জুন ২৮, ২০২০ ১৬:৩৫ Asia/Dhaka

ইরানের জলে-স্থলে, ক্ষেত-খামারে, বাগ-বাগিচায়, কল-কারখানায় উৎপাদিত হয় বিচিত্র পণ্য সামগ্রী। এর পাশাপাশি খনি থেকেও আহরিত হয় বিভিন্ন সামগ্রী। ইরানি নরনারীদের মেধা ও মনন খাটিয়েও তৈরি করা হয় বিভিন্ন শিল্পপণ্য।

গত আসরে আমরা আলোচনা বলেছিলাম বিশ্বব্যাপী ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যসামগ্রী বিক্রিলব্ধ অর্থের প্রায় চল্লিশ শতাংশ ব্যয় করে গবেষণা ও উন্নয়নসহ বিপণন এবং বাজারজাত করার পেছনে। এটাকে মূলত ব্যয় না বলে বিনিয়োগ করে বলাই শ্রেয়।

যেসব ওষুধ এখন রোগীদের জন্য নিরাময়কারী,সেগুলো বহু বছর আগেই গবেষণা করে উৎপাদন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। একইভাবে ভবিষ্যতে রোগীদের জন্য যেসব ওষুধের প্রয়োজন হবে সেগুলোর জন্য অদূর ভবিষ্যতে গবেষণার মাধ্যমে উত্পাদন করতে হবে। সুতরাং এই শিল্পে ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা এবং কী ধরনের রোগ-ব্যাধির চ্যালেঞ্জ বা আশঙ্কা রয়েছে সেসব নিয়ে গবেষণা করে প্রত্যাশিত ওষুধ তৈরির চিন্তা করতে হয়। আর এ কাজটির জন্য যথেষ্ট অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন পড়ে। সমগ্র বিশ্বে যত ওষুধ উৎপাদিত হয় তার বেশিরভাগই উৎপন্ন হয় উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপে। এই পরিসংখ্যান পরিমাপ করা হয় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে টার্নওভার অর্থলগ্নির পরিমাণের হার বিবেচনা করে।

বিশ্বব্যাপী ফার্মাসিউটিক্যাল বা ওষুধ উৎপাদন শিল্পে অর্থলগ্নির বিষয়টি নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এসবের মধ্যে রয়েছে সরবরাহকারীদের কাছ থেকে কাঁচামাল কেনা,গ্রাহক মানে ওষুধ ব্যবহারকারীদের কাছে ওষুধ বিক্রি করা, ওষুধ আমদানি-রফতানি করা, বিনিয়োগের পরিমাণ এবং ওষুধ কোম্পানিগুলোর বাজার মূল্য ইত্যাদি। বিশ্বব্যাপী ওষুধের বাজারে উন্নত দেশগুলো ওষুধের উত্পাদন এবং ব্যবহারের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে। সামগ্রিকভাবে এই বাজারের প্রায় শতকরা উনাশি ভাগই তাদের দখলে রয়েছে। অপরদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জনসংখ্যা হলো বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় পঁচাশি শতাংশ। অথচ উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত ঔষধের মাত্র একুশ শতাংশ ব্যবহার করে।

