ডিসেম্বর ২৩, ২০২০ ১৯:২৫ Asia/Dhaka
  • মাওলানা সাইফ ফারগানির জীবন, রচনা ও অবদান

গত কয়েক পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতকের তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি সাইফ ফারগানির জীবন, রচনা ও চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলব।

হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতকের তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি  সাইফ ফারগানির কবিতা বা সাহিত্য-কর্ম বুঝতে হলে এ দুই শতকে ইরানের ওপর মোঙ্গল ও তাতারদের কর্তৃত্ব এবং তাদের নৈরাজ্যময় শাসন ও সে সময়কার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা রাখা জরুরি বলে আমরা গত দুই পর্বে এ বিষয়ে ঐতিহাসিক কিছু তথ্য তুলে ধরেছি। ইতিহাসের বইগুলোতে সে সময়কার ইরান এবং আশপাশের অঞ্চলগুলোর রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থতি সম্পর্কে ইতিহাস লেখকদের তুলে ধরা বক্তব্য ও ধারণার সঙ্গে কবি-সাহিত্যিকদের বক্তব্যের ধরণে অবশ্যই পার্থক্য রয়েছে। ইতিহাস লেখকরা বাস্তবতা যতটা তুলে ধরতে পারেন তার চেয়েও বেশি সূক্ষ্মভাবে বাস্তবতা উঠে আসে কবিতা ও সাহিত্যে। এ দুই শতকে ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নৈতিক পরিস্থিতি খুব শোচনীয় হওয়া সত্ত্বেও ইরানিরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাদের স্বাতন্ত্র বা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ঠিকই ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। সমসাময়িক ইরানি কবি, লেখক ও সাহিত্যিকরা হত্যাযজ্ঞ, ধ্বংসযজ্ঞ, লুটপাট, দারিদ্র ও দুর্নীতি সম্পর্কে মানুষের বেদনাগুলো নানাভাবে  তুলে ধরেছেন এসবের প্রভাব সবার ওপরই পড়েছিল বলে। এসব নিয়ে আক্ষেপ ও প্রতিবাদ এবং কখনওবা মারাত্মক বিদ্রুপ বা পরিহাস ও দাবি-দাওয়ার কথা উঠে এসেছে শেখ সাদি, খাজু কেরমানি, আওহাদি মারাগ্বায়ি ও উবাইদ যাকানির মত প্রখ্যাত ইরানি লেখক এবং কবিদের কবিতায় ও গদ্যে।

সমাজের পরিস্থিতি যখন শোচনীয় হয় তখন সাধারণ ও অসচেতন মানুষ তা কেবলই নিরবে সহ্য করে। আর একদল এ সময় শাসক শ্রেণীর সহযোগী হয়। কিন্তু এক শ্রেণীর জ্ঞানী বা সচেতন মানুষ প্রতিবাদ জানায় ও লেখালেখির মাধ্যমে এসবের কারণ তুলে ধরেন এবং অন্যায় ও দুর্নীতির পরিণতি সম্পর্কে শাসকদের সতর্ক করেন। সংগ্রামী আলেম, কবি ও লেখকরা এই তৃতীয় শ্রেণীরই অংশ। ইরানের বেশিরভাগ কবিরাই ছিলেন এই শেষোক্ত শ্রেণীর।

