চহর মাহলে বাখতিয়রি ইরানের একটি রূপকথার শহর
বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। গত আসরে আমরা ইরানের নামকরা প্রদেশ চহর মাহলে বাখতিয়রির কয়েকটি শহর ঘুরে ঘুরে দেখেছি।
সবশেষে গিয়েছিলাম কোর্দ শহরের দিকে। সেখানকার কয়েকটি ঐতিহাসিক ও মূল্যবান স্থাপনা এবং নিদর্শনের সঙ্গে খানিকটা পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি। জাগরোস পর্বতমালা পরিবেষ্টিত চহর মাহলে বাখতিয়রির গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর 'সামান'।
ঐতিহাসিক এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই সামান শহরটি কোর্দ শহর থেকে বাইশ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ছোট্ট একটি শহর, তবে চমৎকার এই শহরের আবহাওয়া। শহর ছোট হলেও বিখ্যাত অনেক কবি সাহিত্যিকের জন্ম এই শহরেই হয়েছে। ঐতিহাসিক 'জামান খান' ব্রিজ বহমান জলের ধারাময় যয়ান্দে রুদ নদীর দুই তীরকে সংযুক্ত করেছে। সামান শহরের কাছে চমৎকার আবহাওয়াময় একটি মনোরম পরিবেশে এবং ফুল-ফলের উদ্যানময় প্রাকৃতিক অপার সুন্দর এলাকায় অবস্থানের কারণে এই এলাকাটি পর্যটক আকর্ষণীয় একটি স্পটে পরিণত হয়েছে। চরমাহলে বখতিয়রি প্রদেশের এই অঞ্চলটি একটি রিসর্ট বা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। সেজন্যই দেশি বিদেশী ভ্রমণকারীরা ঐতিহাসিক এই সেতুটি দেখতে এবং এর আশেপাশের অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতি উপভোগ করতে এ এলাকা ভ্রমণে আসে।
চহর মাহলে বাখতিয়রি ইরানের একটি রূপকথার শহর। এখানে রয়েছে লোক সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। লোকসাহিত্য বিষয়টা একটু ভিন্নরকম মনে হচ্ছে? হ্যাঁ বলছি। মৌখিক ধারার সাহিত্য যা অতীত ঐতিহ্য ও বর্তমান অভিজ্ঞতাকে আশ্রয় করে রচিত হয় সেটাই লোকসাহিত্য। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে একটি সংহত সমাজমানস থেকে এর উদ্ভব। সাধারণত অক্ষরজ্ঞানহীন পল্লিবাসীরা স্মৃতি ও শ্রুতির ওপর নির্ভর করে এর লালন করে। মূলে ব্যক্তিবিশেষের রচনা হলেও সমষ্টির চর্চায় তা পুষ্টি ও পরিপক্কতা লাভ করে। এজন্য লোকসাহিত্য সমষ্টির ঐতিহ্য, আবেগ, চিন্তা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে। বিষয়, ভাষা ও রীতির ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারাই এতে অনুসৃত হয়। কল্পনাশক্তি, উদ্ভাবন-ক্ষমতা ও পরিশীলিত চিন্তার অভাব থাকলেও লোকসাহিত্যে শিল্পসৌন্দর্য, রস ও আনন্দবোধের অভাব থাকে না। লোকসাহিত্য লোকসংস্কৃতির একটি জীবন্ত ধারা। এর মধ্য দিয়ে জাতির আত্মার স্পন্দন শোনা যায়।

চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশটির একটি অংশে হাফত লাঙ নামক বাখতিয়রি উপজাতিদের একটি গোত্র বসবাস করত। ইরানে বহু উপজাতীয় গোত্র রয়েছে। বাখতিয়রি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গোত্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। বর্ণগত দিক থেকে বাখতিয়রি উপজাতিটি অনেকটাই লোরদের মতো। তাদের ভাষাভঙ্গিও ফার্সি ভাষার সবচেয়ে প্রাচীন এবং পরিচিত ভাষাভঙ্গির মতো সমৃদ্ধ। একদল নৃতাত্ত্বিক এবং গবেষকদের মতে এই বাখতিয়রি গোত্রটির উৎপত্তিস্থল হলো ইরান। তার মানে অন্য কোনো ভূখণ্ড থেকে আসে নি তারা। ইরানের মাটিতেই তাদের জন্ম এবং বিকাশ হয়েছে। এই গবেষকদল এবং নৃতাত্ত্বিকগণের দাবির পক্ষে প্রমাণ হলো কিছু তথ্যপঞ্জি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং আচার আচরণ ও ভাষাগত ঐতিহ্য।
