জুন ২৪, ২০২০ ১৭:৩১ Asia/Dhaka

আজ আমরা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের তথা খ্রিস্টিয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি সুফি সাধক, মুহাদ্দিস ও কবি শেখ নাজমুদ্দিন কোবরার জীবন, চিন্তাধারা ও অবদান সম্পর্কে আলোচনা করব।

হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের তথা খ্রিস্টিয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি সুফি সাধক, মুহাদ্দিস ও কবি শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা জন্ম নিয়েছিলেন ৫৪০ হিজরিতে তথা ১১৪৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাচীন ইরানের খাওয়ারেজম অঞ্চলের খিইয়ুক বা খিভা রাজ্যে। এ অঞ্চলটি বর্তমানে উজবেকিস্তানের অংশ। শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা ছিলেন কোবরুইয়া সুফি তরিকার প্রতিষ্ঠাতা অথবা এই সুফি তরিকার শীর্ষস্থানীয় শেখদের অন্যতম। তাঁর খেতাব ছিল ‘আত-তাম্মাত আল কুবরা’। 

একটি সুশিক্ষিত ও গুণী পরিবারে জন্ম নেয়া এই মনীষীর পুরো নাম আবু আবদুল্লাহ আহমাদ বিন ওমর বিন মুহাম্মদ বিন আবদুল্লাহ হিভুকি খাওয়ারিজমি। তার মূল নাম ছিল আহমাদ। তবে তিনি নাজমুদ্দিন কুবরা নামেই বেশি খ্যাত। কেউ কেউ বলেন তাকে কুবরা বলা হত অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ও অগাধ জ্ঞানের কারণে। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি যৌবনে বিতর্ক ও যুক্তি প্রয়োগে ব্যাপক দক্ষতা ও খ্যাতি অর্জন করায় তাকে কুবরা বলা হত। তার ভক্ত-অনুরাগীদের অনেকেই তাঁকে আয়াতুল কুবরা বা মহানের নিদর্শন বলে অভিহিত করতেন। কিন্তু পরে তার অনুরাগীরা আয়াতুল শব্দটি বাদ দিয়ে তাঁর নামের সঙ্গে কেবল কুবরা উপাধিটি যুক্ত করতে থাকেন।

শেখ নাজমুদ্দিন কুবরাকে আওলিয়া গড়ার ওস্তাদও বলা হত। কারণ তিনি অনেক ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে আল্লাহর ওলি বা সুফি হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। 

রাশিয়ার প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ও  গবেষক বার্থেলসের মতে শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা ছিলেন প্রাচ্যের আধ্যাত্মিক রহস্যময় জ্ঞান-জগতের এক সূর্য এবং তার আধ্যাত্মিকতার আলো গোটা ইসলামী বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। আর ইরাক, ফার্স, খোরাসান,  ট্রান্স-অক্সিয়ানা ও অন্যান্য দেশে অবস্থিত তাঁর ভক্তরা এই মহান মুর্শিদের মাজারে এসে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং এই ভক্তরাও কুবরার আলো থেকে আলো নিয়ে এক একটি অঞ্চলের আধ্যাত্মিক গুরু বা আদর্শে পরিণত হয়েছেন। 

শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন জন্মভূমিতে। বাবা ও শিক্ষকদের পরামর্শে তিনি উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য সফর শুরু করেন। ফলে তিনি  সফর করেন নিশাপুর, ইস্ফাহান, হামেদান, তাব্রিজ, খুজেস্তান, হেজাজ ও মিশর। এসব অঞ্চলের মহান শিক্ষকদের কাছ থেকে তিনি বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক অনেক জ্ঞান অর্জন করেন। শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা  জ্ঞান সাধনা ও আধ্যাত্মিক তপস্যায়  জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় তথা যৌবনের বছরগুলো কাটিয়েছেন। যেখানেই কোনো দক্ষ পন্ডিত ও আধ্যাত্মিক শিক্ষক আছেন বলে শুনেছেন সেখানেই তিনি ছুটে গেছেন। ফলে তিনি হতে পেরেছেন একজন মস্ত বড় হাদিস-বিশারদ, জীবনীকার, দার্শনিক এবং ভাষা ও শব্দতত্ত্ববিদ।

শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা  দীর্ঘ বহু বছর ধরে মিসরে থাকার সময় সমকালীন খ্যাতনামা সুফীসাধক শেখ রুযবাহান মিসরির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং তাঁর ক্লাসগুলোতে যোগ দিতেন। রুযবাহান তাঁর শিষ্যের বুদ্ধিমত্তা ও নির্মল অন্তর দেখে অভিভূত হন। তাই তিনি তাকে নিজ সন্তানের মতই ভালবাসতেন এবং নিজ কন্যাকে নাজমুদ্দীনের সাথে বিয়ে দেন। এই স্ত্রী তাকে দুই পুত্র উপহার দেন।

