ইরান সম্পর্কে পশ্চিমাদের কোনো ভুল ধারণা আছে?
-
শহীদ কাসেম সোলাইমানির ছবি হাতে দুই ইরানি নারী
পার্সটুডে: পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট "রেসপন্সিবল স্টেটক্রাফ্ট" (Responsible Statecraft) ইরান সম্পর্কে পশ্চিমাদের ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে একটি বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধ প্রকাশ করেছে।
ওই নিবন্ধে লেখা হয়েছে, যখন ইরানি কর্মকর্তারা মার্কিন সমকক্ষদের সাথে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ষষ্ঠ দফার আলোচনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন ইসরাইল একটি অপ্রত্যাশিত সামরিক হামলা চালায়।
পার্সটুডে জানিয়েছে, আমেরিকা ও ইউরোপ এই হামলার নিন্দা তো করেইনি, বরং তা উসকে দেয়। জার্মানির চ্যান্সেলর এই হামলাকে 'ইসরাইলের পক্ষ থেকে আমাদের সকলের জন্য একটি নোংরা কাজ' বলে বর্ণনা করেন।
পশ্চিমাদের এই অবস্থান ইরানি নেতৃত্বের দীর্ঘদিনের বিশ্বাসকে আরও শক্তিশালী করেছে যে, "ইরান ক্রমাগত বিশ্বাসঘাতকতা ও আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং বিশ্ব চায় ইরান আত্মসমর্পণ করুক, আর তাদের একা ফেলে দেয়।"
ইরানের দৃষ্টিকোণ: আত্মরক্ষার মনস্তত্ত্ব
পশ্চিম যদি ইরানের ইতিহাস এবং এর নেতৃত্বের মানসিকতা বুঝতে না পারে, তাহলে তেহরানের পদক্ষেপগুলোকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকবে। বাইরে থেকে যা আগ্রাসন বা জেদ বলে মনে হয়, তা ইরানি নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রতিরক্ষামূলক পদক্ষেপ—যার শেকড় রয়েছে তাদের গভীর জাতীয় স্মৃতিতে।
আক্রমণ ও বিশ্বাসঘাতকতার ছায়ায় ইরান
ইরান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পশ্চিমা আগ্রাসন ও বিশ্বাসঘাতকতার ছায়ায় বসবাস করেছে। তাদের আধুনিক ইতিহাসের প্রতিটি অধ্যায়ই একটি বার্তাই বহন করেছে—ইরান কেবল নিজের ওপরই ভরসা করতে পারে, যারা সামনে বসে আছে তারা সংস্কারপন্থী হোক, মধ্যপন্থী হোক কিংবা চরমপন্থী।
এই বোধের শুরু ২০২৫ সালে ইসরায়েলের হামলা বা ১৯৮০ সালে সাদ্দাম হোসেনের (বাথিস্ট ইরাকের পতিত স্বৈরশাসক) আক্রমণ থেকে শুরু হয়নি বরং এই ভয়ের শিকড় হাজার বছর আগের।
খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আলেকজান্ডার, সপ্তম শতকে আরবদের আক্রমণ, ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গোলদের হামলা, একাধিকবার তুর্কি এবং মধ্য এশীয় বাহিনীর আক্রমণ—সব মিলিয়ে ইরান এক দীর্ঘ বেদনাদায়ক স্মৃতিবাহী জাতি।
আরও সাম্প্রতিককালে, রুশ-ইরানি যুদ্ধে বিশাল ভূখণ্ড হারানো এবং বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রশক্তির হাতে দখল—সব মিলিয়ে ইরানের মনে গেঁথে গেছে এই বার্তা: 'যখনই বিপদ এসেছে, কেউ পাশে দাঁড়ায়নি'।
ঐতিহাসিক ক্ষত এবং প্রতিরক্ষা প্রবৃত্তি
এই গভীর ঐতিহাসিক আঘাত ইরানের নেতৃত্বের সিদ্ধান্তগুলোকে যেকোনো বক্তব্য থেকে বেশি ব্যাখ্যা করে। এজন্যই তারা- সামরিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা-কে আগ্রাসন নয়, বরং বাঁচার বীমা হিসেবে দেখে, কূটনীতিকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং এমনকি মধ্যপন্থীরাও পশ্চিমের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান।