পরিস্থিতি এরকম হবার কিছু কারণও মনে হয় থাকতে পারে। সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে চিন্তা করা যায় পশ্চিমা দেশগুলোর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এবং উদীয়মান অর্থনীতিতে প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশ। ইউরোপ ও আমেরিকার ঔষধ উৎপাদনকারী প্রধান দেশ এবং কোম্পানিগুলি  তাদের উৎপাদিত ঔষধ এশিয়া ও আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে রফতানি করছে। ব্রাজিল, রাশিয়া,ভারত, চীন, ইউক্রেন, পোল্যান্ড, আর্জেন্টিনা, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, রোমানিয়া  এবং  ভিয়েতনামের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে ঔষধের চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং আগামী বছরগুলিতে বিশ্বব্যাপী ওষুধের বাজারে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারের এই উন্নয়ন ও বিকাশ নির্ভর করে মূলত জনসংখ্যা বৃদ্ধি,নতুন ওষুধ ও স্বাস্থ্যসেবা আরও বেশি হাতের নাগালে পৌঁছে যাওয়া এবং সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ওপর।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারের যে উন্নয়ন ও বৃদ্ধি সেটা মূলত জেনেরিক ওষুধের ক্ষেত্রে। উল্লেখযোগ্য যে ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রধান দুটি বিভাগ রয়েছে। একটি হলো ব্র্যান্ড মানে কোনো একটা ওষুধের জন্য কোনো একটা কোম্পানির নিজেদের দেওয়া নাম। অপরটি হলো জেনেরিক মানে সায়েন্টিফিক লিটারেচারে বা ওষুধের গবেষণা নিয়ে আলোচনার ক্ষেত্রে ওষুধটার যে নাম ব্যবহার করা হয়। প্রধান ওষুধ কোম্পানিগুলো মূলত বাণিজ্যিক ওষুধ তৈরি করে। জেনেরিক ড্রাগগুলি বাণিজ্যিক ওষুধের তুলনায় সস্তা। এ কারণে অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকা মধ্য ও নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে এমনকি কিছু ইউরোপীয় দেশসহ আমেরিকান কোনো কোনো দেশ-যেখানে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি, জেনেরিক ওষুধগুলি সেসব দেশে ভাল বাজার পেয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু'র বক্তব্য  অনুসারে ইরান ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে আশি বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। তাই ইরান ওষুধ উত্পাদনকারী একটি দেশ হিসেবে পরিগণিত। ইরানে ইসলামী বিপ্লব বিজয়ের আগে দেশের ওষুধের প্রায় সকল চাহিদাই প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোই মেটাতো। ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পর ইরানের ওষুধ শিল্পের প্রধান অংশের জাতীয়করণ করা হয়। এর ফলে ইরানে ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পের শুভ সূচনা হয়। হাতে গোণা কয়েকটি কারখানা গড়ে ওঠে এবং ওষুধ উৎপাদন করতে থাকে।  মাত্র চার দশকেরও কম সময়ের মধ্যে ইরান দেশের প্রয়োজনীয় ওষুধের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। বলা বাহুল্য যে, শতকরা পঁচানব্বুই ভাগ ওষুধই দেশীয় কারখানাগুলো এখন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। কয়েক ডজন ছোট-বড় কারখানা গড়ে ওঠার পাশাপাশি জ্ঞান-ভিত্তিক সংস্থা গঠনের মাধ্যমে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ছাত্রদের এক্ষেত্রে আকৃষ্ট করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এজন্য প্রয়োজনীয় উন্নত প্রযুক্তিরও  ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

ওষুধ শিল্পে ইরানের সাফল্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়  1979 সাল থেকে 2015 সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দেশীয় ওষুধের উত্পাদন শতকরা ত্রিশ ভাগ থেকে উন্নীত হয়ে শতকরা ছিয়ানব্বুই ভাগে পৌঁছেছে। ইরানি চিকিত্সকরা দেশের অভ্যন্তরে উত্পাদিত ঔষধের সাহায্যে কার্ডিওভাসকুলার রোগ, উচ্চ রক্তচাপ,উচ্চ কোলেস্টেরলের মতো আরও বহু রোগ নিয়ন্ত্রণ কিংবা নিরাময় করতে সক্ষম হয়েছেন। এটা ইরানের জনগণের আয়ু সূচক বাড়াতে সাহায্য করেছে। বর্তমানে ইরানি ওষুধের মান ভোক্তা বাজারে অনেক বেশি এবং সে কারণে বিদেশি ওষুধের তুলনায় রোগিরা ইরানি ওষুধ ব্যাপকহারে বেছে নিচ্ছে। ইরানি বিশেষজ্ঞদের কিছু অর্জনের মধ্যে রয়েছে এমএস রোগীদের জন্য সিনোভক্স "উত্পাদন, পোড়া রোগীদের জন্য" আলভোক্সিন "উত্পাদন, এইডস নিয়ন্ত্রণের ওষুধ উত্পাদন, ক্যান্সার রোগীদের জন্য "রিটক্সিম "ড্রাগ,বি এবং সি ভ্যাকসিন উত্পাদন,অ্যান্টি-টাইফয়েড এবং কলেরার ভ্যাকসিনসহ আরও বহু ওষুধ। বর্তমানে নিউক্লিয়ার আইসোটপও উৎপাদনে অগ্রসরমান ইরান।

সাম্প্রতিক দশকে বৈজ্ঞানিক এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে ইরান ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পে বিশ্বের শীর্ষ দশটি দেশের মধ্যে একটি। ইরানে উত্পাদিত ওষুধ আঞ্চলিক দেশগুলোতেও রফতানি করা হয়। ওষুধ এবং ওষুধের কাঁচামালও বর্তমানে আফগানিস্তান, ইরাকসহ মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশে রফতানি করা হচ্ছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।