হাদিস শাস্ত্রের বড় শিক্ষক আবু মানসুরের কাছে হাদিস বিষয়ক বই অধ্যয়ন করেন কুবরা। এ জন্য তিনি তাবরিজে গিয়েছিলেন। সেখানে বাবা ফারাজ তাব্রিজি নামের একজন আধ্যাত্মিক সাধক তথা আরেফের সঙ্গে পরিচিত হন কুবরা। তিনি তার শিষ্য হন এবং ইরফানের উচ্চ-পর্যায়ে উপনীত হন।

এরপর তিনি পুনরায় মিসরে ফিরে আসেন। তখন শেখ রুযবাহান তাঁকে একজন কামেল ব্যক্তিরূপে দেখতে পান। শেখ নাজমুদ্দীন কুবরা ইতোমধ্যে আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার গোপন রহস্যাবলী এবং খোদাপ্রেমের বিভিন্ন স্তরের নিয়ম-কানুন ও পথগুলো আয়ত্ত করার পাশাপাশি অন্যদেরও পথ দেখানোর যোগ্যতা অর্জন করেন। তাই শেখ রুযবাহান শেখ নাজমুদ্দীনকে তাঁর জন্মস্থান খাওয়ারিযমস্থ খিভায় গমন এবং আধ্যাত্মিক পথসন্ধানীদের শিক্ষাদান ও তাছাওউফের শিক্ষা বিস্তারের কাজে আত্মনিয়োগের জন্য পরামর্শ দেন।

শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা  এরপর আরও কয়েকজন বড় শিক্ষকের সান্নিধ্যে থেকে বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানের উচ্চ পর্যায়ে বিচরণ করেন। তার সর্বশেষ বড় শিক্ষক ছিলেন শেখ ইসমাইল কাসরি। এক বর্ণনা অনুযায়ী কাসরির পরামর্শেই তিনি মিশরে ফিরে গিয়ে পরিবার ও সন্তান-সন্ততিসহ আবার খাওয়ারিজমে আসেন এবং সেখানে ধর্ম প্রচার শুরু করেন।

শেখ কুবরা  ৫৭৫ হিজরিতে ৩৫ বছর বয়সে জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। জন্মভূমি খিভা বা বর্তমান যুগের জর্জানিয়ায় এসে তিনি একটি খানকাহ প্রতিষ্ঠা করে ইসলাম ধর্ম বিষয়ক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কাজে মশগুল হন। তার ক্লাসগুলো এতই জনপ্রিয় হয় যে কোবারর নাম মুসলিম বিশ্বের বড় বড় শিক্ষা কেন্দ্রগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।  বড় বড় বিদ্বান, পণ্ডিত ও খোদাপ্রেমিক হতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসতেন তার কাছে এবং তারা কুবরার ছাত্র হতেন। ইসলামী ইলমের তালিম দেয়ার পাশাপাশি কুবরা ছাত্রদের শেখাতেন খোদা-প্রেমের আধ্যাত্মিক পথ পরিক্রমার কৌশল তথা আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার উপায়। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে ছাত্ররা খোদাপ্রেমের তালিম দিতে নিজ নিজ অঞ্চলে ফিরে যেতেন কুবরার প্রতিনিধি হিসেবে।

অবশেষে ৭৮ বছর বয়সে নিজ জন্মভূমিতেই মোঙ্গলদের হামলায় শাহাদত বরণ করেন শেখ নাজমুদ্দিন কুবরা। বলা হয় মোঙ্গল হামলাকারীরা কুবরার মহল্লায় হামলা চালানোর আগে তাঁকে ও তাঁর শিষ্যদেরকে সরে পড়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু কুবরা তাদের প্রস্তাব নাকচ করে দেন এই বলে যে, যে শহরের শান্তি বা খুশির দিনগুলোতে ৭০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছি সেই শহরকে দুর্দিনে বা দুঃখের দিনে ছেড়ে যাওয়াটা অপমানজনক। ফলে লুটেরা ও নৃশংস দাঙ্গাবাজ মোঙ্গলারা হামলা শুরু করে। কুবরা বীরের মত লড়াই করতে থাকা অবস্থায় শত্রুর তিরের আঘাতে শহীদ হন। তাঁর শিষ্যদেরও কেউ কেউ প্রিয় শিক্ষক কুবরাকে মোঙ্গল হামলা শুরুর আগেই সরে পড়ার পরামর্শ দিয়েছিল। কিন্তু কুবরা বলেছিলেন, এখান থেকে চলে যাওয়ার অনুমতি আমার নেই। আমাকে এখানেই শহীদ হতে হবে। 

শেখ নাজমুদ্দীন কুবরা, তাঁর ছাত্র এবং অনুরাগীরা মোঙ্গল হামলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাঁদের শহরকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু এ যুদ্ধেই কুবরা ও তার শিষ্যরা ১২২১ খ্রিস্টাব্দ তথা ৬১৮ হিজরিতে শাহাদাত বরণ করেন। দিনটি ছিল দশই জমাদিউল আউয়াল।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।