ইরানি মনীষী মুহাম্মাদ বিন জারির ত্বাবারির অবদান
গত দুই পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি তৃতীয় শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী মুহাম্মাদ বিন জারির ত্বাবারির লেখা বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ 'জামিআল বায়ান আন তাওয়িল আই আল কুরআন' তথা তাফসিরে তাবারি নামে খ্যাত বইটি নিয়ে কথা বলব।
ইরানি মনীষী মুহাম্মাদ বিন জারির ত্বাবারির লেখা বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ 'মাজমায়ুল বায়ান' তথা তাফসিরে তাবারি প্রকাশ হওয়ার পর তা সে সময়কার শিক্ষিত মহলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ইবনে নাদিমের বর্ণনা থেকে জানা যায় ওই তাফসির প্রকাশের পর কয়েক যুগের মধ্যেই এই তাফসিরের আরও দুটি হাতে-লেখা সংস্করণ প্রকাশ করা হয় ইয়াহিয়া বিন উদাইয়ের মাধ্যমে। সম্ভবত ২৯০ হিজরিতে তথা ৯০৩ খ্রিস্টাব্দে তাফসিরে ত্বাবারি লেখা শেষ হয়েছিল। আর ৩৬৩ হিজরিতে তথা ৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে অন্য ইসলামী দেশে বিক্রির জন্য এর কপি করেন ইয়াহিয়া বিন উদাই। পরবর্তী শতকগুলোতেও মুসলিম বিশ্বে এই তাফসিরের জনপ্রিয়তা অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন বই, উৎস ও বর্ণনায় ত্বাবারির এই তাফসিরের উচ্চ মানের প্রশংসা দেখা গেছে এবং অনেকেই সারাংশ করে বা সংক্ষেপে এই তাফসির গ্রন্থ পুনরায় লিখেছেন।
ত্বাবারির তাফসিরকে কুরআনের ব্যাখ্যামূলক বর্ণনার বিশ্বকোষ বলা যায়। তাই এ বইটিকে বর্ণনামূলক তাফসির গ্রন্থগুলোর তালিকায়ও রাখা হয়। কিন্তু কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যামূলক হাদিস বা বর্ণনাগুলোর সমালোচনাও এই গ্রন্থে যুক্ত হওয়ায় বইটির উপযোগিতা আরও বেড়েছে এবং বইটি আরও বেশি মূল্যবান ও আকর্ষণীয় হয়েছে। ক্ল্যাসিক যুগের তাফসির হত কেবলই বর্ণনামূলক বা হাদিস-ভিত্তিক। কিন্তু ত্বাবারির তাফসির ওই যুগে লেখা হলেও তা নিছক বর্ণনামূলক তাফসির লেখার যুগের অবসান ঘটিয়েছে। আর এইসব কারণেই তাফসিরে ত্বাবারি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং তা পরবর্তীকালে বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ তাফসিরের জন্য উপযুক্ত আদর্শে পরিণত হয়।
ত্বাবারির তাফসির গ্রন্থ 'মাজমাউল বায়ান' বা তাফসিরে ত্বাবারিতে প্রায় ৩৮ হাজার ৪০০ উদ্বৃতি রয়েছে। এ ছাড়াও কুরআনের তাফসিরের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সময়ের নানা ঘটনার বর্ণনা রয়েছে এই তাফসিরে। নানা ঘটনার মুহুর্তের পর মুহূর্তের ধারাভাষ্যযুক্ত এসব বর্ণনা তাফসিরে ত্বাবারিকে করেছে ব্যাপক তথ্য-বহুল।
ইতিহাসের হারিয়ে-যাওয়া বা ভুলে-যাওয়া নানা ঘটনাও তাফসিরে ত্বাবারিতে স্থান পাওয়ায় সেসব ঘটনাকে পুনরায় যথাযথভাবে তুলে ধরার বা অন্তত সেসব বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইরানি মনীষী মুহাম্মাদ বিন জারির ত্বাবারি ছিলেন কুরআন বিষয়ক কোনো কোনো জ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যাপক পারদর্শী। তাই তিনি তার তাফসির গ্রন্থে এইসব জ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটাতে পেরেছিলেন। জ্ঞানগত এইসব বিষয়ে নিজ যুগের জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিতদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরায় তাফসিরে ত্বাবারি সে যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা অর্জনের এক মূল্যবান উৎসে পরিণত হয়েছে। একই কারণে এই তাফসির গ্রন্থ সে যুগের চিন্তাগত বা মতাদর্শগত নানা ধারা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনেরও সহায়ক।
ইরানি মনীষী মুহাম্মাদ বিন জারির ত্বাবারি তার তাফসির গ্রন্থ জামিআল বায়ান বা মাজমায়ুল বায়ানে তথা তাফসিরে ত্বাবারিতে কুরআনের নানা ঘটনা বা কাহিনী সংক্রান্ত বিষয়ে বনি ইসরাইলের তথা ইহুদিদের কিছু বর্ণনাও ব্যবহার করেছেন কোনো ধরনের বিশ্লেষণ ও বাছ-বিচার ছাড়াই। ফলে অনেকেই তার তাফসিরের এই দিকের কঠোর তিরস্কার করেছেন। যদিও বনি-ইসরাইলের বর্ণনার ব্যবহার সে যুগে একটি প্রচলিত বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। বহু তাফসির ও হাদিসের টেক্সটেও ইহুদিদের বর্ণনা দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন ত্বাবারি বিশ্বাস করতেন কুরআনের কোনো শব্দের ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য ও আয়াতের বিষয়বস্তুগুলো যে ব্যাখ্যায় তুলে-ধরা বিষয়বস্তুর সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় তার প্রমাণ তুলে ধরতে যেমন জাহেলি যুগের আরব কবিদের কবিতার অংশ বা পংক্তির দৃষ্টান্ত দেয়ার ব্যবহার দেখা যায় তেমনি ইসরাইলি বা ইহুদিদের বর্ণনাগুলোও মূল বিষয়কে তুলে ধরার জন্যই ব্যবহার করা দোষের কিছু নয়।
ইসলামী সংস্কৃতিতে তাফসিরে ত্বাবারির রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব। প্রাচ্যবিদরাও এ বইটিকে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়ায় এই তাফসির গ্রন্থকে নিয়ে নানা ধরনের কাজ করেছেন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা। বিশ্বের বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাফসিরে ত্বাবারি যেমনটি অনূদিত হয়েছে তার বিশাল ইতিহাস গ্রন্থ তারিখে ত্বাবারি।
উল্লেখ্য, বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় তাফসিরে ত্বাবারির অনুবাদ ইন্টারনেটেও পাওয়া যায় পিডিএফসহ নানা ফর্মেটে। আগ্রহীরা সার্চ দিয়ে তা সংগ্রহ বা ফ্রি ডাউনলোডও করতে পারেন।
হিজরি তৃতীয় শতকের প্রখ্যাত ইরানি ঐতিহাসিক, পবিত্র কুরআনের মুফাস্সির ও দার্শনিক মুহাম্মাদ বিন জারির ত্বাবারির জীবন ও অবদান সম্পর্কিত ধারাবাহিক আলোচনা এখানেই শেষ করছি। #
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।