জুলাই ২৮, ২০২০ ২০:৪৩ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা মানবজীবনে সুস্থ বিনোদনের গুরুত্ব ও প্রভাব সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি ইসলাম ধর্মে সুস্থ বিনোদনের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

কারণ পবিত্র ইসলাম ধর্মের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে ইহকালে শান্তি ও পরকালে মুক্তি। বিনোদন হলো শান্তি বা আনন্দের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম বা উপকরণ। ইসলাম ধর্ম নিষ্পাপ আনন্দ উপভোগকে সব সময়ই উৎসাহিত করেছে। এছাড়া হতাশা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। আর জীবনে আনন্দ ও শান্তি না থাকলে হতাশা জেকে বসে এবং কর্ম উদ্দীপনা কমে যায়। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (স.) নিজে সুস্থ বিনোদনের প্রায় সব উপায়-উপকরণ উপভোগ করেছেন। আজকের আসরে আমরা বিনোদনের নানা দিক নিয়ে আরও আলোচনার চেষ্টা করব।

পবিত্র কুরআনে সুখ বা আনন্দ শব্দটি বহু বার এসেছে। ইসলাম ধর্ম মানুষকে ন্যায়সঙ্গত উপায়ে সুখ, সমৃদ্ধি ও প্রশান্তি অর্জনে উৎসাহিত করেছে এবং মানবজীবনে আনন্দ ও প্রফুল্লতার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। আনন্দিত বা দুঃখিত হওয়া কেবল শুধু একজন মানুষের নিজের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নয়। কারণ, একজন মানুষের হাসি-খুশি মুখ এবং দুঃখ-ভারাক্রান্ত বা ক্রুদ্ধ চেহারা অন্যদেরও প্রভাবিত করেমনোবিজ্ঞানীদের মতে, মানুষের স্মৃতি অনুভূতি কেবল মগজের মধ্যেই সঞ্চিত থাকে নামানুষের মধ্যে সামষ্টিক বা সামাজিক অনুভূতি নামে এক ধরনের বিশেষ অনুভূতি রয়েছেআর এ অনুভূতি-শক্তির মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয়। আর এ কারণেই অন্যের সুখ ও দুঃখ মানুষকে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পরিবারের যেকোনো একজনের আনন্দ ও প্রফুল্লতা তার আচার-আচরণের মধ্যদিয়ে অন্য সব সদস্যের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। যারা মানুষের জন্য আনন্দ ও সুখের ব্যবস্থা করেন,পবিত্র কোরআন তাদের প্রশংসা করেছে। কাজেই যারা সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে নিজে আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি অন্যদেরকেও সুখ ও আনন্দ দেয় তারা পরকালে আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার পাবেন।                                

অবশ্য সব শ্রেণী-পেশা বা বয়সের মানুষের আনন্দের বিষয় একরকম নাও হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের মানুষ বিভিন্ন অবস্থায় আনন্দ পায়কোনো কোনো সমাজবিজ্ঞানীর মতে,সমাজের দূর্বল বা বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষ ফুটবল খেলা দেখে বা এ ধরনের বিষয় থেকে আনন্দ পায়। আবার মধ্যবিত্ত অবস্থা সম্পন্ন লোকেরা অর্থ জমিয়ে এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে আনন্দ বা সুখ উপভোগ করতে চায়। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টোটল মনে করতেন চিন্তাশীল জীবনের মধ্যে রয়েছে আনন্দ এবং এই আনন্দই হচ্ছে সর্বোচ্চ আনন্দ। আবার অনেক দার্শনিক ও গবেষক মনে করেন কেবল ধর্মীয় ও নৈতিক জীবন যাপনের মধ্যেই রয়েছে পরম সুখ ও আনন্দ। বেশিরভাগ মানুষই রংবেরংয়ের ফুল, সবুজ গাছ-পালা,ঝর্ণা,পাহাড়-পর্বত,নদী-নালা প্রভৃতি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে আনন্দ পান। এর মাধ্যমে মানুষ একদিকে যেমন আনন্দ উপভোগ করেন, তেমনি কিছুটা হলেও মহান আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহকে উপলব্ধির সুযোগ পান

