জুলাই ০৪, ২০২০ ২০:১৮ Asia/Dhaka

প্রিয় বন্ধুরা, সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশাকরি সবাই ভালো আছেন। জীবনকে সুন্দরভাবে সাজানোর অনুষ্ঠান জীবশৈলীতে আপনাদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। গত দু'টি আসরে আমরা ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি পালন নিয়ে আলোচনা করেছি।

আমরা বলেছি, বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ছিলেন প্রতিশ্রুতি রক্ষার ক্ষেত্রে এক উজ্জ্বল প্রতীক। মহানবী (সা.) কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেননি। তিনি কখনো প্রতিশ্রুতি দিলে যেকোনো মূল্যে তা পালন করতেন। তিনি শত্রুর সঙ্গেও প্রতিশ্রুতি রক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন। ইসলামি দর্শনে ওয়াদা পালনের ব্যাপারে শত্রু-মিত্র, মুসলিম-অমুসলিমে কোনো ভেদাভেদ নেই। কারণ ওয়াদা পালন করা তাকওয়াপূর্ণ জীবনযাপনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলাম মানুষকে যেসব উন্নত চরিত্রের শিক্ষা দেয়, তার মধ্যে একটি মৌলিক গুণ বা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার। অঙ্গীকার পূরণ করার ক্ষমতা থাকা অবস্থায় এবং প্রতিশ্রুতি পালনে শরিয়তের কোনো আপত্তি না থাকলে যেকোনো মূল্যে তা পূরণ করতে হবে।

আমরা সাধারণত অবলীলায় শিশু সন্তানদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকি, অনেকের ধারণা বয়সে ছোট হওয়ায় তাদেরকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি না মানলেও চলবে। কিন্তু এই ধারণাটা ভুল। কারণ শিশু প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন দেখে নিজে যেমন কষ্ট পায় তেমনি তার মধ্যে প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘনের অভ্যাস গড়ে ওঠে, ওয়াদা ভঙ্গ করা মনোভাব নিয়ে সে বড় হয়। এ কারণে সন্তানকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিলে সেটা পালন করা উচিত। আপনি যদি তাদেরকে দেওয়া কথা রক্ষা না করেন তাহলে সেও আপনাকে কথা দিয়ে কথা রক্ষা করবে না। আপনি যদি তার কথা রাখতে পারেন তাহলে তাকে ‘হ্যাঁ’ বলুন, আর যদি না পারেন তাহলে ‘না’ বলুন। তাকে দ্বিধায় রাখবেন না। একই সঙ্গে প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্য সন্তানকে পুরস্কার দিতে হবে। ধরুন, আপনার সন্তানকে সপ্তাহের শুরুতে বললেন যে তুমি যদি পাঁচ দিন স্কুলে যাও, তাহলে শুক্রবার তোমাকে শিশু পার্কে বা কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাব। সে যদি ঠিকভাবে পাঁচ দিন স্কুলে যায়, তাহলে অবশ্যই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাকে শুক্রবার শিশু পার্কে অথবা কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাওয়া উচিত।

এই অভ্যাসটি শিশুদের মাঝে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার শৃঙ্খলাবোধ তৈরি করবে। আপনাকে দেখে দেখে সেও প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে শিখবে, বন্ধুদের সাথে করা প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রক্ষা করবে। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর যদি আপনি তা পালন না করেন, তাহলে শিশুর মন ভেঙে যাবে। মোট কথা সন্তানকে কোনো কথা দিলে সে কথা রাখতে হবে। এতে সন্তানও শিখবে প্রতিশ্রুতি পালন করতে হয় অর্থাৎ কথা দিয়ে কথা রাখতে হয়। শিশুরা সার্বক্ষণিক তার বাবা-মাসহ আশেপাশের লোকজনের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে এবং তা রপ্ত করে। আর এ প্রতিফলন ঘটে পরবর্তী জীবনে। শিশুদের দৃষ্টিতে, তার বাবা-মায়ের চেয়ে বেশি মহৎ ও বেশি জ্ঞানী আর কেউ নেই। তারা বাবা-মায়ের ওপরই সবচেয়ে বেশি আস্থা রাখে। এ কারণে মা-বাবাকে তাদের সন্তানদের সঙ্গে সব কাজ ও আচরণে সৎ হতে হবে এবং তাদেরকে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। শিশুরা যখন বুঝবে যে, তাদের বাবা-মা তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণ করে, তখন তাদের আস্থা আরও বেড়ে যাবে এবং বাবা-মায়ের কথা আরও বেশি মনোযোগ দিয়ে শুনবে। আসলে শিশুরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করে যে, বড়রা তাদেরকে যা বলে তা সব সত্য। এর ব্যতিক্রম দেখলে তারা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে যায় এবং তাদের আস্থা কমে যায়।

