অক্টোবর ০৩, ২০২০ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

প্রখ্যাত ইরানি মনীষী মাওলানা রুমির বাবা বাহাউদ্দিন ওয়ালাদের জীবন সম্পর্কে গত কয়েক পর্বের আলোচনায় আমরা তার জীবনের বিচিত্রময় কিছু দিক, বিশেষ করে তার হিজরত ও সফরগুলো এবং ধর্ম প্রচার ও জনপ্রিয় বক্তা হওয়ার কথা জেনেছি।

বাহা ওয়ালাদ ৬২৮ হিজরিতে ৮৩ বছর বয়সে কৌনিয়ায় ইন্তেকাল করেন।  বাহা ওয়ালাদের একমাত্র যে বইটির কথা জানা যায় তা 'মাআরেফ' নামে খ্যাত। মূল্যবান এ বইটিতে তার নানা বক্তব্য ও বিতর্ক এবং পবিত্র কুরআনের কোনো কোনো বাক্যের ব্যাখ্যা, মহানবীর (সা) নানা হাদিস ও ইসলামী বিধি-বিধান আর দর্শন সম্পর্কিত কিছু প্রশ্নের উত্তর স্থান পেয়েছে। এসবই বাহা ওয়ালাদের শিষ্য বা মুরিদদের মাধ্যমে সংগ্রহ ও নথিবদ্ধ করা হয়েছিল। তার এ বইটি থেকে বোঝা যায় তিনি ছিলেন একজন শক্তিমান ধর্ম-প্রচারক, বিচক্ষণ ও ইসলামী বিধি-বিধানের ব্যাপারে যে কোনো উদাসীনতা সম্পর্কে কঠোর ও উদ্বিগ্ন মনোভাবের অধিকারী। 'মাআরেফ' নামের এ বইটি প্রখ্যাত মরমী কবি মাওলানা রুমির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। রুমি তার আলোচনায় এ বইটিকে বেশিরভাগ সময়েই  'ফাওয়ায়েদে ওয়ালাদ' নামে স্মরণ করেছেন। রুমির সাহিত্য-কর্মে এ বইটির নানা বিষয়বস্তু ও বক্তব্যের প্রভাব দেখা যায়।

রুমির অনেক গজল ও দ্বিপদী কবিতায় তথা মাসনাভিতে বাহা ওয়ালাদের বই মাআরেফের অনেক ভাবধারাকে পরিবর্তিত রূপে দেখা যায়। বাহা ওয়ালাদের মাআরেফ বইটির ভাষা কাব্যময় ও হৃদয়গ্রাহী শব্দে ভরপুর। পবিত্র কুরআনের তাফসির ছাড়াও এতে রয়েছে একত্ববাদ, মহান আল্লাহর নাম ও গুণাবলী এবং ইসলামী দর্শন ও সুফি তত্ত্ব বা  আধ্যাত্মিক খোদাপ্রেম সম্পর্কিত আলোচনা।

মাআরেফ বইটি প্রথমবারের মত ছাপাখানা থেকে প্রকাশ করেন হেলমুট রিটার। রিটারের এই পদক্ষেপ সম্পর্কে কিছু না জেনেই প্রখ্যাত ইরানি গবেষক ও সাহিত্যিক ফুরুজানফার ইস্তাম্বুলের একটি কপি ও তেহরানের একটি কপির আলোকে ১৯৫৪ সনে তথা ফার্সি ১৩৩৩ সনে তেহরানে এ বইটি প্রকাশ করেন মুদ্রিত আকারে।  এরপর কৌনিয়ার সংস্করণের আলোকে কিছুটা সম্পাদনা করে   ১৯৫৯ সনে তথা ১৩৩৮ ফার্সি সনে বইটি আবারও প্রকাশ করেন তিনি। বাহা ওয়ালাদের মাআরেফের এ সংস্করণটি ফুরুজানফারের মৃত্যুর পর কিছুটা পরিবর্তিত রূপে দুই খণ্ডে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে তথা ফার্সি ১৩ ৫২ সনে আবারও প্রকাশ করা হয়।  