ভ্রমণ ও এর মাধ্যমে সুন্দর দৃশ্য দেখা বা জ্ঞান অর্জন করা সুস্থ বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমপবিত্র কোরআন মানুষকে বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে অতীতের জাতিগুলোর পরিণতি থেকে শিক্ষা নিতে বলেভ্রমণের ফলে মানুষের মনে জমে থাকা অবসাদ, একঘেয়েমি ও ক্লান্তি দূর হয় এবং মন সতেজ ও প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। ভ্রমণ মানুষের শরীরকেও সুস্থ রাখে। এ জন্যই বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (স.) বলেছেন,তোমরা সুস্থ থাকার জন্য ভ্রমণ কর। শরীর-চর্চা এবং খেলাধুলাও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়াও আনন্দ ও বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম। তবে উৎসবের নামে অপচয়, বাড়াবাড়ি এবং অর্থহীন কর্মকান্ড ও অপসংস্কৃতি বা অনাচারে জড়িয়ে পড়া নিষিদ্ধ। ইসলাম ধর্ম সব ক্ষেত্রেই ভারসামপূর্ণ হওয়ার নির্দেশ দেয়। কোনো ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি গ্রহণযোগ্য নয়।

অনেক চিন্তাবিদের মতে দরিদ্র ও অসহায় মানুষকে সহযোগিতা করার মধ্যে রয়েছে অনাবিল আনন্দ। পরশ্রীকাতরতা থেকে দূরে থাকতে পারাও নির্মল সুখ ও আনন্দ উপভোগের একটি বড় উপায়। যারা অন্যের উন্নতি ও অগ্রগতি দেখে কষ্ট পায় তারা বেশি সময় আনন্দের মধ্যে থাকতে পারে না, কারণ অন্যের ভালো কোনো সংবাদ এলেই তার মনের ভেতরে কষ্টবোধ জন্ম নেয়। একইভাবে লোভী মানুষও দীর্ঘ মেয়াদি আনন্দ ও সুখ থেকে বঞ্চিত হয়। লোভী মানুষ অনেক কিছু পেয়েও সন্তুষ্ট হয় না,ফলে তার মধ্যে সব সময় মানসিক অশান্তি বাড়তেই থাকে। আল্লাহর ইবাদত ও মোনাজাত মানুষের অন্তরে শক্তি যোগায় এবং আত্মাকে করে সজীব ও প্রাণবন্ত। কবিতা বা গজল আবৃত্তি,বিয়ের উৎসব,উপহার দেয়া,উজ্জ্বল রংয়ের জামা কাপড় পরা, সুগন্ধি ব্যবহার,সুন্দর সাজে সজ্জিত হওয়া,আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং সর্বোপরি কর্ম ও সাধনায় জড়িত থাকা ইসলাম-নির্দেশিত নির্মল আনন্দের আরো কিছু মাধ্যম 

ইসলাম ধর্ম ভারসাম্যপূর্ণ ও যৌক্তিক ধর্ম। এ ধর্ম দৈহিক ও আত্মিক সব রকমের বৈধ চাহিদা পূরণকে সমর্থন করে। তবে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে অত্যাবশ্যকীয় বা ফরজ কাজগুলো বাদ পড়ে না যায়। সুস্থ বিনোদনের ক্ষেত্রেও ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, কোনো ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন গ্রহণযোগ্য নয়। এর কারণ হলো, সুস্থ বিনোদনে ডুবে থাকার কারণে অন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো পিছিয়ে পড়লে তা আনন্দের চেয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও মানসিক চাপ আরও বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে বিনোদন কল্যাণকর না হয়ে অকল্যাণের কারণ হয়ে ওঠে। আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, সুস্থ বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড কখনোই ইসলামি মূলনীতির পরিপন্থী হবে না। ইসলাম ধর্ম যেসব কথা,কাজ, আচার আচরণ ও তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে,সেগুলোকে কখনোই বিনোদনের উপায় বা মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যারা অন্যকে ঠাট্টা ও বিদ্রুপ করে আনন্দ পেতে চায় তারা ভুল করছে। ইসলাম এ ধরণের বিনোদনকে সমর্থন করে না।  

গত কয়েক দশক ধরে ইন্টারনেট তথা ভার্চুয়াল জগতে অসুস্থ ধারার নানা বিনোদনমূলক তৎপরতা বেড়েছে। এ ধরণের ক্ষতিকর বিনোদন এর আগেও ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা সবার জন্য সহজলভ্য হয়েছে। এ কারণে এ বিষয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। বিশেষকরে যুবসমাজ এ ধরণের অসুস্থ ধারার বিনোদনে বেশি প্রভাবিত হচ্ছে। # 

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ২৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