অক্টোবর ০৮, ২০২০ ১৮:৩০ Asia/Dhaka

গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি চিত্র শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানির জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

মধ্যযুগের ইরানি চিত্র শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানি অনেক অসাধারণ চিত্র-কর্ম উপহার দিয়ে গেছেন। তাঁর নামে প্রচলিত শিল্পকর্মের সংখ্যা অনেক বলা হলেও গবেষকরা মনে করেন এসবের মধ্যে সুলতানির আসল শিল্পকর্মের সংখ্যা ৩২টি। তাঁর শিল্প-তৎপরতার সবচেয়ে সৃষ্টিশীল দশটি বছরে তিনি এইসব ছবি এঁকেছেন। সুলতানির আঁকা সবচেয়ে সুন্দর ছবিগুলোর কয়েকটি দেখা যায় শেখ সা'দির 'বুস্তান' (ফলের উদ্যান) শীর্ষক কাব্যের একটি হস্তলিখিত কপিতে। সাজ-সজ্জা হিসেবে আঁকা এই ছবিগুলোসহ বইটি রয়েছে মিশরের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে তথা কায়রোর দারুল-কিতাব লাইব্রেরিতে। এ বইয়ে রয়েছে সুলতানির ছয়টি চিত্রকর্ম। অবশ্য এই ছয়টি ছবির মধ্যে কেবল চারটিতে তার স্বাক্ষর রয়েছে।

নিজামির ‘খামসেহ’ নামক কাব্যের দু’টি পুরনো সংস্করণেও রয়েছে বেহয’দ সুলতানির ১৮টি চিত্রকর্ম। হাতে লেখা বইয়ের ওই দুটি কপির মধ্যে তিনি এঁকেছিলেন এসব ছবি। বই দুটি ব্রিটেনের  রয়্যাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে। সুলতানির ব্যাপক খ্যাতি থাকায় কয়েক শতাব্দি ধরে বহু শিল্পী তাঁর চিত্রকর্মগুলোর অনুসরণ করেছেন। ফলে তাঁর নামে প্রচলিত বহু চিত্রকর্মের মধ্যে ঠিক কোন্ ছবিগুলো তাঁর নিজের হাতের আঁকা তা নির্ধারণ করা দূরহ কাজ হয়ে পড়েছে। অবশ্য এ ব্যাপারে গবেষণা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৩১ সালে লন্ডনে ইরানি শিল্পকর্মের প্রদর্শনীর আয়োজন এ কাজে কিছুটা সুফল বয়ে এনেছে।  

সুলতানি বাস্তব দৃশ্যেরই ছবি আঁকতেন বলে মনে করা হয়। এসব দৃশ্যে থাকে নানা বিষয় ও ব্যক্তির সমাহার। তাঁর নামে প্রচলিত বহু ছবির অনেকগুলোই তার নিজের হাতে আঁকা না হলেও তাঁরই প্রবর্তিত ধারার অনুসরণে আঁকা হয়েছে।

হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি চিত্র শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানির চিত্রকলার প্রতিভা বিকশিত হয়েছে হেরাতি ঘরানায়। তবে তিনি নিজেই ইরানি চিত্রশিল্পের ঐতিহ্যে এনেছেন গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ও তাতে যোগা করেছেন নানা নতুনত্ব। নানা ধরনের রংয়ের অপূর্ব সমন্বয় ও ছবির নানা কাঠামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মত দক্ষতার কারণেই তা সম্ভব হয়েছে। নানা ধরনের আকার দেয়ার মত আঁকআঁকি বা নানা ধরনের শক্তিশালী ও সৃজনশীল দাগের মাধ্যমে সুলতানি নির্জীব ও একঘেঁয়ে চিত্রকলার মধ্যে প্রাণ ও গতিশীলতার সঞ্চার করেছেন। তাঁর অসাধারণ তুলিতে প্রকৃতি ও স্থাপত্য শিল্প হয়ে উঠেছে কর্মমুখর মানুষের উপস্থিতিতে প্রাণচঞ্চল ও সরগরম। তাঁর এইসব ছবিতে প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য রয়েছে যথাযথ স্থান। নানা রংয়ের মধ্যে যে কনট্রাস্ট বা বৈপরীত্য তা সুলতানির আঁকা ছবিগুলোর নানা অংশকে পরস্পরের সঙ্গে করেছে সুসম্পর্কিত।

