ডিসেম্বর ১৬, ২০২০ ০২:৩০ Asia/Dhaka
  • মাওলানা সাইফ ফারগানির জীবন, রচনা ও অবদান

গত দুই পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি সপ্তম ও অষ্টম শতকের তথা খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত ইরানি কবি সাইফ ফারগানির জীবন, রচনা ও চিন্তাধারা নিয়ে কথা বলব।

গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি ইরানে মোঙ্গলদের আগ্রাসন, গণহত্যা ও লুটতরাজ শুরু হয় হিজরি ৬১৬ সনে ও তৈমুরি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতার লুণ্ঠন ও বলদর্পি শাসনের মধ্য দিয়ে তা শেষ হয়। তাদের তথা মোঙ্গল ও তাতারদের এই সূদীর্ঘ দুইশ বছরের নৈরাজ্যপূর্ণ শাসনামল সম্পর্কে জানা ছাড়া মাওলানা সাইফের কবিতার প্রেক্ষাপট ভালোভাবে বোঝা সম্ভব নয়।

ইরানি জাতি এ দুইশত বছরে যেন অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত যন্ত্রণা সহ্য করেছে। এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও ইরানিরা জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণ জিইয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। অবশ্য এ যুগের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা স্থায়ী যখমের মত ইরানের সংস্কৃতিতে দৃশ্যমান থেকে গেছে। হালাকু ও চেঙ্গিজ খান এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের মোঙ্গলদের শাসনামল শেষে দুর্বল সুলতানি শাসনামল শরু হয়। এ সময়ও নতুন ধরনের সামাজিক নৈরাজ্য ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয়। আর এ পরিস্থিতি ইরানের ওপর তৈমুর লঙ্গ-এর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ সহজ করে দেয়।

 ইরানে চেঙ্গিজ খানের সময়কার গণহত্যা সম্পর্কে ভয়ানক বর্ণনা ইতিহাসে এসেছে। সে সময়ে ইরানের বহু শহর, বিশেষ করে খোরাসানের বেশিরভাগ শহর পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। সে সময় মার্ভ শহরে মোঙ্গলরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল সে বিষয়ে ঐতিহাসিক জুইয়িনির বর্ণনায় এসেছে: চেঙ্গিজ খানের সেনারা যখন শহরে ঢুকে পড়ে তখন তারা লুট-তরাজ, নারীদের সম্ভ্রমহানি ও হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তারা সাধারণ ও বিশিষ্ট জনগণ সবাইকে শহরের বাইরে নিয়ে যায় এবং চার দিন চার রাত ধরে নৈরাজ্য চালায়। মোঙ্গলরা নারীদেরকে পুরষদের থেকে আলাদা করে এবং বিভিন্ন পেশার কাজে দক্ষ চার’শ ব্যক্তি ও একদল শিশু-ছেলে ও  শিশু-মেয়েকে বন্দি করে বাদবাকি সবাইকে হত্যা করে। বলা হয় প্রত্যেক মোঙ্গল সেনা মার্ভের তিন’শ থেকে চার’শ ব্যক্তিকে হত্যা করে। নিহতদের লাশের স্তুপে উপত্যকার খানা-খন্দক বা গর্তগুলো ভরে যায়। মার্ভের ১৩ লাখেরও বেশি মানুষ মোঙ্গলদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিল। যেখানেই মোঙ্গলরা হামলা করে ওই অঞ্চলটি দখল করে সেখানে এই ছিল গণহত্যা ও নৈরাজ্যের অবস্থা।  

উল্লেখ্য  মোঙ্গলদের হামলারস সময়কার জনগণ  এইসব হামলাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো শাস্তি বলে মনে করত এবং মুসলমানরা এসব ঘটনার মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টি বা ইশারা রয়েছে মনে করে সন্তুষ্ট ছিল। চেঙ্গিজ খান নিজেও নিজেকে বিধাতার শাস্তির মাধ্যম বলে মনে করতেন যে শাস্তি বিধাতার ইচ্ছায় পাপীদের ওপর নেমে এসেছে!

