ইরান ভ্রমণ : ( শেষ পর্ব-১২৬)
বিলকিস শহরের প্রকৃতি
আমরা ইরানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উত্তর খোরাসান প্রদেশে বেড়াচ্ছি। গত আসরে আমরা গিয়েছিলাম উত্তর খোরাাসন প্রদেশের এসপারায়েন শহরের দিকে। শহরটির কথা নিশ্চয়ই মনে আছে আপনাদের।
আর কিছু না হোক অন্তত বচুখেহ কুস্তি বা রেসলিংয়ের কথা তো নিশ্চয়ই মনে আছে। এসপারায়েন শহরের সকল উৎসব, ঈদ আনন্দ কিংবা নওরোজের আনন্দ, বিয়ে-শাদি ইত্যাদি সব অনুষ্ঠানেই গুরুত্বপূর্ণ এবং বলা ভালো প্রধান আকর্ষণ ছিল এই বচুখেহ কুস্তি।
চুখেহ' শব্দটি একটি কুর্দি শব্দ। মানে হলো এক ধরনের খোলা গাউন যা পরে কুস্তিগীররা মঞ্চে প্রবেশ করে। ওই চুখেহ-কে সাদা একটা কাপড় দিয়ে কোমরে বেঁধে রাখে। এই খেলাটা যেহেতু অনেক আগে থেকেই উত্তর খোরাসানের কুর্দি উপজাতিদের মাঝে প্রচলিত ছিল তাই 'কুস্তিয়ে বচুখে' মানে 'চুখেহযুক্ত কুস্তি' নামে পরিচিতি লাভ করে। ফার্সি ভাষায় 'ব' মানে হলো দ্বারা, দিয়ে, সহিত ইত্যাদি। খেলা উপভোগ করার জন্য মহিলাদের আলাদা গ্যালারির ব্যবস্থা করা হয়। বিজয়ী কুস্তিগীরকে বহু রকমের পুরস্কারে ভূষিত করারও নিয়ম প্রচলিত আছে।
এসপারায়েনের ঐতিহাসিক নিদর্শনের অন্যতম হলো 'বিলকিস শহর'। বিখ্যাত এই শহরটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত বিখ্যাত একটি শহর। উত্তর খোরাসান প্রদেশের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে আছে কমপক্ষে চার হাজার বছরের পুরণো এই বিলকিস শহর। এসপারায়েন শহর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত শহরটি। আবাসিক এলাকা হিসেবে পরিচিত বিলকিস শহর সভ্যতার দিক থেকে যে বেশ সমৃদ্ধ হবে তাতে আর সন্দেহ কি! তবে যুগে যুগে বিভিন্ন উপজাতি ও গোত্রীয় যুদ্ধের মুখে পড়ার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে শহরটি। বিলকিস শহরের পরিবেশের দিকে মনোযোগের সঙ্গে তাকালে বোঝা যাবে এই শহরটিতে একটি ইসলামি শহরের সকল বৈশিষ্ট্যই বিধ্যমান রয়েছে। দূর্গ, বাজার, মসজিদসহ সকল স্থাপনাই রয়েছে এই শহরে। বিশেষ করে বিলকিস শহরের প্রাচীন দূর্গটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। কাঁচা ইটের তৈরি হবার কারণেও এর গুরুত্ব অপরিসীম।
ইটের তৈরি এই স্থাপনাটির আয়তন পাঁচ লাখ দশ হাজার বর্গমিটার। একটা সময় বিভিন্ন আকারের উনত্রিশটি টাওয়ার দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। শরেস্তান নামের শহরে আরও অনেক নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়। উদাহরণত কয়েকটির নাম বলা যায়: শেখ অজারির সমাধির নাম প্রথমেই উঠে আসবে। তিনি ছিলেন একজন কবি এবং আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। হিজরির নবম শতাব্দির এই মনীষীর সমাধিটি শরেস্তান শহরের উত্তর অংশে অবস্থিত। এরপর উল্লেখ করতে হয় রাস্তা বাজারের কথা। শহরের মাঝামাঝিতে এই বাজারটি অবস্থিত। বলা যেতে শহরের অর্থণৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র এই রাস্তা বাজার। শহরের দক্ষিণাঞ্চলীয় মিনার টিলা আর উত্তরের অজারির সমাধির মাঝামাঝি স্থানে পড়েছে বাজারটি।