অক্টোবর ০১, ২০২০ ১৯:২০ Asia/Dhaka

এই ধারাবাহিকের অতীতের কয়েকটি আলোচনায় আমরা আমরা পাশ্চাত্যে ইসলাম এবং মহানবী (সা) সম্পর্কে শত শত বছরের অযৌক্তিক, গোড়ামীপূর্ণ ও কুসংস্কারপূর্ণ বৈরি আচরণ ও পরিবেশের কারণ এবং প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেছি।

আমরা দেখেছি যে পাশ্চাত্যে ইসলাম এবং মহানবী (সা) সম্পর্কে গত কয়েক শতকে যুক্তিবাদী মনীষীদের ধারণায় দ্রুত ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পরিবর্তনের এই হাওয়া বইতে থাকার প্রেক্ষাপটে যারা মহানবী (সা), ইসলাম ও মুসলমানদের ভূয়সী প্রশংসা করে নিজেদের নামকেও ইতিহাসের পাতায় প্রজ্জ্বল ও অমর করেছেন তাদের মধ্যে ফরাসি চিন্তাবিদ ভলতেয়ার, জার্মান কবি গ্যাটে ও গুন্ডাররোড, ইংরেজ ঐতিহাসিক গীবন ও থমাস কার্লাইল,  ওয়াশিংটন আরভিং, রুশ কবি পুশকিন ও ইভান বুনিন, রুশ মনীষী লিও টলস্টয় ও জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিল্কসহ আরো অনেকের নাম উল্লেখযোগ্য। গত দুই পর্বে আমরা ইসলাম ও ইসলামের মহানবী (সা) সম্পর্কে এই শেষোক্ত দুই মনীষী তথা টলস্টয় ও রাইনারের প্রশংসাসূচক যৌক্তিক নানা মন্তব্য তুলে ধরেছি।

জার্মান কবি রাইনার মারিয়া রিল্ক জার্মান মহাকবি গ্যাটের লেখা পড়ে ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে উৎসাহী হয়েছিলেন। বহু মুসলিম দেশ সফর করে তিনি মুসলমানদের উন্নততর জীবনের প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন। রাইনার ‘ডুইনো এলিজিস’ নামক কবিতায় ইসলাম ও মহানবীর (সা) ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। ‘ইউরোপে মুহাম্মাদ’ শীর্ষক বইয়েও তিনি ইসলাম ও মুহাম্মাদের ভূয়সী প্রশংসা করে নিরপেক্ষ, উদার ও যুক্তিবাদী মনের পরিচয় দিয়েছেন।

 মুহাম্মাদের আহ্বান’ নামক কবিতায় জার্মান কবি রাইনার মহানবীর (সা) কাছে ওহির ফেরেশতা তথা জিব্রাইল (আ)’র আগমনের চিত্রটি তুলে ধরেছেন খুব প্রশংসনীয় ব্যাখ্যা দিয়ে ও সূচারু শৈল্পিক ভঙ্গীতে। তিনি লিখেছেন: ‘যখন পবিত্র ও অতি-উজ্জ্বল আলোকিত সত্ত্বা এবং মহতী স্বভাবের ফেরেশতা মহানবীর (সা) নির্জন সাধনার স্থান হেরা পর্বতের গুহায় এলেন তখন তিনি তথা মহানবী (সা) সব ধরনের নিজস্ব ইচ্ছাকে এড়িয়ে গেলেন। .... তিনি কখনও পড়েননি। আর এখন এমন বাণীর মহত্ত্ব বোঝা তাঁর মত জ্ঞানীর পক্ষেও সম্ভব ছিল না। কিন্তু বেশ জোরদার ভঙ্গি নিয়ে ওই ফেরেশতা একটি ফলকে লেখা বাণীর দিকে তাকাতে বললেন মহানবীকে এবং আবারও বললেন: পড়ুন! তখন তিনি পড়লেন। এমনভাবে পড়লেন যে ফেরেশতা মাথা নুইয়ে দিলেন। এবং এখন তিনি হলেন এমন মানুষ যেন তিনি পড়াশুনা জানা শিক্ষিত ব্যক্তি ছিলেন এবং এভাবে তিনি আনুগত্য করলেন ও মহান আল্লাহর ফরমান বাস্তবায়ন করলেন।

জার্মান কবি রাইনার মিশর ও উত্তর আফ্রিকা সফর শেষে কয়েক মাসের জন্য স্পেনে এসেছিলেন। এখানেই তিনি ইসলামী প্রাচ্য সম্পর্কে তার ধারণা ও ভাবনাগুলোকে সুবিন্যস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখানেই আরও একবার পবিত্র কুরআনকে গভীরভাবে অধ্যয়নের প্রেরণা পেলেন রাইনার। অল্প ক’দিন না যেতেই তিনি প্রিন্স ফোরেস্টিন ট্যাক্সিসের কাছে লেখা এক চিঠিতে নিজের অবস্থা তুলে ধরে লিখেছেন

