ভারত-চীন মুখোমুখি: যুদ্ধ হবে কি? যা বললেন খন্দকার মুনীরুজ্জামান
সীমান্তে ভারত-চীনের মধ্যকার উত্তেজনা চীনের একধরনের ব্লাকমেইলিং স্ট্রাটিজি। তবে এ উত্তেজনা বড় যুদ্ধ অর্থাৎ পরমাণু যুদ্ধের পর্যায়ে যাবে বলে মনে হয় না। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন বাংলাদেশের সিনিয়র সংবাদিক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান।
তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে রয়েছে নেপাল ও পাকিস্তান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই উত্তেজনা উসকে দিচ্ছে।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ। পুরো সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
রেডিও তেহরান: জনাব খন্দকার মুনীরুজ্জামান, সীমান্তে ভারত এবং চীন মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এরইমধ্যে চীনা প্রেসিডেন্ট তার দেশের সেনাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। আপনার কি মনে হয় চীন এবং ভারতের মধ্যে যুদ্ধ আসন্ন?
খন্দকার মুনীরুজ্জামান: এখন ভারত ও চীনের মধ্যে বড় ধরণের যুদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা আছে বলে আমার মনে হয় না। আর বড় ধরণের যুদ্ধ বলতে পরমাণু যুদ্ধ; সেই পর্যায়ে যাবে বলে আমার মনে হয় না। যদিও চীনের প্রেসিডেন্ট তার দেশের সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। তারপরও আমার কাছে মনে হয়েছে এটা চীনের দিক থেকে একধরণের ব্লাকমেইলিং স্ট্রাটিজি। কেন-সেটা এখনই হয়ত পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাবে না।
এখানে আমেরিকারও একটা ভূমিকা আছে বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভারতকে যথেষ্ট উসকে দিয়েছে। মি. ট্রাম্প বলেছেন, চীনের দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ভারতকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। এখানে একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার যে এখনও বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। আর বিষয়টি নিয়ে চীনের সাথে আমেরিকার একটা বিরোধ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র তার এই অর্থনৈতিক অবস্থান খোয়াতে চায় না। তাদের আধিপত্য হারাতে চায় না। ফলে চীনের সঙ্গে আমেরিকার একটা অর্থনৈতিক যুদ্ধ বেশ কিছুদিন ধরে চলছে। এ কারণে এশিয়ার দেশগুলোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা আছে। যেসব দেশের সাথে আমেরিকার মিত্র সম্পর্ক রয়েছে তাদের মাধ্যমে চীনকে চাপের মধ্যে রাখার চেষ্টার কৌশল রয়েছে আমেরিকার।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, ঠিক এইমুহূর্তে চীন কেন ভারতের সাথে সীমান্ত আগ্রাসনে গেল? এ বিষয়টিও ঠিক এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করাটা মুশকিল।
রেডিও তেহরান: চীন এবং ভারতের মধ্যে যখন প্রচণ্ড উত্তেজনা চলছে। সে প্রসঙ্গে আপনি যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকার কথা বললেন। আর ঠিক তখন তাতে জড়িয়ে গেছে নেপাল। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
খন্দকার মুনীরুজ্জামান: দেখুন, নেপালের সঙ্গে চীনের মিত্রতা শুধু আজকের নয়; বহু পুরনো। বলা চলে বেশ কয়েক যুগ ধরে। অন্যদিকে ভারতের সঙ্গে একটা দূরত্ব আছে। যদিও অর্থনৈতিকভাবে অনেক কারণে ভারতের সঙ্গে নেপালকে থাকতে হয়। তারপরও ভারতের সঙ্গে নেপালের একটা রাজনৈতিক দূরত্ব বেশ কয়েক বছর ধরে চলছে। চীনের সঙ্গে মিত্রতা এবং ভারতের সঙ্গে দূরত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
তাছাড়া আমরা জানি যে অতি সম্প্রতি চীন কাঠমাণ্ডু থেকে তাদের সীমান্ত বা ভেতরেও বেশ কিছুদূর পর্যন্ত একটি সড়ক তৈরি করছে। এটি এখন আন্ডার কনস্ট্রাকশনে আছে। সবকিছু মিলিয়ে যদি আমরা দেখি তাহলে দেখা যাবে, নেপালের স্ট্রাটিজিক বিষয়টি চীনের এ অঞ্চলের সাথে যুক্ত। সেক্ষেত্রে সীমান্তে ভারত-চীনের মধ্যে সংঘর্ষ এবং উত্তপ্ত পরিস্থিতির ক্ষেত্রে নেপালও একটি পার্টি হয়ে গেছে। ক্ষমতার ভারসাম্যের দিক থেকে আমি মনে করি এটি আঞ্চলিকভাবে একটি পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে যদি তা আরও কিছুদূর এগিয়ে যায়।
রেডিও তেহরান: প্রসঙ্গক্রমে কিন্তু পাকিস্তানের কথাটিও চলে আসে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ভারতের সম্প্রসারণকামী নীতির কারণেই চলমান উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। কি বলবেন আপনি?