সমাজ ও রাষ্ট্রে চলতে গিয়ে এবং অফিসে-আদালতে নানা কাজকর্ম করতে গিয়ে লিখিত বা অলিখিত নানা রকম ওয়াদা বা অঙ্গীকার করতে হয়। ব্যবসা-বাণিজ্য ও লেনদেন চলে বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতির ওপর ভিত্তি করে। কোনো দেশের ভিসা গ্রহণ করা হলে সে দেশের আইনকানুন মানার জন্য প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। কোনো দেশে বসবাসকারীও কার্যত সে দেশের রাষ্ট্রীয় আইনকানুন মেনে চলার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ। নির্বাচনের সময় জয়ী হওয়ার জন্য নানা পর্যায়ের নেতারা জনগণকে বিভিন্ন ধরণের ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। এভাবে জীবনের বহু ক্ষেত্রে মানুষ মানুষের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা পরবর্তীকালে পালন করার কথা অনেকেই ভুলে যান। অনেকে মনে করেন, প্রতিশ্রুতি দিয়ে স্বার্থ আদায় করতে পারলেই হলো, এরপর তা পালনের বিষয়টি ভেবে দেখা যাবে। কিন্তু সবার মনে রাখা উচিৎ, যেকোনো প্রতিশ্রুতি পালন বা রক্ষা করা অপরিহার্য কর্তব্য। প্রতিশ্রুতি পালন না করলে নিজের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি দেখা দেয়। তা ছাড়া জেনেশুনে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা সরাসরি মিথ্যাচার, ইসলামে যা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ।

ওয়াদা বা প্রতিশ্রুতি রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে একটি গল্প শুনিয়ে আজকের আসর শেষ করছি। প্রচণ্ড শীতের এক রাতে রাজা বাইরের কিছু কাজ সেরে প্রাসাদে ফিরছিলেন। হঠাৎ তার চোখ পড়ল এক বৃদ্ধ প্রহরীর দিকে। ওই বৃদ্ধ প্রহরীর গায়ে কোনো ধরণের মোটা কাপড় ছিল না যা তাকে শীত থেকে বাঁচাতে পারে। এ অবস্থা দেখে রাজা প্রহরীকে প্রশ্ন করলেন, তোমার কি শীত লাগছে না? বৃদ্ধ প্রহরী বললেন, জ্বি জাহাপনা আমার শীত লাগছে। কিন্তু কী করব বলুন, আমারতো গরম জামা-কাপড় নেই, বাধ্য হয়ে শীত সহ্য করতে হয়। এসব কথা শুনে রাজা বললেন, আমি এখনই প্রাসাদে গিয়ে আমার একটি গরম পোশাক তোমার জন্য পাঠাব। প্রহরী এ কথা শুনে যার পর নাই খুশি হলেন এবং রাজাকে শ্রদ্ধাবনত হয়ে ধন্যবাদ জানালেন। কিন্তু রাজা প্রাসাদে গিয়ে তার এই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে গেলেন। পরের দিন সকালে প্রাসাদের পাশে বৃদ্ধ প্রহরীর মৃতদেহ পাওয়া গেল। মরদেহের পাশে অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা ছিল- হে রাজা, আমিতো প্রতিদিনই পাতলা পোশাক পরেই শীত সহ্য করে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তোমার গরম কাপড়ের প্রতিশ্রুতি আমাকে বাঁচতে দিল না।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