অক্টোবর ২৪, ২০২০ ১৫:৪৮ Asia/Dhaka

গত দুই পর্বের আলোচনায় আমরা লেবাননি খ্রিস্টান প্রাচ্যবিদ ফিলিপ কে হিট্টির দৃষ্টিতে মহানবীর (সা) জীবন ও অনন্য সাফল্যের নানা দিক সম্পর্কে জেনেছি।

বিংশ শতকে মুসলিম ভূখণ্ডগুলোতে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের সফর ও আসা-যাওয়া বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতা সম্পর্কে তাদের ধারণা আগের চেয়েও স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। ফলে ইসলাম ও মহানবীর (সা) প্রতি পশ্চিমাদের আকর্ষণ বাড়তে থাকে। ইসলামকে তাদের কাছে একটি অকৃত্রিম ও মানবীয় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ধর্ম বলেই মনে হতে থাকে যখন তারা দেখতে পায় যে এ ধর্মের রয়েছে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট চিন্তাধারা ও আধ্যাত্মিক, মানবিক এবং নৈতিক মূল্যবোধ। জার্মান কবি ও লেখক রাইনার মারিয়া রিল্কে নবী মুহাম্মাদের শিক্ষাগুলোর প্রভাবে আকৃষ্ট হয়ে বলেছিলেন, এ ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে খোদার রয়েছে সরাসরি সম্পর্ক এবং আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কের জন্য ইসলামে কোনো মধ্যস্থতাকারীর দরকার হয় না।

১৯৫০-এর দশক থেকে একদল পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ পাশ্চাত্যের পুরনো ইসলাম-বিদ্বেষী চিন্তাধারার নাগপাশ থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী তথ্যের আসল উৎসগুলোকেই গুরুত্ব দিতে থাকেন। তারা নিজ নিজ ভাষায় কুরআন অনুবাদের পর এটা বুঝতে পারেন যে ইউরোপের প্রচলিত পুরনো ধারণাগুলোর বিপরীতে নবী মুহাম্মাদ (সা) একজন অনন্য মহাপুরুষ, শ্রেষ্ঠ ও মহৎ মহামানব ছিলেন। এরই প্রেক্ষাপটে ইসলামের সামাজিক ও ধর্মীয় চিন্তাগুলোকে তারা নিরপেক্ষভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। ফলে তাদের বিশ্লেষণের ফলাফল হয়েছে অতীতের প্রাচ্যবিদদের তুলনায় অনেক বেশি বাস্তবধর্মী। ইসলামকে পাশ্চাত্যের কাছে আরও সঠিকভাবে তুলে ধরার কাজে শরিক এই বিশেষজ্ঞদেরই একজন হলেন খ্রিস্টান ইতিহাসবিদ জন বয়ার নস্‌।

জন বয়ার নস্‌ ‘বিশ্বের ধর্মগুলোর ইতিহাস’ শীর্ষক তার বিখ্যাত বইয়ে অতীতের ধর্মগুলোর উৎপত্তির ইতিহাস ও ইসলাম ধর্মের উদ্ভবের প্রেক্ষাপট বিষয়ে নানা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং আকর্ষণীয় ও প্রামাণ্য অনেক তথ্য তুলে ধরেছেন।

ইসলাম ধর্মের দ্রুত ও ব্যাপক বিস্তারের কারণে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের মানুষের মনে এর স্থায়ী প্রভাবের কথা উল্লেখ করে জন বয়ার নস্‌ লিখেছেন, প্রথম শতকে ইসলাম ছড়িয়ে পড়ছিল আগুনের এমন শিখার মত অতি দ্রুত গতিতে যে যারা এর বিরোধী ছিল তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বা করণীয় কি তা ভাবার আগেই এই আগুনের জোয়ারের শিকার হত।

জন বয়ার নস্‌-এর মতে ‘ইসলাম হচ্ছে সহজ-সরল ধর্ম, কিন্তু এর বিধি-বিধান খুবই মজবুত। তিনি লিখেছেন, ইসলাম তার অনুসারীদের চিন্তাধারাকে হাজার হাজার বইয়ের পাতায়, দর্শন শাস্ত্রের পাতায় ও হাজারো জটিল বিষয়ের মধ্যে জরাজীর্ণ করে না। এ ধর্মের রয়েছে একটি মৌলিক বই যা তার সূচনালগ্ন থেকে এখনও অবিকৃত ও অক্ষত রয়েছে। ফলে কুরআনের ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক ও মতভেদ দেখা দেয়নি।... আর কুরআনে যা নেই এমন কিছু যদি মহানবীর (সা) প্রথা বা সুন্নাতের সঙ্গে না মিলে তাহলে তার মূল্য নেই...আর এ কারণেই ইসলাম এত গৌরবময় এবং অতীতের ধর্মগুলোতে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল কুরআন তা শুধরে দিয়েছে ও পরিপূর্ণ করে দিয়েছে।