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনটি হলো বিখ্যাত মিনার টিলা অঞ্চল। ঐতিহাসিকদের লেখাজোখা, ভূগোলবিদদের অনুসন্ধান আর পুরাতাত্ত্বিকদের গবেষণা থেকে জানা যায় এটা ছিল সম্ভবত ইসলামি যুগের মসজিদের স্থান। এই এলাকার কোনো কোনো স্থানে পুরাতত্ত্ববিদেরা খনন কাজ চালিয়ে বিচিত্র তথ্য পেয়েছেন। এসবের বাইরেও বিলকিস শহরের আরও দুটি স্থাপনার নাম উল্লেখ করতেই হয়। একটি হলো রোবাৎ নামে পরিচিত সরাইখানা। এটি বিলকিস শহরের উত্তর-পশ্চিম অংশে অবস্থিত। অন্যটি ইয়াখদন নামে পরিচিত একটি প্রাচীন কমপ্লেক্স। ঐতিহাসিক এসপারায়েন শহর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত এই কমপ্লেক্স।
বিলকিস শহরে খননকাজ চালানোর ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। শিল্প-সাংস্কৃতিক ওইসব নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে মৃৎশিল্প বিশেষ করে বাসায় ব্যবহৃত নানা তৈজস। মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এবং জলাধারসহ আরও অনেক নিদর্শনও আবিষ্কৃত হয়েছে। বজনুর্দ শহরের পুরাতত্ত্ব বিষয়ক যে যাদুঘরটি রয়েছে ওই যাদুঘরে বিলকিস শহর থেকে আবিষ্কৃত গুরুত্বপূর্ণ সেইসব নিদর্শন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসপারায়েন শহরে রয়েছে বেশ কিছু সুন্দর পার্ক এবং সংরক্ষিত এলাকা। এখানকার ন্যাশনাশ পার্ক তো খুবই নামকরা। আরও রয়েছে চমৎকার আবহাওয়াময় বহু গ্রাম, প্রবহমান ঝর্নাধারা, ফোয়ারা, বিস্ময়কর বহু পার্বত্য গূহা ইত্যাদি। এইসব প্রাকৃতিক নিদর্শন যে কোনো পর্যটককেই আকর্ষণ না করে পারে না।
এখানে অনেক সুন্দর সুন্দর গ্রাম আছে। অন্তত একটি গ্রামের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। গ্রামটির নাম রুয়িন। এসপারায়েন শহর থেকে সাতাশ কিলোমিটার উত্তরে সবুজের সমারোহপূর্ণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব নিদর্শন রুয়িন গ্রামটি অবস্থিত। হাজার বছরের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই গ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপনার পাশাপাশি রয়েছে অনেক বাগ-বাগিচা এবং দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য। যারাই এসপারায়েন শহরে বেড়াতে যায় তারা এই গ্রামটি সফর করতে ভোলে না। সিঁড়ির মতো করে নির্মিত এখানকার বাড়িগুলো দূর থেকে দেখতে চমৎকার লাগে।
একটি বাড়ির উঠোন আরেকটি বাড়ির ছাদ-ভাবুন তো কেমন লাগে। এই গ্রামে রয়েছে বহু কারখানাও। বিশেষ করে তাঁবু তৈরি কিংবা তাঁত শিল্পের অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে এখানে। রুয়িন গ্রামের এসব শিল্পের কোনো কোনোটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাতেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
যাই হোক বন্ধুরা! আজ আর কথা বলার সুযোগ নেই। ইরান ভ্রমণের এ প্রান্তিকের আয়োজনে দীর্ঘ সময় ধরে যারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন, সবাইকে আজকের এই সর্বশেষ পর্ব থেকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ।#
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৪
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।