিল্পের নমুনা নিয়ে আসেন। বোর্ডে আঁকা ওই ছবিতে ছিল ফুল আর গাছপালায় ভরপুর সুরম্য উদ্যান, সুকণ্ঠী পাখি, ঝর্ণা ও স্রোতস্বিনী...। বেহজাদ বোর্ডটি উৎসর্গ করেন আলীশিরের কাছে। তিনি এই ছবিটি সম্পর্কে উপস্থিত বিশেষজ্ঞদের মতামত জানতে চান। সবাই ছবিটির সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করেন এবং তারা বলেন যে বেহজাদের এ চিত্র-শিল্পটি যেন এক জীবন্ত ও বাস্তব উদ্যানের প্রতিরূপ।

হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী ও প্রশাসক আমির আলীশির নাওয়ায়ি হেরাতের চিত্র-শিল্প ধারার বিকাশে ব্যাপক অবদান রেখেছিলেন। আমির আলীশিরের গুণগ্রাহীতা আর শিল্পী ও শিল্প-প্রেমের খ্যাতি শুনে বহু শিল্পী হেরাতে আসতেন এবং এখানে এই মহান শাসক ও  উদার ব্যক্তিত্বের সর্বাত্মক মদদের ছায়াতলে সচ্ছন্দ্যে ও নির্ঝঞ্জাটে শিল্প-চর্চা করতেন। শাহ মুজাফফর, কাসেম আলী চেহরেগোশা, হাজি মোহাম্মাদ নাক্কাশ, মোল্লা ইয়ারি ও মোল্লা দারভিশ মোহাম্মদের মত বিখ্যাত চিত্রশিল্পীরা গড়ে উঠেছিলেন আমির আলীশির নাওয়ায়ির তত্ত্বাবধানেই।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।