মে ০৬, ২০২০ ১৪:১৭ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা ইরানের নামকরা প্রদেশ কোহগিলুয়ে ও বুয়ের আহমাদ ভ্রমণ শেষ করেছিলাম। এই প্রদেশের প্রধান শহর ইয়াসুজ শহর দেখার পর গিয়েছিলাম সি-সাখত শহরের দিকে। প্রকৃতিপ্রেমি ভ্রামনিকদের বেহেশত খ্যাত সি-সাখত শহর। সি-সাখত নামকরণের পেছনের গল্পটিও শুনিয়েছিলাম আপনাদের। সি-সাখত হলো দেনা উপত্যকার প্রধান শহর। চেশমে মিশি ঝরনা,বিজান গার্দানে দেখার পর তুফ এবং তগি ঝরনাও দেখেছি আমরা।

যাই হোক আজ আমরা যাবো নতুন আরেকটি প্রদেশের দিকে। এই প্রদেশটির নাম চহর মাহলে বাখতিয়রি। ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় এই প্রদেশটি জাগরোস পর্বতমালার পাশেই অবস্থিত। এই প্রদেশটি ইরানের সুন্দরতম এলাকাগুলোর একটি। চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশ এবং তার আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন। অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি কয়েক হাজার বছরের পুরণো এতোসব নিদর্শনে সমৃদ্ধ যে মনে হয় যেন অচেনা এক গুপ্তধন ভাণ্ডার এই প্রদেশ। চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহরের নাম হলো কোর্দ। এই শহরটি ইরানের শীতপ্রধান এলাকাগুলোর একটি। গুরুত্বপূর্ণ এই এলাকাটি পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে শুরু করবো চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশ ভ্রমণ।

বলছিলাম চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহরের নাম হলো কোর্দ। এই শহরটি ইরানের শীতপ্রধান এলাকাগুলোর একটি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই শহরের উচ্চতা দুই হাজার ছেষট্টি মিটার উঁচুতে হওয়ায় কোর্দকে বলা হয় 'ইরানের ছাদ'। এই কোর্দ শহরেরই একটি প্রাচীন এলাকার নাম হলো 'হাফশেনজান'। মানববসতির সবচেয়ে প্রাচীন একটি এলাকা হিসেবে এই হাফশেনজানের নামও পরিচিতি লাভ করেছে। ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন, পর্যটন আকর্ষণীয় বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনাসহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অসংখ্য নিদর্শনে ভরপুর এই এলাকাটি। পাথরের বিভিন্ন সরঞ্জাম ও প্রাচীন মৃৎপাত্র যেসব এখানকার পুরোনো টিলার ওপর থেকে এবং কোর্দ শহর থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঐতিহাসিক হাফশেনজান শহরে যেসব প্রাচীন নিদর্শন প্রাথমিকভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো নিয়ে গবেষণা চালিয়ে ইতিহাসবিদরা বলেছেন এই শহরটির প্রাচীনত্ব খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম সহস্রাব্দে গিয়ে পৌঁছায়।

তার মানে দাঁড়ায় চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশটি নয় হাজার বছরের পুরোণো। জাগরোস পর্বতমালার চূড়ার উচ্চতায় বরফের স্তুপ জমে জমে গ্রীষ্মে সেগুলো গলতে শুরু করে। বরফ গলা সেই জলের প্রবহমান ঝরনাধারায় সৃষ্টি হয়েছে ইরানের কেন্দ্রিয় ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় সবচেয়ে বড় নদী 'কারুন',  যয়ান্দে রুদ নদী ও দেজ নদীর মতো ইরনের বৃহৎ তিনটি নদী। এখানে আরও রয়েছে ওক জঙ্গল, আপেলের মতো দেখতে ছোট ছোট এক ধরনের ফল গাছ যাকে ফার্সি ভাষায় জলজলাক বলে ইংরেজিতে বলা হয় 'হ-থর্ন'(Hawthorn),রয়েছে বড় বড় এবং বিস্তৃত পাতার উদ্ভিদ,অসংখ্য ঝরনা, জলাধার, গুহা, জলটৈটুম্বুর ফোয়ারা, সংরক্ষিত এলাকা, পর্যটন এলাকাসহ প্রাকৃতিক দিক থেকে বিস্ময়কর অনেক নিদর্শন। এখানকার এইসব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশকে বলা হয় পর্যটকদের বেহেশত।

চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশের জনগণকে দুই ভাগে বিভক্ত ভূখণ্ডের অধিবাসী বলে অভিহিত করা যেতে পারে। একটি চহর মাহলের অধিবাসী অপরটি বাখতিয়রির অধিবাসী। চহর মাহলের অধিবাসীদেরকে বলা হয় চহর মাহলি। চহর মাহলিরা সাধারণত ফার্সি, তুর্কি এবং নিজেদের একটা বিশেষ ভাষাভঙ্গিতে কথা বলে। আর বাখতিয়রিরা কথা বলে লোরি ভাষার একটি শাখা বাখতিয়রির ভঙ্গিতে। বাখতিয়রি এলাকাটিতে সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাখতিয়রি উপজাতীয়দের অধিবাস ছিল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই এলাকায় রয়েছে ঐতিহাসিক বহু ঘরবাড়িও। আমরা বরং কোর্দ শহরের ঐতিহাসিক কিছু মূল্যবান নিদর্শন এবং এই শহরের আশপাশের কিছু নিদর্শনের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করি।

প্রাচীন কোর্দ শহরের অনেকটা কেন্দ্রেই বলা চলে একটি প্রাচীন মসজিদ রয়েছে। মসজিদটির নাম জামে মসজিদ বা খান মসজিদ। এই মসজিদটি তের শ' হিজরির শেষের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে বলে ইতিহাসে পাওয়া যায়। কোর্দ শহরের ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর অন্তর্ভুক্ত এই মসজিদ স্থাপনাটি। হাজ মুহাম্মাদ রেজা খান সুতুদে'র নির্দেশে এই ঐতিহাসিক মসজিদটি দুই হাজার পাঁচ শ বর্গমিটার জায়গার ওপর নির্মিত হয়েছে।  এই মসজিদের তিনটি প্রধান প্রবেশদ্বার রয়েছে উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিমদিকে। প্রবেশদ্বারগুলোতে সিরামিক কাজের সাতরঙ সৌন্দর্য যে-কোনো দর্শকেরই দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না। মসজিদটির একটি বড়সড়ো আঙ্গিনা রয়েছে। রয়েছে চারটি ঝুলবারান্দা এবং অসংখ্য কামরা। আরও রয়েছে মিনার এবং শাবেস্তান। শাবেস্তানগুলো গ্রীষ্মকাল এবং শীতকালের জন্য উপযোগী করে তৈরি করা হয়েছে। মসজিদটি ১৯৭৭ সালে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে।

জামে মসজিদের কথা বলছিলাম। এই মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিমে একটি হাম্মামখানা বা গোসলখানা রয়েছে। হিজরি ১২৭০ সালে মসজিদ নির্মাণের সময় একইসঙ্গে নির্মাণ করা হয়েছে হাম্মামখানাটি। ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটিও হাজ মুহাম্মাদ রেজা খানের উদ্যোগে নির্মাণ করা হয়েছে। এই স্থাপনার স্থাপত্যশৈলীর বিশেষত্ব ও অনন্য বৈশিষ্ট্য ইতিহাসখ্যাত। কোর্দ শহরের ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শনের মধ্যে অপর একটি নিদর্শন হলো এই শহরের পুরাতত্ত্ব মিউজিয়াম। বহু প্রাচীন নিদর্শনে ভরপুর এই মিউজিয়ামটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশের প্রাচীন নিদর্শন এমনকি নয় হাজার বছরের পুরোণো জিনিসপত্রও এই যাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে। হাড়, পাথরের ছোট-বড় বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং মাটি দিয়ে তৈরি ভাষ্কর্য, মৃৎপাত্র, জ্যামিতিক ফর্মে নির্মিত  কালো রঙের বিভিন্ন তৈজস, বাটি, গ্লাস এমনকি নব্য প্রস্তরযুগের বহু নিদর্শন এই যাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

এইসব নিদর্শনের টেকনিক দেখলেই বোঝা যায় সেই প্রাচীন আমলেও ইরানি শিল্পীরা কতোটা নিপুণ ও দক্ষ ছিল। হাখামানেশিয় যুগের লিপিকর্মেরও নিদর্শন রয়েছে এই যাদুঘরে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