সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২০ ১৩:৩০ Asia/Dhaka

ইরানে রাজনৈতিক সংহতি শক্তিশালী হওয়ার কারণে ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে রণাঙ্গণে ইরানের অবস্থান অনেকটা শক্তিশালী হয়। ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ থেকে বনি সদরকে সরিয়ে দেয়ার সরাসরি প্রভাব পড়ে যুদ্ধের ময়দানে।

সেনাবাহিনীর প্রচলিত যুদ্ধকৌশলের সঙ্গে ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’র বিপ্লবী রণকৌশলের সমন্বয় ঘটানো হয় এবং এর ফলে নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা উত্থাপিত হতে থাকে। এ সময় ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে সারাদেশ থেকে হাজার হাজার বেসামরিক তরুণ যুদ্ধের ফ্রন্টগুলোতে চলে যায়। এসব তরুণকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধ করার উপযোগী হিসেবে তৈরি করার দায়িত্ব নেয় ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী।

সামেনুল আয়েম্মে অভিযানে যেখানে আইআরজিসি’র মাত্র দুই হাজার ৫০০ জওয়ান অংশগ্রহণ করে সেখানে এক বছর না যেতেই যুদ্ধের দ্বিতীয় বছরে পরিচালিত বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযানে এই সেনা সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০ হাজারে। আবাদান অবরোধ মুক্ত করার অভিযান- সামেনুল আয়েম্মে প্রমাণ করে নতুন নতুন কৌশলে যুদ্ধ পরিচালনা করলে তাতে সাফল্য আসার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। ওই অভিযানে ইরাকি বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। ওই যুদ্ধে ইরানের নিহত হয় মাত্র দেড়শ জওয়ান যাদের অর্ধেকই ছিল আইআরজিসি ও স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর সদস্য। অন্যদিকে ওই অভিযানে দেড় থেকে দুই হাজার ইরাকি সেনা নিহত হয় এবং তাদের প্রায় এক হাজার ৮০০ সেনা ইরানি  যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়।  সেইসঙ্গে ইরাকিদের ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানসহ ভারী যুদ্ধাস্ত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সামেনুল আয়েম্মে নামক ওই অভিযান শেষ হওয়ার দুই মাসের মাথায় ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় আরেক শহর ‘বোস্তান’ ও এর আশপাশের গ্রামগুলো মুক্ত করার অভিযান চালানো হয় যার নাম ছিল তারেকুল কুদস।

প্রকৃতপক্ষে ইরানের রাজধানী তেহরানে রাজনৈতিক সংহতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তারেকুল কুদস ছিল ইরানের পক্ষ থেকে চালানো প্রথম অভিযান। এই অভিযানে প্রচলিত যুদ্ধকৌশল এবং গেরিলা যুদ্ধের দক্ষতা একসঙ্গে কাজে লাগানো হয়।  আগের সবগুলো অভিযানের চেয়ে এই অভিযান বেশি স্থানজুড়ে চালানো হয়। ইরানি যোদ্ধাদের প্রবল আত্মবিশ্বাস এবং ইরাকি বাহিনীর দুর্বল দিকগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করার মাধ্যমে এই অভিযানে সফলতা পাওয়া সম্ভব হয়। সামেনুল আয়েম্মের চেয়ে দ্বিগুণ বিস্তৃত এলাকায় তারেকুল কুদস অভিযান পরিচালনা করা হয়। যেসব লক্ষ্য সামনে রেখে এই অভিযান পরিচালিত হয় সেগুলোর মধ্যে ছিল সীমান্তবর্তী বোস্তান শহর মুক্ত করা, শত্রুবাহিনীকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ওপারে ঠেলে দেয়া, ইরাকি বাহিনীর উত্তর অংশের সঙ্গে দক্ষিণ অংশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া এবং যত বেশি সংখ্যায় শত্রু সেনাকে খতম করা। আগ্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে পূর্বঘোষিত এসব লক্ষ্যের সবগুলো বাস্তবায়িত হয়।

গণবাহিনীকে সঠিকভাবে পরিচালিত করা ছিল এই যুদ্ধের আরেকটি উল্লেখযোগ্য সাফল্য। ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি বেসামরিক তরুণদের ব্যাপক মাত্রায় নিজেদের বাহিনীতে ভর্তি করে তাদেরকে সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়। এর ফলে এই বাহিনীর যুদ্ধ করার সক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তারিকুল কুদস অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের সাফল্যের একটি বড় কারণ ছিল মরুভূমির বিশাল বালুর প্রান্তর অতিক্রম করা। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী সব দিক দিয়েই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। কিন্তু যেদিকে মরুভূমি সেই দিক থেকে ইরানি যোদ্ধাদের আগমনের আশঙ্কাকে শূন্য ধরে রেখেছিল তারা।  ফলে তারা ওই দিকটা অরক্ষিত রেখে দেয় ইরাকি বাহিনী।  শত্রু বাহিনীর এই দুর্বলতা সম্পর্কে ইরানি যোদ্ধাদের সম্যক ধারণা থাকার কারণে তারা মরুভূমির দুর্গম পথে অগ্রসর হন। পরবর্তীতে তাদের হাতে আটক ইরাকি সেনারা ইরানি যোদ্ধাদের বলে, “তোমরা পায়ে হেঁটে মরুভূমি পাড়ি দাওনি বরং হেলিকপ্টারে এসে শহরের কাছাকাছি অবতরণ করেছো।” কিন্তু বাস্তবতা হলো ইরানি যোদ্ধারা পায়ে হেঁটেই তপ্ত মরুভূমি পাড়ি দিয়েছিল; হেলিকপ্টারে নয়।

