জুন ৩০, ২০২০ ২০:৩৭ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন নিয়ে আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি পবিত্র কুরআনে ‘আহদ’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। আরবি ‘আহ্দ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে অঙ্গীকার, চুক্তি, প্রতিশ্রুতি, ওয়াদা, প্রতিজ্ঞা ইত্যাদি।

শরিয়তের পরিভাষায় কোনো লোক বা পক্ষ অপর কোনো ব্যক্তি বা পক্ষের সঙ্গে অঙ্গীকার করলে বা কাউকে কোনো কথা দিলে তা পালন করার নাম ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি। আজকের আসরেও আমরা ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করব। 

ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন করা আল্লাহর নির্দেশ। ইসলামি জীবনদর্শনে ওয়াদা পালন করা প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির জন্য অবশ্যপালনীয় কর্তব্য। আসলে জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে এবং শান্তিশৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনযাপনের জন্যও ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন অপরিহার্য। সামাজিক শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষার পূর্বশর্তই হচ্ছে প্রতিশ্রুতি পালন। পৃথিবীতে মানুষকে সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে হয়। সামাজিক প্রয়োজনেই মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সময় ওয়াদা করতে হয়। ওয়াদা বা চুক্তি না করলে সমাজে বহু রকমের অঘটন ঘটে থাকে, তখন সমাজে বসবাস করা কষ্টকর ও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। চুক্তি বা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করা ঈমানের একটি অপরিহার্য উপাদান। নবী-রাসূলদের জীবন থেকেও এটা স্পষ্ট, কোনো ঈমানদার মানুষ প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করতে পারে না। পবিত্র কুরআনের সূরা মরিয়মে হজরত ইব্রাহিম (আ.)’র সন্তান নবী হজরত ইসমাঈল (আ.)’র গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রতিশ্রুতি পালনের বিষয়ে তার দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই সূরার ৫৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,ইসমাঈলের কথা স্মরণ করুন, তিনি ছিলেন প্রতিশ্রুতি পালনে সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে রাসূল ও নবী।

এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম সাদেক (আ.) বলেছেন, একবার এক স্থানে হজরত ইসমাঈল (আ.)’র সঙ্গে এক ব্যক্তির সাক্ষাত করার কথা ছিল। কিন্তু ওই ব্যক্তি সেখানে আসেন নি। হজরত ইসমাঈল (আ.) দীর্ঘ সময় ধরে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। দীর্ঘ সময় নবীকে না পেয়ে তার অনুসারীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। হজরত ঈমমাইল (আ.) যেখানে অপেক্ষা করছিলেন কাকতালীয়ভাবে ঠিক তার পাশ দিয়েই তার এক অনুসারী যাচ্ছিল। এ সময় নবীর দিকে তা দৃষ্টি পড়ে। ওই অনুসারীও নবীর জন্য উদ্বিগ্ন ছিলেন। সে হজরত ইসমাঈলকে দেখে বলল-হে  আল্লাহর নবী আমরা আপনাকে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছি। নবী উত্তরে বলেন, আমি অমুক ব্যক্তির জন্য অপেক্ষা করছি, কারণ এখানে তার আসার কথা রয়েছে। আমি তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সে না আসা পর্যন্ত আমি এখান থেকে যাব না। এ কথা শুনে নবীর অনুসারী অন্যদেরকে সে তথ্য জানায়। এরপর তারা ওই ব্যক্তিকে নবীর কাছে নিয়ে আসে। ওই ব্যক্তি লজ্জাবনত হয়ে বলতে থাকে, হে আল্লাহর নবী, আমি আপনার সঙ্গে দেখা করার প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গিয়েছিলাম। হজরত ইসমাঈল (আ.) এসব শুনে বলেন, তুমি না এলে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকতাম।

প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার সর্বোপরি চুক্তি সঠিকভাবে পালন না করলে সমাজের গতিশীলতা বাধাগ্রস্ত হয় এবং অগ্রগতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। মানুষ যদি তাদের সামাজিক ও ব্যবহারিক জীবনে ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন না করে, তাহলে ওই সমাজ নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ে, বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যারা ওয়াদা পালন করে না বা কথা দিয়ে কথা রাখে না,আল্লাহ তাদেরকে বারবারই সতর্ক করেছেন। সূরা আস-সাফের ২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ,তোমরা যা করো না তা তোমরা কেন বলো?’

কথা দিয়ে কথা না রাখা মুনাফিক বা কপট ব্যক্তির স্বভাব। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মুনাফিকের যে তিনটি লক্ষণের কথা বলেছেন, তার একটি হলো ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন সংক্রান্ত। তিনি বলেছেন, ‘মুনাফিকের লক্ষণ তিনটি: যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে, যখন যে ওয়াদা করে ভঙ্গ করে, যখন তার কাছে কিছু আমানত রাখা হয়, সে খেয়ানত করে।’

বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল প্রতীক। মহানবী (সা.) কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেননি। তিনি কখনো প্রতিশ্রুতি দিলে যেকোনো মূল্যে তা পালন করতেন। তিনি শত্রুর সঙ্গেও প্রতিশ্রুতি রক্ষার নির্দেশ দিতেন। ইসলামি দর্শনে ওয়াদা পালনের ব্যাপারে শত্রু-মিত্র, মুসলিম-অমুসলিমে কোনো ভেদাভেদ নেই।

কারণ ওয়াদা পালন করা তাকওয়াপূর্ণ জীবনযাপনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাম মানুষকে যেসব উন্নত চরিত্রের শিক্ষা দেয়,তার মধ্যে একটি মৌলিক গুণ বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার। অঙ্গীকার পূরণ করার ক্ষমতা থাকা অবস্থায় এবং প্রতিশ্রুতি পালনে শরিয়তের কোনো আপত্তি না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা পূরণ করতে হবে। পবিত্র কোরআনে ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালনের প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদার ১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে,‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অঙ্গীকারসমূহ পূর্ণ করো।'

ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি এক প্রকারের ঋণ। কারও কাছ থেকে কোনো ঋণ নিলে তা যেমন পরিশোধ করতে হয়,তেমনিভাবে কারও সঙ্গে ওয়াদা করলে তা অবশ্যই পূরণ করতে হয়। প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনকারীরা পরকালের পাশাপাশি সাধারণত ইহকালেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রতিশ্রুতি বা কথা দিয়ে তা রক্ষা না করলে ব্যক্তিকে এই পৃথিবীতেও নানা ধরণের সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরণের মানুষের ওপর সবাই আস্থা হারিয়ে ফেলে, কেউ তাকে সম্মান করে না, সবাই তাকে ঘৃণার চোখে দেখে। এতে তার সামাজিক মানমর্যাদাও হ্রাস পায়। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ব্যক্তির কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রেও বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে পারে। প্রতিশ্রুতি বা চুক্তি ভঙ্গকারীরা আইনের চোখেও অপরাধী। অন্যদিকে যে ব্যক্তি ওয়াদা পালন করে পৃথিবীতে সে সবার কাছে প্রিয়পাত্র ও সম্মানিত হয় এবং মানসিক প্রশান্তি লাভ করে। আর পরকালে সে পরম সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও আনন্দ লাভ করতে সক্ষম হবে। 

জীবনকে সুন্দর ও সুষ্ঠুভোবে পরিচালনার জন্য প্রতিশ্রুতি পালন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এ বিষয়ে সবাই সচেতন থাকব এ প্রত্যাশায় শেষ করছি আজকের আসর।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