জন বয়ার নস্‌-এর মতে ইসলামের মহত্ত্ব ও গৌরবগুলো মহানবীর (সা) সাধনা ও প্রচেষ্টারই সুফল। তার মতে ইয়াতিম মুহাম্মাদকে (সা) যারা প্রতিপালন করে বড় করেছেন তারা দু’জনই তথা দাদা আবদুল মুত্তালিব ও চাচা আবু তালিব ছিলেন মক্কার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তারা মুহাম্মাদকে (সা) উন্নত নৈতিকতা ও সততার গুণে অভ্যস্ত করে বড় করেছেন। ... মুহাম্মাদ (সা) যখন যুবক তখন সমাজের প্রচলিত অনেক বিশ্বাস, আচার ও প্রথা নিয়ে গভীর ভাবনায় মশগুল হন এবং তিনি এসবকে নিন্দনীয় ও অগ্রহণযোগ্য মনে করতেন। মুহাম্মাদ (সা) দেখতেন যে কুরাইশ নেতারা কিভাবে ধর্মীয় স্বার্থ ও গোত্রীয় অহংকারের প্রশ্নে পরস্পরের সঙ্গে প্রায়ই যুদ্ধ ও বিবাদে মেতে থাকত! মহানবীর (সা) কাছে এসব ভালো লাগত না! বিশেষ করে মূর্তি-পূজা, শির্ক ও কল্পিত আত্মা সংক্রান্ত নানা কুসংস্কার দেখে তিনি নাখোশ হতেন। মদপান, জুয়া, নাচ ও নানা ধরনের অশালীন অনুষ্ঠান ও কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেয়ার মত প্রথাগুলো তার মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও ঘৃণা সৃষ্টি করত। এসবের সমাধান নিয়ে মুহাম্মাদ নির্জনে, মরু-প্রান্তরে ও পাহাড়ে গিয়ে গভীরভাবে ভাবতেন। এভাবে প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে মুহাম্মাদ আত্মিক পরিবর্তনের পূর্ণতার স্তরে পৌঁছেন।

জন বয়ার নস্ মহানবীর নবুওতের আনুষ্ঠানিক সূচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন: জিব্রাইল যখন প্রথমবার মহানবীর কাছে ওহি নিয়ে আসে তখন তিনি যা দেখেছেন তার অন্তর তা অস্বীকার করেনি, কিন্তু ওহীর বা দায়িত্বের ভার তিনি বহন করতে পারবেন না বলে ভয় পাচ্ছিলেন। ... পেরেশান অবস্থার পর মুহাম্মাদ নিজেকে সামলাতে সক্ষম হন ও অলৌকিক ক্ষমতার বলে সত্য নবুওত ও রেসালাতের দায়িত্ব পেলেন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। অর্থাৎ এক খোদার পক্ষ থেকে তিনি রাসুল হলেন যে খোদাকে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা ভিন্ন নামে ডাকে। ওহি অব্যাহত থাকায় আরব ভূখণ্ড আসমানি কিতাবধারী হল। যে বই নতুনত্ব, সত্য ও নির্ভুলতার দিক থেকে ইহুদি ও খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ থেকে উন্নত বা শ্রেয়।

জন বয়ার নস্ উল্লেখ করেন যে মহানবীর (সা) রেসালত আরবদের চিন্তা ও আচরণে মৌলিক পরিবর্তন এনেছিল। তিনি রক্তপাত ছাড়াই মক্কা জয় করেন ও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।

এ খ্রিস্টান ঐতিহাসিক আরও লিখেছেন, এ সময় এটা প্রতিষ্ঠা পায় যে মুহাম্মাদ (সা) ধর্ম ও রাজনীতির বিষয়ে গোটা আরব ভূখণ্ডে বিজয় অর্জন করেছেন। হিজাজের আশপাশে যারা বিদ্রোহী ও বিরোধী ছিলেন তারাও মুহাম্মাদের (সা) সামনে নতজানু হল। তিনি দূরের গোত্রগুলোর কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠালেন ও সেসব গোত্রে নিজ প্রতিনিধিদল পাঠান যাতে তারা ইসলাম গ্রহণ করতে পারে।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।