তারেকুল কুদস অভিযানে দখলদার ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করা হয়। সেইসঙ্গে ইরাকি বাহিনীর ১৮০টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, ২০০টি গাড়ি, ১৩টি জঙ্গিবিমান ও চারটি হেলিকপ্টার ধ্বংস হয়ে যায়।  ইরাকি বাহিনীর ১২টি ব্রিগেডের ৪৫টি ব্যাটেলিয়ন ইরানি যোদ্ধাদের হামলায় তছনছ হয়ে যায়। হতাহত হয় তিন হাজার ৫০০ জনেরও বেশি ইরাকি সেনা।  যুদ্ধে ইরান গনিমতের মাল হিসেবে ১০০টি ট্যাংক, ১৫০টি বুলডোজার,  ১৯টি ১৫২ মিলিমিটারের গোলা, ৭০টি সাঁজোয়া যান, ৭০টি বিমান বিধ্বংসী গোলা, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং ২৫০টি গাড়ি।

ইরানি যোদ্ধাদের সাহসিকতা ও আত্মোৎসর্গের মানসিকতার কারণে তারেকুল কুদস অভিযানে এত বড় সাফল্য অর্জিত হয়। এমন আত্মোৎসর্গের নজির ইরানি যোদ্ধারা রেখেছিলেন খোররামশাহর ও হোভেইজে শহরের পতনের সময়। জীবনের শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত ওই দুই শহরের যোদ্ধারা ইরাকি বাহিনীর হাতে শহর ছেড়ে দেননি। তাদের শাহাদাতের পরই কেবল আগ্রাসী সেনারা শহরে ঢুকতে সক্ষম হয়। দখলীকৃত বিভিন্ন এলাকা ও শহর পুনরুদ্ধারের সময়ও ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে সেই আত্মোৎসর্গের মানসিকতা লক্ষ্য করা যায়। ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইয়ের পাতায় পাতায় এ ধরনের আত্মত্যাগের কাহিনী লিপিবদ্ধ রয়েছে।

তারেকুল কুদস অভিযানে অংশগ্রহণকারী ইরানের কেরমান শহরের অধিবাসী স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা মোহাম্মাদ মাহদি শাফাযান্দ ওই অভিযান সম্পর্কে বলেন: রাতের আঁধারে মাইন ও কাঁটাতার পোতা প্রান্তরের পেছনে দাঁড়িয়ে ফিস ফিস শব্দ শুনতে পাই। একটু এগিয়ে যেতেই দেখি আহওয়াজ থেকে আসা আমাদেরই একদল সেনা ফিস ফিস করে কথা বলছে। আমরা মাইনের মধ্যে এমনভাবে ঘেরাও হয়ে পড়েছিলাম যে, বেরিয়ে যাওয়ার কোনো পথ ছিল না। ওই অবস্থায় ইরাকি বাহিনী আমাদেরকে দেখে ফেললে ব্রাশফায়ার করে আমাদের সকলকে হত্যা করত। আহওয়াজের যোদ্ধারা মাইনভর্তি প্রান্তর দিয়ে আগে আগে হেঁটে গিয়ে আমাদের জন্য রাস্তা খুলে দেয়ার প্রস্তাব দেয়। যারা মাইনের প্রান্তরে গিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন তাদের মধ্যে মাহদি হোজ্জাত ছিল অন্যতম। আহওয়াজের যোদ্ধারা সেদিন নিশ্চিত শাহাদাতের সেই সুযোগ আমাদেরকে দিতে চায়নি।

সেই রাতের ঘটনার পরবর্তী অংশ সম্পর্কে কেরমানের অধিবাসী স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা মোজতাবা মোয়াজ্জেনযাদে বলেন, “হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণের আওয়াজ শুনতে পাই। আহওয়াজের যোদ্ধারা মাইনভরা প্রান্তরে এগিয়ে গিয়ে শহীদ হয়ে যান এবং আমাদের বের হওয়ার রাস্তা খুলে যায়। ”

ইরান-ইরাক যুদ্ধে এই একই ঘটনার অসংখ্য পুনরাবৃত্তি রয়েছে যেখানে যোদ্ধারা নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন যাতে দেশের মাটি শত্রুমুক্ত হয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।