জুন ২৮, ২০২০ ১৮:২০ Asia/Dhaka

গত কয়েকটি আসরে আমরা পরোপকার নিয়ে আলোচনা করেছি। বলেছি পৃথিবীর সব মানুষেরই উপকার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে কোনো শ্রেণীবিন্যাস নেই। তবে পরোপকার করতে হবে নিঃস্বার্থভাবে, পরোপকার করে খোঁটা দেওয়া যাবে না। কিন্তু যিনি উপকৃত হলেন তারও কিছু দায়িত্ব রয়েছে।

কেউ কারো মাধ্যমে উপকৃত হলে তার উচিত ওই ব্যক্তির উপকারের জন্য চেষ্টা করা, কোনো উপহার পেলে সামর্থ্য থাকলে একই ধরণের অথবা তার চেয়ে ভালো উপহার দিতে সচেষ্ট হওয়া অথবা অন্তত তার জন্য দোয়া করা। আজকের আসরে আমরা ওয়াদা ও প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে আলোচনা করব।

প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা পালন একটি বিশ্বজনীন মহৎ গুণ। বিশ্বের কোনো মানুষই এই গুণের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অস্বীকার করতে পারে না। পৃথিবীর সবাই প্রতিশ্রুতি পালনকারী ব্যক্তিকে শ্রদ্ধার চোখে দেখে, তাকে সম্মান ও বিশ্বাস করে। সব ধর্মেই ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইসলামেও এর ব্যতিক্রম নয়। ইসলাম ধর্মে ওয়াদা পালনের জন্য সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা ভঙ্গকারীকে ইসলাম ধর্ম ভৎর্সনা করে। শুধু তাই নয় প্রতিশ্রুতি বা ওয়াদা ভঙ্গকারীকে মুনাফিকের সঙ্গেও তুলনা করা হয়েছে। আসলে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করা বিশ্বাসঘাতকতার শামিল। পবিত্র কুরআনে ‘আহদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবি ‘আহ্দ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায় কোনো লোক বা পক্ষ অপর কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের সঙ্গে অঙ্গীকার করলে বা কাউকে কোনো কথা দিলে তা পালন করার নাম ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি। পবিত্র কুরআনেও স্পষ্টভাবে প্রতিশ্রুতি পালনের ওপর জোর দিয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা প্রতিশ্রুতি পালন করবে, নিশ্চয়ই প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে প্রশ্নের সম্মুখীন করা হবে।

ইরানের প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ মরহুম আল্লামা তাবাতাবায়ির মতে, কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে যে ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষার কথা বলা হয়েছে তা ব্যক্তিগত, সামষ্টিক, পারিবারিক, সামাজিক, গোষ্ঠীগত, জাতিগত ও আন্তর্জাতিকসহ সব অঙ্গনের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে ইসলাম ধর্মে সামাজিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতির গুরুত্ব ব্যক্তিগত প্রতিশ্রুতির চেয়ে বেশি। কারণ এসব প্রতিশ্রুতি সরাসরি সামাজিক ন্যায়বিচারের সঙ্গে যুক্ত এবং এর সঙ্গে বিশাল জনগোষ্ঠীর ভালো-মন্দ জড়িত। আসলে এ ক্ষেত্রে সামান্যতম শৈথিল্য প্রদর্শন মানবসমাজে মহাবিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে। প্রতিশ্রুতি মেনে চলা বা কথা দিয়ে কথা রাখার প্রবণতা মানুষের জন্মগত বৈশিষ্ট্যের অংশ। অর্থাৎ মানুষ শিশুকাল থেকেই প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করাকে অপছন্দ করে এবং প্রতিশ্রুতি রক্ষাকে গুরুত্ব দেয়। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, শিশুদেরকে দেওয়া কথা না রাখলে তারা দ্রুত বাবা-মায়ের ওপর অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ হয়। তারা বাবা-মাকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে। তারা চায় না, তাদের বাবা-মা অন্তত ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করুক।