বলা হয় চেঙ্গিজের সেনাদের হাতে বোখারা শহর দখলের পর সেখানকার ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকে চেঙ্গিজের সামনে আনা হয়। চেঙ্গিজ তাদের বলে: হে মানুষেরা! তোমরা বড় বড় পাপ করেছ। এইসব পাপ তোমাদের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা করেছেন। আমাকে প্রশ্ন কর যে কেন আমি এ কথা বলছি! এর কারণ আমি হলাম আল্লাহর আজাব। তোমরা যদি বড় বড় পাপ না করতে তাহলে খোদা আমার মত শাস্তি তোমাদের ওপর নাজেল করতেন না..।দুঃজনকভাবে জনগণ এসব কথা বিশ্বাস করত! তাই তারা মোঙ্গলদের হামলার ও নৃশংসতার জবাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলত না! তারা ভাবতো মোঙ্গলদের হাতে পরাজয় ঘটাই হচ্ছে মহান আল্লাহর ইচ্ছা ও তা ভাগ্যে নির্ধারিত হয়ে আছে! তাই প্রতিরোধ চালানো অসম্ভব ও অর্থহীন! এইসব ভুল চিন্তার কারণেই মোঙ্গলরা একের পর এক নানা দেশ ও অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়।

খাওয়রেজম অঞ্চলের সম্রাট ও তার সর্দাররা বেশিরভাগই ছিল তুর্কিদের কোনো না কোনো সম্প্রদায়ের অংশ। তাই তারা ইরান ও ইরানিদের জন্য দুঃখ অনুভব করত না। বেশিরভাগ যুদ্ধেই খাওয়ারেজমের শাসকগোষ্ঠী পিছু হটে শহরগুলোকে বিনা প্রতিরোধে মোঙ্গলদের হাতে তুলে দিত এবং কখনও কখনও বলত যে মোঙ্গলরা ও আমরা একই জাতির সম্প্রদায়! তাই তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করার দরকার নেই! যেমন, বাল্‌খে মোঙ্গলদের হামলার তিন দিন পরই রাতের বেলায় সবাই শহর ছেড়ে খোরাসানের দিকে পালিয়ে যায়।   বর্বর ও দরিদ্র মোঙ্গলরা দেখতে পেয়েছিল যে ইরান একটি ধনী ও সম্পদ-সমৃদ্ধ দেশ। তাই এখানে যুদ্ধ ও লুট করার দিকে তাদের ব্যাপক লোভ ছিল। ইরানে মোঙ্গলদের হামলার মূল কারণ ছিল অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল। খাওয়ারেজম শাহের শাসন-কর্তৃত্বের প্রতিশোধ নেয়া ও বিশ্ব জয় করা ছিল তাদের বাহ্যিক অজুহাত মাত্র। অকল্পনীয় নানা সম্পদে ভরপুর ইরানে হামলার আগে মোঙ্গলরা খুবই হত-দরিদ্র ছিল সেসবের বর্ণনা রয়েছে আতা মুলক্‌ যুইয়িনির লেখা দিক-বিজয় বা বিশ্ব জয়ের ইতিহাস শীর্ষক বইয়ে। 

মোঙ্গল হামলার ফলে ইরানি সমাজের ভিত্তিগুলো নড়বড়ে হয়ে পড়ে এবং দুর্বলতা, অধঃপতন ও অকর্মণ্যতার বিস্তার ঘটে। ফলে দেখা দেয় নানা ধরনের সামাজিক দুর্নীতি। ইরানে যে সুসভ্য ও সুশীল সমাজ-ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল তা ভবঘুরে মোঙ্গলদের হাতে ধ্বংস হয়। ধ্বংস হয়ে যায় অতীতের শাসক-শ্রেণী। নতুন করে গড়ে ওঠা এলিট বা অভিজাত সমাজ কেবল আপোস-রফাকেই মুক্তির পথ বলে মনে করতেন এবং আপোসের পথ ধরেই তারা ক্ষমতায় পৌঁছে। এইসব দুর্বলতার কারণে ইরানি সমাজেও মোঙ্গলদের অভ্যাস, বিশ্বাস ও কুসংস্কারগুলো ছড়িয়ে পড়ে।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন। 

ট্যাগ