সুলতানি তাঁর চিত্রকর্মের নানা আকৃতি বা গঠনে জ্যামিতি শাস্ত্রের জ্ঞানকেও কাজে লাগিয়েছেন। ফলে তাঁর ছবির কাঠামোগুলো হয়েছে জোরালো এবং তাঁর ছবিতে থাকা মানুষ বা ব্যক্তিগুলো, বস্তু ও পরিবেশের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে যৌক্তিক ও কার্যকর সম্পর্কের সুদৃঢ় যোগসূত্র বা বন্ধন। ইরানি চিত্রশিল্পে এসব সাফল্যই ছিল অভিনবত্ব ও নতুনত্বে ভরপুর।

সুলতানির ছবিগুলোতে চলন্ত বা গতিশীল বস্তুর জন্য শুন্য স্থানের ব্যবহার দারুণ আকর্ষণীয়। তাঁর ছবিতে বস্তু ও আকৃতি বা ফিগারগুলোর অবস্থা যে কেবলই বাস্তব তা নয় একইসঙ্গে তা যেন জীবন্ত ও সবাক। সুলতানির এসব ছবি দেখে দর্শক যেন নিজেই গতিশীল হয়ে পড়েন যাতে ছবির ভেতরকার লুকানো সৌন্দর্যগুলো উদঘাটন করা যায়।   

হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি চিত্র শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানির ছবিগুলো বর্ণনামুখী। মানবীয় নানা বৈশিষ্ট্য তাঁর ছবিগুলোতে পেয়েছে বর্ণাঢ্যতা ও সূক্ষ্মতা। বিশ্লেষকরা বলেন সুলতানি ইরানি চিত্রকলায় নিয়ে এসেছেন প্রকৃতি-প্রেম ও বাস্তবমুখিতা। আলো ও আঁধারের খেলা বা কনট্রাস্ট দিয়ে তিনি তার যুগের অন্য চিত্রশিল্পীদের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর ও সুশৃঙ্খল চিত্রকলা উপহার দিতে সক্ষম হয়েছেন।

সুলতানির আঁকা খাওয়ারনাক্ব প্রাসাদ নির্মাণের ছবি তাঁর এক অভিনব ও অমর চিত্রশিল্প। অনন্যসুন্দর এ ছবিতে তিনি যেন ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর বাস্তব দৃশ্য তুলে ধরেছেন। জীবনের বাস্তবধর্মী প্রকাশগুলোই ফুটে উঠেছে তার এই সৃষ্টিশীল ছবিতে। এ ছবিতে মানুষের কাজ, জীবন ও পরিবেশ খুব সূক্ষ্মভাবে ও গভীর দৃষ্টিতে মূর্ত হয়েছে। যেমন, প্রাসাদটি নির্মাণে শ্রমিকদের নানা ধরনের কাজের শ্রমবিভাগ খুব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সুলতানির চিত্রকলায় দৃশ্যের বাস্তবধর্মিতার বেদীতে কখনও আধ্যাত্মিক বা নৈতিক তাৎপর্যের দিকগুলোকে বলি দেয়ার অবকাশ নেই। ফলে তার বাস্তবধর্মিতা ইউরোপীয় চিত্রশিল্পের বাস্তবধর্মিতার মত নয় মোটেই।

ছবিতে রং ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সুলতানির দক্ষতা ছিল অসাধারণ। তিনি যেন রংয়ের মনস্তাত্ত্বিক ব্যবহার খুব ভালভাবেই জানতেন। সবুজ ও নীলের মত শীতল রঙগুলোর উপযুক্ত ব্যবহার ও কমলা রংসহ নানা ধরনের গরম রংয়ের ব্যবহারের মাধ্যমে ছবিতে ভারসাম্য আনার বিষয়ে সুলতানির দক্ষতা ছিল বিস্ময়কর।  

হিজরি নবম শতকের তথা খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি চিত্র শিল্পী কামালউদ্দিন বেহয'দ সুলতানির জীবন ও অবদান  নিয়ে আমাদের আলোচনা এখানেই শেষ করছি। # 

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ০৮

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।