বাখতিয়রি উপজাতিদের প্রসঙ্গ যেহেতু এলোই সেহেতু তাদের সম্পর্কে একটু জেনে নেয়া যাক। বাখতিয়রি বা লোর বাখতিয়রি জাতিকে ইরানের একটি উপজাতি হিসেবেই গণ্য করা হয়। এরা চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় ইরানের কোহগিলুয়ে ওয়া বুয়ের আহমাদ প্রদেশ, খুজিস্তান প্রদেশ, লোরেস্তান প্রদেশ, ইস্ফাহান প্রদেশ এবং কেন্দ্রিয় প্রদেশে বসবাস করে। বাখতিয়দের ভাষা হলো 'বাখতিয়রি'। এই ভাষাভঙ্গিটি লোরি ভাষাভঙ্গিলোরই একটি। এই ভাষাতেই বাখতিয়রি উপজাতিরা কথা বলে।বাখতিয়রি উপজাতিদেরকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় মানে তাদের দুটো প্রধান শাখা রয়েছে। একটি হলো চহর লাঙ বাখতিয়রি শাখা অপরটি হাফত লাঙ বাখতিয়রি শাখা।
তো উভয় শাখারই রয়েছে নিজস্ব কিছু সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আচার প্রথা এবং কৃষ্টি কালচার। তাদের ওইসব আচার বা কৃষ্টি কালচার পুরো বাখতিয়রি অধ্যুষিত এলাকার প্রধান আকর্ষণ।তাদের বিচিত্র সাংস্কৃতিক আয়োজনের ফলে এই এলাকার প্রতি মানুষ আকৃষ্ট হয়। বাখতিয়রি এলাকাটিও প্রাচীনকাল থেকেই বাখতিয়রি উপজাতীয়দের ঋতুভিত্তিক আশ্রয়স্থল ছিল এবং এখনও আছে।সমগ্র এলাকাটির মধ্যে যেসব শহর উপশহর পড়ে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে কূহরাঙ উপশহর, ফারসান, আরদেশ এবং লোরদেগন উপশহর। সবগুলো শহরই চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত।
সমগ্র বাখতিয়রি উপজাতিদের ঐতিহ্য ও বিচিত্র সংস্কৃতি এবং তাদের নির্দিষ্ট এক ধরনের জীবন যাপন পদ্ধতিই নজিরবিহীন মানে বিরল এক আকর্ষণ। চোখে পড়ার মতো দৃষ্টান্ত স্থানীয় ওইসব আকর্ষণের কারণে এই এলাকাটি উপজাতি অধ্যুষিত অন্যান্য এলাকার চেয়ে একটু আলাদা। উপজাতীয়দের জীবন যাপন পদ্ধতি, তাদের বাড়িঘর দুয়ার এবং বসবাসের আদর্শ, তাদের বিশেষ নিয়ম কানুন ও আচার প্রথা সবই দেশি বিদেশি ভ্রমণকারীদের কিংবা পরিদর্শনকারীদের ভালো লাগার প্রধান কারণ। এদের সংস্কৃতি দেখার জন্য এবং উপভোগ করার জন্য ভ্রমণকারীরা উৎসুক থাকেন। সময় সুযোগ পেলে আপনিও ঘুরে ফিরে দেখে আসতে ভুলবেন না আশা করি।
পরবর্তী আসরেও আপনাদের আমন্ত্রণ রইলো। কেননা সেই আসরেও বাখতিয়রি উপজাতীয়দের সঙ্গে আপনাদের আরও বেশি পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো। বিশেষ করে জাগরোস পর্বতের উচ্চতায় কী করে এই উপজাতীয়রা অবাক করা রাস্তা দিয়ে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যাতায়াত করে সে বিষয়ে নজর দেওয়া হবে। আশা করি আপনাদের ভ্রমণ পিপাসা পূরণ করতে কিছুটা হলেও সহযোগিতা হবে।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ০১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।