অক্টোবর ০৫, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka
  • ইরানি মনীষী মুহাম্মাদ সামআনির  জীবন ও অবদান

আজ আমরা হিজরি ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের প্রখ্যাত ইরানি মনীষী আবু সাআদ আবদুল করিম বিন মুহাম্মাদ সামআনির জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

হিজরি ষষ্ঠ শতকের তথা খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি আলেম, ফক্বিহ বা ইসলামী আইনবিদ, মুহাদ্দিস, সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক আবু সাআদ আবদুল করিম বিন মুহাম্মাদ সামআনি হিজরি ৫০৬ সনের ২১ শাবান তথা ১১১৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি ইরানের খোরাসানের মার্ভ সংলগ্ন অঞ্চলে এক উচ্চ শিক্ষিত ও ধার্মিক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। সামআন নামটি তামিম অঞ্চলের একটি এলাকার নাম। সামআনিদের পূর্ব প্রজন্মের সবাই ছিলেন এ এলাকার অধিবাসী। সামআনির বয়স যখন মাত্র তিন বছর তখন তার বাবা তাকে প্রাথমিক শিক্ষা দানের জন্য নিশাপুরে নিয়ে যান। এই পদক্ষেপের এক বছর পরই তার বাবা মারা যান। ফলে সামআনির শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নেন তারই কয়েকজন চাচা।  সামআনি বংশের সবাই ছিলেন উচ্চ শিক্ষিত ও গুণী।

সামআনির চাচা আবু মুহাম্মাদ হাসান বিন আবিল মুজাফ্ফর সামআনি ছিলেন একজন পরহিজগার আলেম। যুবক সামআনি তার এই চাচার কাছে বিভিন্ন বিষয়ের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই পড়েছিলেন। তিনি তার ছোট চাচা আবুল কাসেম আহমাদ বিন মানসুর সামআনির কাছে ইসলামী আইন ও হাদিস শাস্ত্র পড়েন।

সামআনির বোনও ছিলেন উচ্চ-শিক্ষিত আলেম ও গুণী এবং তিনি হাদিস বর্ণনার জন্য বাগদাদের একজন বড় আলেমের অনুমতি পেয়েছিলেন। এই বোনের কাছ থেকেও অনেক হাদিস ও কাহিনী রপ্ত করেছিলেন সামআনি।

আবি শুজাঅ আমর্‌ বিন আবিল হাসান বাস্তামির মত প্রখ্যাত শিক্ষকের ছাত্র ছিলেন সামআনি। এই মহান শিক্ষকের অনুপ্রেরণাতেই তিনি আল আনসাব শীর্ষক বইটি লেখা ও এর জন্য গবেষণার কাজ শুরু করেছিলেন। বিখ্যাত অনেক শিক্ষকের কাছে পড়াশুনা করা ছাড়াও সামআনি হাদিস সংগ্রহ ও এ বিষয়ে গবেষণার জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বহু সফর করেছিলেন। তিনি ইস্ফাহান, খোরাসান, হামেদান, ট্রান্স-অক্সিয়ানা, ইরাক, হেজাজ, সিরিয়া ও ইরানের উত্তরাঞ্চলের তৎকালীন রাজ্য ত্বাবারেস্তানে বার বার সফর করেছিলেন।

ইবনে নাজ্জার লিখেছেন, সামআনি সাত হাজার পণ্ডিতের কাছ থেকে হাদিস শুনেছেন। হাদিসের প্রতি ছিল তার গভীর ভালবাসা। তিনি সাহেব বিন ইবাদ নামের জনৈক মন্ত্রীর একটি কথা উদ্ধৃত করেছেন যেখানে ওই মন্ত্রী বলেছেন, যে হাদিস লেখেনি সে ইসলামের সুমিষ্টতা আস্বাদন করেনি।

সামআনির জীবনী সম্পর্কে খুব কম তথ্যই জানা যায়। অবশ্য তার রেখে যাওয়া কয়েকটি বই তার নামকে অমর করে রেখেছে। সামআনি ৫৬২ হিজরি মোতাবেক ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। বহু শহর, দেশ ও অঞ্চল সফর করে অনেক জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন সামআনি। তিনি অনেক বই লিখেছিলেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বইটির নাম আল আনসাব। বইটি আনসাবে সামআনি নামেও খ্যাত। তারিখে মার্ভ বা মার্ভের ইতিহাস তার আরেকটি বিখ্যাত বই। সামআনি খত্বিব বাগদাদির লেখা বিখ্যাত বই তারিখে বাগদাদের সম্পূরক একটি বইও লিখেছিলেন।

সামআনির বই আল আনসাব হিজরি ষষ্ঠ শতকের অন্যতম প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ বই। আবি শুজা'অ আমর্‌ বিন আবিল হাসান বাস্তামির উৎসাহ পেয়ে তিনি ৫০৫ হিজরিতে তথা ১১৫৫ খ্রিস্টাব্দে বইটি লেখা শুরু করেন। দিনটি ছিল শুক্রবার। মূলত আরব জাতির বংশ পরিচয় সংক্রান্ত  ৮ খণ্ডের এ বইটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের নানা তথ্যের সমাহার।