বাহা ওয়ালাদের মাআরেফ বইটির প্রথম খণ্ডে রয়েছে তিনটি অধ্যায়। ফুরুজানফার দ্বিতীয় খণ্ডের বিষয়বস্তুকে চতূর্থ অধ্যায় বলে উল্লেখ করেছেন।  তার মতে এই অধ্যায়টি বাহা ওয়ালাদের লেখা, না তার ছেলে রুমির লেখা, কিংবা অন্য কারো লেখা কিনা তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত প্রথম খণ্ডের বক্তব্যগুলোকে পরিপূর্ণ করার জন্য এই অধ্যায় পরে যোগ করা হয়। বাহা ওয়ালাদের মাআরেফ বইটির নোটগুলো ঠিক কোথায় ও কখন লেখা হয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। তবে কোনো কোনো নিদর্শনের আলোকে বলা যায় এইসব নোট বা বক্তব্যের বেশিরভাগই বাহা ওয়ালাদের জন্মভূমি বালখেই লেখা হয়েছিল। ফুরুজানফারের মতে এইসব নোটের কোনো কোনোটি বাহা ওয়ালাদের হিজরতের পর এশিয়া মাইনরে সংকলন করা হয়। আর যেসব নোট সংকলনের বা লেখার তারিখ পাওয়া গেছে বা লেখার তারিখ নির্ধারণ করা সম্ভব সেসব হিজরি ৫৯৭ থেকে ৬০৭ হিজরিতে লেখা হয়েছিল।

প্রখ্যাত জার্মান গবেষক ফ্রিটজ ম'য়ার বাহা ওয়ালাদের জীবন ও ইরফান শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। তার মতে বাহা ওয়ালাদের ইরফানের জগত আর অন্য আলেমদের ইরফানের জগতের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। তাই এ ব্যাপারে আরও বিশদ ব্যাখ্যা দেয়া উচিত। তিনি নিজেই বাহা ওয়ালাদের বক্তব্য থেকে যেসব অর্থ বের করেছেন সেগুলো পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট নয় বলে উল্লেখ করেছেন এবং তার মতে এসব অর্থকে প্রামাণ্য করার জন্য উৎসাহী জার্মান পাঠকদের উচিত মূল বই তথা বাহা ওয়ালাদের মাআরেফ বইটি পড়া। আর এ জন্য বইটির এক বিপুল অংশ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা উচিত বলেও ফ্রিটজ্‌ ময়ার মন্তব্য করেছেন।

ফার্সি সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক জাবিহউল্লাহ সাফার মতে বাহা ওয়ালাদের মাআরেফ বইটির ভাষা কবিতার মতই পেলব ও কোমল। এ বইয়ের ভাষায় বালখ্ অঞ্চলের জনগণের কথ্য স্টাইলের ছাপ দেখা যায়। ফুরুজানফারের মতে এ বইয়ের ভাষা কাব্যময় গদ্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন এবং বইটির ভাষা বর্ণনাভঙ্গীর দিক থেকে আত্তার, সানায়ি ও হাফেজের কবিতার কাছাকাছি।

ফ্রিটজ ম'য়ারের মতে রুমির বাবা বাহা ওয়ালাদের বক্তব্য খুবই আকর্ষণীয় এবং তা কৃত্রিমতা ও কৃত্রিম সাজ-সজ্জা থেকে মুক্ত। তিনি বাহা ওয়ালাদের এ বইয়ে প্রকাশিত ইসলামী ইরফানি চিন্তাধারার নতুনত্বের প্রশংসা করে লিখেছেন এ ধরনের ইরফান তথা আধ্যাত্মিক খোদাতত্ত্ব বিশ্বের সত্ত্বায় মহান আল্লাহর প্রকাশ ও আরশের মধ্যে মহান আল্লাহর রূপক অবস্থানের ব্যবধান ঘুচিয়ে দিয়েছে।  অধ্যাপক ফুরুজানফারের মতে বাহা ওয়ালাদের মাআরেফ বইটিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কুরআনের বক্তব্যই কখনও স্পষ্টভাবে ও কখনও ইন্দ্রিয়গাহ্য করে বা ইন্দ্রিয়গোচরের কাছাকাছি করে বোঝানোর সুবিধার্থে রূপক আকারে তুলে ধরা হয়েছে। অধ্যাপক জাররিনকুবের মতে বাহা ওয়ালাদের এই বইয়ের বক্তব্যগুলো যেন বস্তুজগতের বাইরের ভিন্ন জগতের কোনো কথা যা কলম থেকে বের না হয়ে তার হৃদয় থেকে বের হয়েছে।

বাহা ওয়ালাদের মাআরেফ বইটিতে ফার্সি 'খোদা' শব্দটির পরিবর্তে সব সময় আল্লাহ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। কারো কারো মতে বাহা ওয়ালাদ মানুষের ইলাহি বা খোদায়ি রং ধারণ করাকে তার জন্য সর্বোচ্চ পর্যায় বলে মনে করতেন। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