খন্দকার মুনীরুজ্জামান: দেখুন, ভারতের বিরোধীতা করা পাকিস্তানের বেশ পুরনো একটা নীতি। এরপেছনে যুক্তি থাকুক আর নাই থাকুক ভারতের বিরোধীতা করাই তাদের বিদেশনীতির প্রধান স্তম্ভ। এটাকে কেন্দ্র করেই তারা অন্যান্য স্ট্রাটিজি ঠিক করে।
আপনারা খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, কাশ্মিরেও সম্প্রতি নতুন করে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। আমি মিডিয়াতে দেখলাম সম্প্রতি সেখানে একটি গাড়ি বোমা নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। এসব ঘটনাকে যদি আমরা একটার সঙ্গে অন্যটাকে যোগ করি তাহলে দেখব যে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানও রয়েছে। আমরা জানি চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের বহু পুরনো মিত্রতা রয়েছে। আর তাদের মিত্রতার প্রধান বিষয় হচ্ছে ভারতবিরোধীতা। অর্থাৎ পাকিস্তানও ভারতবিরোধী চীনও ভারতবিরোধী। এরবাইরে অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিষয় তো আছেই। ফলে পাকিস্তান, নেপাল ও চীন-সবটা মিলে এখানে একটা আন্তর্জাতিক স্ট্রাটিজি কাজ করছে বলে মনে হয়।
ভারত আধিপত্য বিস্তাতেরর চেষ্ট করছে এমন একটা দোহাই দিয়ে দেশটিকে একঘরে করে রাখা, একটা চাপের মধ্যে রাখা কিংবা কোণঠাসা করে রাখার চেস্টা চলছে কিনা সেটা এখনই বলা কিছুটা প্রিম্যাচিউর হয়ে যাবে। তবে সেটা হলেও আমি বিস্মিত হব না।
রেডিও তেহরান: সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইব, যদি ধরে নেয়া হয় যে ভারত এবং চীনের মধ্যে কোনো কারণে যুদ্ধ শুরু হলো। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কি হওয়া উচিত?
খন্দকার মুনীরুজ্জামান: দেখুন, যদি যুদ্ধ শুরু হয় ভারত এবং চীনের মধ্যে সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থানটা খুবই জটিল হবে। কারণ স্বাভাবিকভাবেই ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং তাদের সাথে আমাদের মিত্রতা আছে। আমাদের তিন দিকেই ভারতের সীমান্ত। ভারতের সাথে অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য অনেক বিষয়ে আদান প্রদানে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আগে এটি কম থাকলেও এখন অনেক বিস্তৃত ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্র। অর্থনীতির সাথে সাথে উন্নয়নের সম্পর্কও রয়েছে দিল্লির সাথে। এ সম্পর্ক হয়তো আরও বিস্তৃত হবে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে চীনের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভূমিকা ও বিনিয়োগ রয়েছে। ফলে আমার বক্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার যদি বিচক্ষণতার সাথে বিষয়টি বিবেচনা করে নিরপেক্ষ থাকে তাহলে হয়তো দেশের জন্য সেটি ভালো হবে। যদিও স্ট্রাটিজি ডিমান্ড করে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক আর চীনের সাথে সম্পর্ক দুটো একরকম না। বলতে হবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটা বেশি গভীর এবং প্রয়োজনীয়। সেক্ষেত্রে চীনের বিরোধীতা না করে নিরপেক্ষ থাকাটাই বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে বলে মনে করি।
রেডিও তেহরান: তো জনাব খন্দকার মুনীরুজ্জামান চীন-ভারত উত্তেজনা প্রসঙ্গে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
খন্দকার মুনীরুজ্জামান: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৪