আবু সাআদ সামআনির আল আনসাব বইটিতে আরব ব্যক্তিবর্গ ও নানা গোত্রের বংশধারার পরিচয় ছাড়াও ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট শহরগুলোর পরিচিতি, ইতিহাস ও ভূগোল সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সামআনি এসব তথ্য নানা সফরের সময় সংগ্রহ করেছিলেন। এইসব সফরে তিনি অনেক জ্ঞানী-গুণী ও পণ্ডিতদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন নানা উদ্দেশ্যে। বইটিতে ইরান, ট্রান্স অক্সিয়ানা ও মধ্য-এশিয়া অঞ্চলের ইতিহাস ও ভূগোলসহ নানা বিষয়ে খুব নিখুঁত ও নির্ভরযোগ্য তথ্য দেয়া হয়েছে। বইটি এসব বিষয়ে একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী আকর-গ্রন্থ। এ বইয়ে  বিভিন্ন বিষয়ে লেখা অন্য অনেক বই ও লেখকদের নাম ও পরিচয়ও তুলে ধরা হয়েছে যা অন্য বই বা উৎসগুলোতে স্থান পায়নি। এ জন্য সামআনিকে অনেক দূর দূরান্তে বহু সফরের ধকল সইতে হয়েছে। তিনি ছোট-বড় অনেক শহরে বহু বই দেখেছেন কিংবা সেইসব বই সম্পর্কে শুনেছেন এবং অনেক হাদিস শাস্ত্রবিদ ও গবেষকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আর এইসব সাক্ষাৎ ও গবেষণার ফলই হল আল আনসাব বইটি।

সামআনি যেসব বইয়ের নাম উল্লেখ করেছেন তার আল আনসাব বইয়ে সেসব পবিত্র কুরআনের তাফসির, কুরআন বিষয়ক জ্ঞান, সংস্কৃতি, ইরফান, ইতিহাস, ভ্রমণ-কাহিনী ও কাব্য সংক্রান্ত বই। এসব বইয়ের বেশিরভাগই বর্তমানে আর নেই এবং এমনকি বই-পরিচিতি সংক্রান্ত নানা উৎসেও এসব বইয়ের নাম দেখা যায় না। সামআনির আল আনসাব বইটি বের হওয়ার পরই তা গবেষক মহলে ব্যাপক সাড়া জাগায়। অনেকেই বইটির ব্যাখ্যা লিখেছেন এবং কেউ কেউ বইটিকে সংক্ষিপ্ত রূপে লিখেছেন। ইবনে আল আসির সামআনির এ বইটিকে সংক্ষিপ্ত করে ও কোনো কোনো টিকা বা ব্যাখ্যা যুক্ত করে তিন খণ্ডের এক নতুন বই প্রকাশ করেন। তার এ বইটির নাম আল লুবাব। সিয়ুতিও সামআনির বইটিকে সংক্ষিপ্ত করেন এবং তাতে মু'জামুল বুলদানের মত কোনো কোনো বই থেকে নেয়া নতুন কিছু বিষয় যুক্ত করে একটি নতুন বই লেখেন। আরও অনেক লেখক একই ধরনের পদ্ধতিতে সামআনির আল আনসাব বইকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন বিখ্যাত বই লিখেছেন।

সামআনির আল আনসাব বইটিতে নানা শহর, গোত্র ও গ্রামের বর্ণনা দেয়া হয়েছে আরবি বর্ণমালার ধারাক্রম অনুযায়ী। এরপর ওইসব  শহর বা গ্রাম বা গোত্রের বিখ্যাত ব্যক্তি, আলেম বা পণ্ডিতদের জীবনী তুলে ধরা হয়েছে। এ বইয়ের ভূমিকায় সামআনি বংশ পরিচয় জানা ও বংশের লোকদের সঙ্গে বা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কিত মহানবীর (সা) হাদিস উল্লেখ করেছেন। সামআনি বইয়ের শুরুতেই মহানবী (সা)'র বংশধারার পরিচয় ও উৎস মূল তুলে ধরেছেন তাবাররুক হিসেবে। এরপরে বনি হাশিম ও কুরাইশ বংশের পরিচিতি ও উৎসমূল বর্ণনা করেছেন। সবশেষে আরবের নানা গোত্রের বংশ পরিচয়ের বিবরণ দিয়েছেন। এ বইয়ে মৌখিক বর্ণনা ছাড়াও নিজের ভ্রমন ও সফর থেকে অর্জন করা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং নিশাপুর, বাগদাদ ও বোখারার ইতিহাস সংক্রান্ত পৃথক বইগুলোসহ শত শত বইয়ের তথ্যকে কাজে লাগিয়েছেন সামআনি। #

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।