আমি এখন কুরআন পড়ছি। কুরআনের রয়েছে অনন্য সুর লহরী। এ এমন এক সুর যা আমার সমগ্র সত্ত্বার মাঝে বাঁশীর সুরের মত বাজছে ..... মুহাম্মাদ ছিলেন সবচেয়ে কল্যাণময় বা গতিশীল ও বাস্তব। তিনি ছিলেন এমন এক নদীর মত যা পর্বতমালার মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে প্রখর গতিতে এবং এগিয়ে চলছে এক আল্লাহর পানে যে আল্লাহ প্রতিদিন ভোরে বিস্ময়করভাবে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম।   

প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ আর্নল্ড জোসেফ টয়েনবি ইসলাম ও মহানবী (সা)  সম্পর্কে ব্যাপক গবেষণা করে এ বিষয়ে প্রশংসাসূচক মন্তব্য করেছেন। খ্রিস্টিয় ১৮৮৯ সনে জন্ম নেয়া ব্রিটিশ নাগরিক আর্নল্ড টয়েনবি পড়াশুনা করেছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘অ্যা স্টাডি অফ হিস্টোরি বা ইতিহাস নিয়ে একটি গবেষণা’ শীর্ষক তার বইটি খুবই বিখ্যাত। ১২ খণ্ডের এ বই লিখতে তিনি দশ বছর সময় নিয়েছেন। 

সিভিলাইজেশন অন ট্রায়াল বা  ‘পরীক্ষার পাত্রে সভ্যতা’ ও সভ্যতার ইতিহাস শীর্ষক অনন্য গবেষণা-সমৃদ্ধ বইগুলো টয়েনবিকে এনে দিয়েছে ব্যাপক খ্যাতি। টয়েনবি মনে করতেন ধর্ম হচ্ছে সভ্যতার ভিত্তি।  টয়েনবি 'সভ্যতার ইতিহাস' শীর্ষক বইয়ের নবম অধ্যায়টির নাম দিয়েছেন বিশ্বের সূচনা থেকে বর্তমান সময়ের একটি বিশ্লেষণ এবং এর শিরোনাম করেছেন ‘নবী মুহাম্মাদ (সা) ও রাজনীতিবিদ’। তিনি ইসলামের প্রশংসা করেছেন একাধারে একে একটি সভ্যতা ও ধর্ম হিসেবে।

যদিও ইসলাম ও মুসলমানদের সম্পর্কে টয়েনবির মতামতে কিছু পরস্পর-বিরোধিতা রয়েছে, কিন্তু তিনি  ইসলামের মহানবীকে (সা) নবী ও ইসলামী সভ্যতার জনক হিসেবে উল্লেখ করেছেন।  টয়েনবি লিখেছেন, ইসলাম ধর্ম  মুহাম্মাদের খোদায়ি প্রতিভার মাধ্যমে আরব উপদ্বীপের ইতিহাসে সূচনা ঘটায় ও বিকাশ লাভ করেছে। টয়েনবি সে যুগের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ্যের ব্যাখ্যা দিয়ে মুহাম্মাদের ইসলামী মিশন শুরু সম্পর্কে লিখেছেন:

মুহাম্মাদের কাছে সর্বপ্রথম ওহি এসেছিল ৬১০ খ্রিস্টাব্দে। এ সময় খাদিযাহ (সা) ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও তিনি সপরিবারে মক্কায় থাকতেন। ওহির ফেরেশতা জিবরাইল তার কাছে ওহি তথা খোদার বাণী নিয়ে আসলে তিনি প্রথমবারের মত ধর্মের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। মুহাম্মাদ শোনেন যে জিবরাইল তাকে কিছু পড়তে বলেছেন যাতে তা মক্কায় তার অনুসারীদের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়। প্রথমে এই ধর্মীয় অভিজ্ঞতার গ্রহণযোগ্যতা ও সত্যতা নিয়ে তাঁর মধ্যে দ্বিধা বা সন্দেহ ছিল (নাউজুবিল্লাহ) কিন্তু এরপর বার বার ওহি নিয়মিতভাবে আসতে থাকায় মুহাম্মাদ এর সত্যতা ও নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হন।

টয়েনবি ও মুসলমানদের অনেকে এভাবে ব্যাখ্যা করলেও বাস্তবতা হচ্ছে মুহাম্মাদ (সা) শৈশব থেকেই জানতেন যে তিনি শেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হবেন এবং তার চাচা, বাবা ও দাদাও তা জানতেন! তাই প্রথম ওহির অভিজ্ঞতার সময়ে খোদার বাণীর ব্যাপারে তাঁর মনে সন্দেহের অবকাশ থাকার প্রশ্নই ওঠে না। #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।