ইরানের ওপর মোঙ্গল ও তাতারদের সর্বাত্মক হামলার ফলে ইরানের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিস্থিতি গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোনো কোনো কারণে এইসব ক্ষতি খুব বেশি ভয়াবহ বা চরম মাত্রার হয়ে ওঠেনি। ফলে ইরানিরা কোনো কোনো অঞ্চলে নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হয়। এর অন্যতম বড় কারণ হল ইরানের কোনো কোনো অঞ্চল ও আশপাশের কোনো কোনো অঞ্চল তাতার ও মোঙ্গলদের বর্বর হামলার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। ইরানের কোনো কোনো স্থানীয় নেতা ও ইরানের আশপাশের স্থানীয় নেতারা বিচক্ষণ নীতি অনুসরণ করায় এইসব অঞ্চল চেঙ্গিস খান ও তার স্থলাভিষিক্তের হামলার বহু বছর পরে ওইসব বিজাতীয়দের পরবর্তী প্রজন্মের হামলার শিকার হয়েছিল। ফলে হামলার তীব্রতা, ধ্বংসযজ্ঞ ও বর্বরতা এইসব অঞ্চলে অনেক কমে গিয়েছিল।  যেমন, ইরানে মোঙ্গল হামলার সময় পুরো ফার্স প্রদেশ ছিল সা’দ বিন যেন্‌গি ও আবুবকর এবং তাদের সন্তান বা পুত্রদের শাসনাধীন। এ দু’জনই ছিলেন খুব ভালো বাদশাহ। তারা কবি-সাহিত্যিক, আলেম ও শিল্পীদের লালনের ক্ষেত্রে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এ সময় ফার্স অঞ্চলে অনেক মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানক্বা গড়ে উঠেছিল এবং ঘটেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিল্প-সাহিত্যের ব্যাপক প্রসার ।

চেঙ্গিস ও হালাকু খানের এবং এমনকি প্রথম যুগের ইলখানিদের হামলার সময় গোটা ফার্স প্রদেশ নিরাপদ ছিল। এমনকি সা’দ বিন যেন্‌গি ও আবুবকর-এর শাসনামলে এ অঞ্চলের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটে। ফলে অনেক বিখ্যাত জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তি এখানে এ অঞ্চলে আশ্রয় নেন। কবি শেখ সাদি শিরাজের গৌরবময় এ যুগের প্রশংসা করে কবিতা লিখেছেন। শামস্ ক্বায়েস রাজি ইরাক ও খোরাসানে ভবঘুরের মত জীবন-যাপনকালে ফার্স প্রদেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাহায্য কামনা করেছিলেন। তিনি ফার্স প্রদেশের উন্নয়ন, নিরাপত্তা ও জনক্যাণের ক্ষেত্রে সা’দ বিন যেন্‌গি’র ছেলে আতাবেগ আবুবকরের প্রচেষ্টার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।

শামস্ ক্বায়েস রাজি’র বর্ণনা থেকে বোঝা যায় সালগুরিয়ানদের শাসনামলে ফার্স প্রদেশ ছাড়াও আশপাশের দ্বীপ ও উপসাগরীয় অঞ্চলের বন্দরগুলো মোঙ্গলদের হামলা ও হত্যাযজ্ঞ সত্ত্বেও জ্ঞানী-গুণি ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের জন্য ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও নিরাপদ অঞ্চল। অন্যদিকে আশপাশের অন্য অনেক অঞ্চলের অবস্থা ছিল ঠিক এর বিপরীত। ফলে প্রথমোক্ত অঞ্চলে ইরানি সংস্কৃতি যেমন রক্ষা পেয়েছে তেমনি এ অঞ্চল নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির কারণে আশপাশের দেশ ও অঞ্চলগুলোর জ্ঞানী-গুণি এবং আশ্রয়প্রার্থী বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য নিরাপদ ও আকর্ষণীয় আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে।