৪টি বড় বিশ্বাসঘাতকতায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা:
সমসাময়িক ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত চারটি বড় বিশ্বাসঘাতকতা ইরানের পশ্চিমের ভণ্ডামির ভয়কে তীব্র করেছে:
১. ১৯৫৩-এ মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান
গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোসাদ্দেক যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক গড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু সিআইএ ও ব্রিটিশ এমআই৬-এর সহায়তায় তার সরকার উৎখাত করা হয়—শুধু ব্রিটিশ তেলের স্বার্থে।
২. বুশের "অশু অক্ষ" ঘোষণা
জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসন ইরানকে "অশুভ অক্ষ" হিসেবে ঘোষণা করে এবং আরও একঘরে করার নীতি গ্রহণ করে।
৩. ২০১৮-এ ট্রাম্পের জেএসিপিওএ থেকে সরে আসা
ইরান আইএইএ'র কঠোর পরিদর্শন মেনে চলছিল এবং ১৫ বার সম্মতি নিশ্চিত করা হয়েছিল। কিন্তু আমেরিকা একতরফাভাবে চুক্তি থেকে সরে যায় এবং আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
৪. ২০২৫ সালের ইসরায়েলি-মার্কিন সামরিক হামলা:
১৩ জুন ২০২৫—ষষ্ঠ দফার আলোচনার মাত্র দুদিন আগে—ইসরায়েল ইরানে নজিরবিহীন হামলা চালায়। পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো, বেসামরিক এলাকা, এমনকি বিজ্ঞানী ও সেনা কমান্ডারদেরও টার্গেট করা হয়। এরপর মার্কিন বোমারু বিমানগুলো ইরানের ভূগর্ভস্থ স্থাপনাগুলোতে বিশাল বোমা ফেলে। ট্রাম্প তখনো ইরানের "শর্তহীন আত্মসমর্পণ" দাবি করছিলেন এবং এই হামলাকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেন।
এই হামলাগুলো ইরানি নেতৃত্বকে আরও একবার পরিষ্কার বার্তা দেয়: পশ্চিম কথায় নয়, বরং অস্ত্রে বিশ্বাস করে।
এখন পশ্চিম কী আশা করতে পারে?
ইরানে যেই শাসনে থাকুক না কেন, একটি বিশ্বাস স্থায়ী। আর তা হলো- 'পশ্চিম তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না, চুক্তিকে সম্মান করে না এবং ইরানের সার্বভৌমত্বকে স্বীকৃতি দেয় না।'
এই মানসিকতা কেবল ইসলামি প্রজাতন্ত্রেই নয়—বরং রেজা শাহ ও তার পুত্র মোহাম্মদ রেজা শাহও পশ্চিমা শক্তির সদিচ্ছা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন। ১৯৭৯ সালের বিপ্লব এই মানসিকতার ইতি টানেনি, বরং আরও জোরালো করেছে এবং রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক ঐক্যমত তৈরি করেছে।
এর মানে এই নয় যে, ইরান কখনো নমনীয় নয় কিংবা আলোচনার অক্ষম। তবে তাদের আলোচনার শুরু হয় আস্থা থেকে নয়, বরং সতর্কতা থেকে। যতবারই পশ্চিমারা সামরিক বিকল্পে ফিরে গেছে, ততবারই ইরানের ভেতরে কূটনৈতিক বিরোধীরা শক্তি পেয়েছে।
এই মনোভাব হয়তো পশ্চিমা কূটনীতিকদের হতাশ করতে পারে, কিন্তু এটিকে উপেক্ষা করলে নীতিগুলো ব্যর্থ হবে। যদি পশ্চিম সত্যিই ভিন্ন কিছু চায়, তাহলে প্রথমে "শূন্য থেকে শুরু" করার অভিনয় বন্ধ করতে হবে। কারণ ইরানের প্রতিটি আলোচনায় ইতিহাস ঢুকে পড়ে। এবং সেই ইতিহাস এখনও একটিই কথা বলে: "তুমি একা। তাই সেইভাবেই কাজ করো।"
এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুমাত্র বিমান হামলায় ভাঙবে না, বরং ভাঙতে হবে টেকসই, বিশ্বাসযোগ্য ও সম্মানজনক প্রতিশ্রুতি'র মাধ্যমে। অন্যথায়, ইরান তার অতীত থেকেই শিক্ষা নেবে এবং সেই অনুযায়ী প্রতিরোধ করবেই।#
পার্সটুডে/এমএআর/৩১