এপ্রিল ১৪, ২০২০ ২০:৪৮ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা গিয়েছিলাম ইরানের আরেকটি নামকরা প্রদেশ কোহগিলুয়ে ও বুয়ের আহমাদের দিকে। এই প্রদেশের প্রধান শহর ইয়াসুজ শহর দেখার পর গিয়েছিলাম সি-সাখত শহরের দিকে। প্রকৃতিপ্রেমি ভ্রামনিকদের বেহেশত খ্যাত সি-সাখত শহর। সি-সাখত নামকরণের পেছনের গল্পটিও শুনিয়েছিলাম আপনাদের। সি-সাখত হলো দেনা উপত্যকার প্রধান শহর। চেশমে মিশি ঝরনা,বিজান গার্দানে দেখার পর তুফ এবং তগি ঝরনাও দেখেছি আমরা।

দাশতাক নামের একটি ফরেস্ট এলাকাও রয়েছে এখানে। সি-সাখত শহর থেকে পশ্চিম দিকে দেনা উপত্যকায় এটি অবস্থিত। আমরা আরও দেখেছি এখানকার কূহগোল হ্রদ। এ অঞ্চলের পর্যটক আকর্ষণীয় একটি স্পট হলো কূহগোল হ্রদ। এই এলাকার সৌন্দর্যে যে-কেউই বিমোহিত না হয়ে পারে না। সে কারণেই মোটামুটি সারা বছর ধরেই এখানে পর্যটকদের আনাগোণা লেগেই থাকে। এইসব হ্রদ কূহগোল সবুজ শ্যামল অঞ্চলের বেশ উঁচুতে অবস্থিত। এ কারণে শীতকালের বৃষ্টি কিংবা তুষারপাতে তো বটেই বিশেষ করে বসন্তেও হ্রদগুলো জলটৈটুম্বুর থাকে। তবে অন্য ঋতুতে সাধারণত শুকনো থাকে হ্রদ। এই হ্রদগুলোর সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে যেতে হবে সি-সাখত থেকে অন্তত আট কিলোমিটার উত্তর দিকে দেনা উপত্যকার উচ্চতায়। আকাশের আয়নার মতো স্থবির অচল স্বচ্ছ এই হ্রদগুলোতে বরফাচ্ছাদিত পর্বতশৃঙ্গের সৌন্দর্য চিত্রের মতো মনে হয়।

হ্রদের বিশাল আয়নায় ওই দৃশ্য দেখলে চোখ আটকে যেতে বাধ্য। আর এই চিত্রটি যদি হয় বসন্তের তাহলে তো আর কথাই নেই। আপনার মন সায় দেবে না এরকম সুন্দর এবং উপভোগ্য আবহাওয়াময় কূহগোল এলাকা ছেড়ে অন্য কোনোদিকে যেতে। কিন্তু তারপরও যেতে তো হবেই। এক জায়গায় থেমে থাকলে তো চলবে না। ঘুরতে হবে ফিরতে হবে দেখতে হবে আরও যা যা আছে এই অপূর্ব সুন্দর এলাকায়। এখানে ঝরনা আছে, আছে পর্বতচূড়া এবং প্রান্তরও। দেখতে দেখতে উপলব্ধি করতে হবে এগুলোর শৈল্পিক সৌন্দর্য। ঝরনার প্রসঙ্গ উঠতেই মনে পড়ে গেল 'নারী' ঝরনার সৌন্দর্যের কথা। প্রকৃতপক্ষে এই ঝরনাটি শহরের সবচেয়ে সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠতম ঝরনা। দেনা' নামক সংরক্ষিত এলাকায় এই ঝরনাটির অবস্থান।

এই দেনা' অঞ্চলে বিরল প্রজাতির প্রাণী যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে দুর্লভ কিছু উদ্ভিদও। ইরানের ইকো-ট্যুরিজম অঞ্চলগুলোর মধ্যে এই এলাকাটি একেবারেই নজিরবিহীন। বিরল প্রজাতির কিছু পাখিও আছে এখানে দেখার মতো যেমন হোমা। হোমা এক জাতীয় ঈগল পাখি। দক্ষিণ ইউরোপ, আফ্রিকা এবং ইরানসহ এশিয়ার কোনো কোনো দেশে বিরল প্রজাতির এই ঈগল দেখতে পাওয়া যায়। ইরানের বন্দরআব্বাসের গেনু এবং এই দেনা অঞ্চলেও প্রচুর দেখতে পাওয়া এ জাতের পাখি। এ ধরনের শিকারী পাখিগুলো সাধারণত হাঁড় খায়। রিল্যাক্স মুডে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে আরাম আয়েশের সঙ্গে এগুলো আকাশে ওড়ে। বছরজুড়ে এরা এক জায়গাতেই বসবাস করে এবং শীতের মাঝামাঝিতে বছরে একবারই ডিম পাড়ে-একটা কি দুটো, এর বেশি নয়। বসন্তের শুরুর দিকে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়।