অন্যভাবে বলা যায়, মানুষ জন্মের পর থেকেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার অনুভূতি নিয়ে বড় হতে থাকে। অবশ্য পরবর্তীতে পরিবার, সমাজ ও চারপাশে বিদ্যমান কলুষতা শিশুদেরকেও কলুষিত করে ফেলে এবং তারাও প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করতে শেখে। এই প্রবণতা গোটা মানব জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কোমলমতি শিশুদের ভেতরের জন্মগত এই মহৎ বৈশিষ্ট্য সঠিকভাবে লালন করতে পারলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা গোটা বিশ্ব উপকৃত হতো। কিন্তু আমরা সাধারণত এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিই না। আমরা অনেক সময় সহজেই কাউকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি। হাসতে হাসতেও অনেক কিছু দেওয়ার বা কাজ করে দেওয়ার কথা দিই। কিন্তু সব কথা রাখা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। আবার আমরা অনেক সময় অন্যকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলেও যাই। আমরা হয়তো অনেকে জানিই না যে, আমাদের এই কথা রাখতে না পারাটাই ওয়াদা ভঙ্গের শামিল। আমাদের জেনেশুনে এবং ভেবে-চিন্তে মানুষের সঙ্গে ওয়াদা করা উচিত। পবিত্র কোরআনের সূরা মায়িদার ১ নম্বর আয়াতে ওয়াদার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে বলা হয়েছে, 'হে ইমানদারগণ, তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করবে।'

আমরা যখন আমাদের দেওয়া কোনো ওয়াদা রক্ষা করতে পারি না বা ভুলে যাই, তখন অপর পক্ষ বা ব্যক্তি, যাকে আমরা ওয়াদা দিই তার মনে কষ্ট পাওয়াটা স্বাভাবিক। ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারীকে ধীরে ধীরে মানুষ অবিশ্বাস এবং অপছন্দ করতে থাকে। ওয়াদা ভঙ্গকারীকে আল্লাহ নিজেও অপছন্দ করেন। তিনি পবিত্র কোরআনের সূরা আনফালের ৫৮ নম্বর আয়াতে বলেছেন, 'তোমরা যদি কোনো সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে (চুক্তি ভঙ্গজনিত) বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কা করো, তাহলে তোমার চুক্তিও তুমি যথাযথ (ঘোষণা দিয়ে) বাতিল করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ চুক্তি ভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না।'  অনেক সময় দেখা যায়, আমরা আল্লাহর সঙ্গেও ওয়াদা করে থাকি। যেমন আল্লাহ আমাকে যদি এটা দেন, তবে আমিও তার বিনিময়ে এই ভালো কাজ বা দান-খয়রাত করব। কিন্তু আমাদের মনের আশা পূরণ হওয়ার পর আমরা আল্লাহকে দেওয়া ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি ভুলে যাই। আল্লাহ সুরা তওবায় বলেছেন, 'তাদের মধ্যে এমন লোকও আছে, যারা বলে যে, আল্লাহ যদি আমাকে দেন, আমি অবশ্যই সদকা (দান-খয়রাত) করব এবং প্রকৃত মুমিন হবো। অতঃপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার কৃপায় দান করল। সে তখন কৃপণ হয়ে গেল এবং পৃষ্ঠপ্রদর্শন করল।

 প্রতিশ্রুতি পূরণ করার সামর্থ্য থাকা অবস্থায় এবং প্রতিশ্রুতি পালন করতে ধর্মীয় কোনো বাধা না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা পূরণ করতে হবে। বিশেষ কোনো যৌক্তিক কারণে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়লে, যাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে তাকে বিনয়ের সাথে নিজের অপারগতা সম্পর্কে অবহিত করে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। ওই ব্যক্তি ক্ষমা না করলে সেটা ওয়াদাকারীর জন্য ইহকালীন ও পরকালীন অকল্যাণের কারণ হবে। এ কারণে যেকোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার আগে তা বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে। এরপরই কেবল প্রতিশ্রুতি দেওয়া উচিত।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