প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) পর্ব-২১
গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি মার্কিন গবেষক ও চিন্তাবিদ উইল ডুরান্ট ইসলামী সভ্যতার ব্যাপক বিস্ময়কর সাফল্য এবং অবদান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে প্রশংসাসূচক অনেক মন্তব্য করেছেন।
তার মতে মানবজাতির ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছেন মুহাম্মাদ (সা)। আর তাই বিশ্বের মহাপুরুষদের মধ্যেও শ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ হলেন হযরত মুহাম্মাদ (সা)। মহানবীর (সা) মহানুভবতা ও প্রতিভার নানা দিক ছাড়াও ইসলামী সভ্যতা ও মহানবীর সাফল্যের অন্যতম প্রধান দিক হিসেবে পবিত্র কুরআনও ডুরান্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইসলাম ও মহানবীর (সা) মাধ্যমে যে বিশ্বে এত ব্যাপক পরিবর্তন ও দ্রুত উন্নতির অনন্য ঘটনা ঘটেছে তার অন্যতম প্রধান চালিকা শক্তি হল পবিত্র কুরআন। এই মহাগ্রন্থ মহানবীর চিরন্তন ও সবচেয়ে বড় মু'জিজা বা অলৌকিকতা। উইল ডুরান্ট এ প্রসঙ্গে লিখেছেন:
'মহানবীর গ্রন্থ কুরআনে আইন ও নৈতিকতা একই বিষয়। কুরআনের উল্লেখিত পার্থিব আচার-আচরণও ধর্মীয় আচার-আচরণের আওতাভুক্ত। কুরআনের সব বিষয়ই মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে মুহাম্মাদের ওপর নাজিল হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আদব-কায়দা সংক্রান্ত বিষয়, বিয়ে, তালাক, সন্তান ও জীব-জন্তু এবং দাসদের সঙ্গে আচরণ, বাণিজ্য, রাজনীতি, সুদ, ধর্ম, চুক্তি, ওসিয়ত, যুদ্ধ, শান্তি, সম্পদ, নানা পেশা ও অন্য অনেক বিষয়ে বিধান ও দিক-নির্দেশনা রয়েছে। আসমানি এই মহাগ্রন্থ মুসলমানদের আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিকে উন্নত করেছে এবং তাদের মধ্যে সামাজিক শৃঙ্খলা ও ঐক্য সুদৃঢ় করেছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিধি-বিধান মেনে চলতেও উৎসাহ দিয়েছে পবিত্র কুরআন।

ডুরান্ট আরও লিখেছেন: এই আসমানি মহাগ্রন্থ মুসলমানদের মন-মগজকে বহু ধরনের অলীক কল্পনা, কুসংস্কার, জুলুম ও সহিংসতা থেকে মুক্তি দিয়েছে। এ মহাগ্রন্থ অমার্জিত ও বর্বর স্বভাবের মানুষকে সংশোধন করে তাদের এনে দিয়েছে সম্মান এবং আত্মবিশ্বাস। এই মহাগ্রন্থ মুসলমানদের মধ্যে এনেছে ন্যায়বিচার ও ভারসাম্য এবং খোদাভীতি যা শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত পাশ্চাত্যের কোথাও দেখা যায়নি। কুরআন মানুষকে এ শিক্ষা দিয়েছে যে কোনো অভিযোগ ও তিরস্কার না করেই জীবনে সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে এবং সীমাবদ্ধতা বা অভাবগুলো সহ্য করতে হবে। একইসঙ্গে কুরআন মুসলমানদেরকে উন্নয়ন ও অগ্রগতি অর্জনে উৎসাহ দেয়ায় মুসলমানরা বিশ্বের ইতিহাসে নানা ধরনের বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করেছে।
অতীতের নবী-রাসুলদের পাঠানো হয়েছিল বিশেষ কোনো অঞ্চল বা সেখানকার কোনো কোনো জাতিকে সুপথ দেখানোর লক্ষ্যে। কিন্তু বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)-কে পাঠানো হয়েছে গোটা মানবজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে। আর এ জন্যই পবিত্র কুরআনের সুরা আম্বিয়ার ১০৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন: আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্যে রহমত হিসেবেই পাঠিয়েছি।