ফার্সিতে চাকোবাক নামে আরেক ধরনের পাখি রয়েছে এই দেনা পার্বত্য অঞ্চলে। ইংরেজিতে বলে লার্ক্। দেখতে অনেকটা বাংলাদেশের চড়ুই পাখির মতো তবে একটু সাইজে বড়। আরেক জাতের পাখিও আছে এখানে। এগুলোকে ফার্সিতে বলে 'সাং চেশ্‌ম' মানে পাথর চোখ। ইংরেজিতে বলে শ্রাইক বার্ড। এগুলো প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। বেজি কিংবা নেউল, ভোঁদড়  বা উদ্বিড়াল এবং স্কুইরেল বা কাঠবেড়িালি জাতীয় ছোটো প্রাণীগুলোও ব্যাপক পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায় এই এলাকায়। এগুলোর লেজের সৌন্দর্যের কারণে এখানকার প্রাণীগুলোকে বলা হয়ে থাকে এ প্রজাতির পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর প্রাণী।

সংরক্ষিত এই এলাকাটি ছাড়াও সি-সাখতের উত্তর-পশ্চিমে একটি সুন্দর প্রান্তর রয়েছে যে প্রান্তরে দেখতে পাওয়া যাবে বিচিত্র উদ্ভিদ, বৃক্ষ, ফুল আর সবুজ তৃণের গালিচা। গাছের মধ্যে রয়েছে সারি সারি ওক গাছসহ আরও অন্যান্য প্রজাতির গাছও।

এবারে একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসা যাক। যেহেতু আমাদের হাতে খুব বেশি সময় নেই। শেষ করার আগে এই এলাকার ঐতিহাসিক প্রসঙ্গে সংক্ষিপ্ত নজর বুলানো যাক। সি-সাখত শহরে প্রচুর পরিমাণ ঐতিহাসিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। পুরাতত্ত্ববিদদের গবেষণা অনুযায়ী 'তালে-এস্পিদ' নামক প্রাচীন একটি টিলার ওপর বেশ কিছু পুরোনো তৈজস এবং ব্যবহার্য জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে খ্রিষ্টপূর্ব এক হাজার বছর আগের মানে এইলামি শাসনামল থেকে শুরু করে হাখামানেশিয়, সাসানীয় এবং এমনকি সাফাভি ও কাজারি যুগের নিদর্শন এগুলো। উদাহরণ হিসেবে আবিষ্কৃত কিছু চমৎকার কলসির কথা বলা যেতে পারে। এগুলোর সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র এমনকি নিকেল কাজ অনন্য সাধারণ।

'তালে গালত' নামে একটি টিলা আবিষ্কৃত হয়েছে এ এলাকায়। এখানে রয়েছে বিশাল একটি পাথুরে জায়গা। সি-সাখত শহরের ভেতরেই রয়েছে এই অঙ্গনটি। এই জায়গাটি ইরানে ইসলাম প্রবেশের পরবর্তীকালের মানে সালজুকি শাসনামল থেকে কাজারি শাসনামল পর্যন্ত সময়কার বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এই দুটি টিলাই মানে তালে-স্পিদ এবং তালে গালত ইরানের জাতীয় নিদর্শনের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তালে-স্পিদ নামক গ্রামে একটি শিলালিপিও আবিষ্কৃত হয়েছে যার আয়তন হলো দৈর্ঘে ছেচল্লিশ আর প্রস্থে বায়ান্ন সেন্টিমিটার। 'পতা'ভে' নামের একটি প্রাচীন ব্রিজও রয়েছে এখানে দেখার মতো। বাশরের তুগিয়ন নদীর প্রভাবে এর কিছু কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গেলেও অস্তিত্ব টিকে আছে আজও। সাসানি আমলের বাদশারা এই ব্রিজ অতিক্রম করতেন। সুতরাং ভেবেও নেয়া যেতে পারে এই ব্রিজের সৌন্দর্যের বিষয়টি। পাথর শিল্পী এবং পাথরের ডিজাইনে কতোটা পটু ছিল তখনকার দিনের শিল্পীরা-এই ব্রিজটি তার সামান্য উদাহরণ। ব্রিজটি অবশ্য পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