সমসাময়িক যুগে অন্য যে ক’টি অঞ্চল নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ছিল এশিয়া মাইনরের রুমও ছিল সেসবের অন্যতম। এ অঞ্চল ছিল সালযুকদের শক্তিশালী শাসনাধীন। সালযুকরা শেষের দিকে দুর্বল হয়ে আসলে এ অঞ্চলে মোঙ্গল শাসন শুরু হয়। এর আগে এশিয়া মাইনরের শহরগুলো ছিল ইরানি জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিতদের আশ্রয়স্থল। সে সময় ট্রান্স অক্সিয়ানার অঞ্চলের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও এক শহর থেকে অন্য শহরে ও দেশে সফর করার সময় এশিয়া মাইনরে স্থায়ীভাবে থেকে যেতেন। এইসব বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে মাওলানা রুমি, শামস তাব্রিজি ও বুরহানউদ্দিন মুহাক্কিক তিরমিজি ও সাইফউদ্দিন মোহাম্মাদ ফারগানি, কাজি সিরাজউদ্দিন এবং আরও অনেকের নাম উল্লেখ করা যায়। এই ব্যক্তিত্বরা রুমে পার্থিব ও ধর্মীয় দিক থেকেও  বিশিষ্ট  ব্যক্তিত্ব ছিলেন। ইরানের বহু ব্যক্তিত্ব সে যুগে এশিয়া মাইনরের লোকদের সঙ্গে মিশতেন ও এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হন।  তারা ফার্সিভাষী ছিলেন বলে অনেক বই, বিশেষ করে ফার্সি বইপুস্তক, সাহিত্য-কর্ম এবং পারস্যের সংস্কৃতি এ অঞ্চলে বয়ে আনেন। আর এসব সেখানেই থেকে যায়।

সে যুগে মিশর ও সিরিয়ার অবস্থাও ছিল ফার্স ও এশিয়া মাইনরের বা রূমের অনুরূপ। ফলে এ দুটি অঞ্চলও ছিল অভিবাসী ইরানি জ্ঞানী-গুণীদের আশ্রয়স্থল।

সিন্ধু নদীর অপর পাড়ে ভারতও ছিল তাতার ও মোঙ্গলদের হামলা থেকে নিরাপদ এক অঞ্চল। ঘুরি বংশের শাসন এ অঞ্চলে শুরু হওয়ার পর থেকে সেখানেও ফার্সি ভাষার প্রচলন ঘটে। ফলে এ অঞ্চলও ফার্সি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্য-সংস্কৃতির কেন্দ্র হয়ে পড়ে। ঘুরি বংশের শাসকদের তিন ভাগে ভাগ করা যায়। তাদের একদল সিন্ধু, অন্য দল দিল্লি অঞ্চলের ও অন্য দল ছিলেন বৃহত্তর বাঙ্গলা বা বাংলাদেশ অঞ্চলের শাসক। এরা সবাই ছিলেন ইরানি সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত। তাই তাদের দরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বেশিরভাগই ছিলেন ইরানি। এমনকি তাদের ভৃত্য ও যানবহনের চালকদেরও বেশিরভাগই ছিলেন ইরানে প্রশিক্ষিত ও অভিবাসী ইরানি।

ভারতের শাসনযন্ত্রে যুক্ত হওয়া বহু সংখ্যক ইরানি মোঙ্গল হামলার কিছু আগে অথবা ওই হামলার সময় কিংবা ট্রান্স-অক্সিয়ানা ও খোরাসান অঞ্চলের নৈরাজ্যময় ঘটনা-প্রবাহের সময় পালিয়ে সিন্ধু অঞ্চল পার হয়ে ভারতে  আসেন। তাতারদের হামলার সময় যেসব ইরানি কবি সিন্ধু পালিয়ে গিয়ে অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন নুরুদ্দিন মোহাম্মাদ ওউফি ছিলেন তাদের অন্যতম। উপরোক্ত কয়েকটি অঞ্চল অর্থাৎ ফার্স, রুম, মিশর, সিরিয়া ও ভারত ছাড়াও আরও কয়েকটি অঞ্চল নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে ইরানি জ্ঞানী-গুণীদের আশ্রয়স্থল হয়েছিল। এভাবে নানা বিপদ ও বিপর্যয় সত্ত্বেও ইরানি সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং এ সংস্কৃতির অনেক বই ও শিল্পকর্ম টিকে গেছে ও হয়েছে বিকশিত।#         

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