বিংশ শতকে মহানবীর (সা) জীবন সম্পর্কে গবেষণা করেছেন এমন অমুসলিম মনীষীদের ফিলিপ খুরি হিট্টি তথা পি কে হিট্টি অন্যতম। হিট্টি বা হিত্তি লেবাননি আরব হলেও মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়ে লেবাননের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যাপনা করতেন। 'আরবজাতির ইতিহাস' শীর্ষক তার বইটি ১৯৩৯ সালে প্রকাশ করা হয়। এ বইটির পুরো অষ্টম অধ্যায় জুড়ে রয়েছে মহানবীর (সা) জীবন, অবদান ও সাফল্যের বর্ণনা।
পি কে হিট্টি লিখেছেন, 'মহানবীর (সা) আহ্বান ছিল সত্যিই বনি ইসরাইলের নবীদের আহ্বানের মতই যেমনটি ওল্ড টেস্টামেন্টে ইসরাইল বংশের নবীদের নাম এসেছে। শুরু থেকেই মহানবীর মিশনের বক্তব্য ছিল এটা যে আল্লাহ এক এবং তিনি সর্বশক্তিমান ও বিশ্ব-জগতের সব কিছুর স্রস্টা ও বিচার-দিবসের মালিক ... মুহাম্মাদের জীবন ছিল খোদায়ি উৎসে ভরপুর এবং তিনি মহান আল্লাহর রাসুল হিসেবে নিজ দায়িত্ব পালন করতেন তীব্র অনুরাগ ও উৎসাহ নিয়ে। তিনি আরবের গোত্রগুলোর মধ্যে উপস্থিত হয়ে তাদেরকে নানা বিষয় শিক্ষা দিয়েছেন ও সতর্ক করেছেন।' (বাজনা)
পি কে হিট্টি উল্লেখ করেন, মহানবীর (সা) প্রচেষ্টা ও দৃঢ়তার কারণে ধীরে ধীরে তাঁর সহযোগী বা সঙ্গীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং ইসলামের পথে তিনি নিজে ও তাঁর সঙ্গীরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হন। এ প্রসঙ্গে হিট্টি লিখেছেন, নির্যাতনের ঘোর কালো দিনগুলো মুহাম্মাদের (সা) সঙ্গীদের জন্য অস্থায়ী ক্ষতি বয়ে আনলেও মুহাম্মাদের সাহসিকতায় তা কোনো ফাটল ধরাতে পারত না। সব বাধা সত্ত্বেও তিনি ইসলামের আহ্বান অব্যাহত রেখেছেন। তিনি চাইতেন যাতে মানুষেরা মিথ্যা প্রভুগুলোর উপাসনা ছেড়ে প্রকৃত এক খোদার ইবাদত করতে উৎসাহী হয়। ফিলিপ হিট্টি তার এ বিখ্যাত বইয়ে আরও লিখেছেন,
'মুহাম্মাদ (সা) ক্ষমতার শীর্ষ অবস্থানে থেকেও সেভাবেই জীবন যাপন করতেন যেভাবে ক্ষমতাহীন অবস্থায় জীবন যাপন করতেন। তাঁর জীবন ছিল সহজ-সরল ও কপটতামুক্ত। সামান্য যে অর্থ মৃত্যুর সময় তাঁর কাছে সঞ্চিত ছিল তা তিনি সরকারি কোষাগারে দান করে যান। তিনি প্রতিদিন যেসব কাজ করতেন তা গুরুত্বপূর্ণ ও ছোটোখাটো যে কাজই হোক্ না কেন সেসব এমনই বৈধতা পেয়েছে যে আমাদের যুগেও প্রতিদিন কয়েক মিলিয়ন মানুষ অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সেইসবকে মেনে চলছে ও অনুকরণ করছে। মুহাম্মাদ (সা)-কে যেভাবে পরিপূর্ণ আদর্শ মানুষ হিসেবে দেখা হয় ও তাঁর সব কাজকেই যেভাবে খুব নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হয় মানবজাতির মধ্যে সেরকম আর কেউ নেই। তিনিই একমাত্র পরিপূর্ণ মানুষ যার ছোটো ও বড় আচরণগুলো ও বক্তব্যগুলো আইনে পরিণত হয়েছে এবং বিশ্বের কোটি কোটি মুসলমান এখন সেসব আইন মেনে চলছে বা অনুসরণ করছে।'
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।