অক্টোবর ২৬, ২০২০ ১৮:২৫ Asia/Dhaka

আমরা বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের দ্বিতীয় পর্বের ফলাফল সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আজ আমরা এই অভিযানের শেষ ধাপের বর্ণনা দেব।

অভিজ্ঞতা বলছিল, যুদ্ধ করার সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি’কে আরো বেশি স্বেচ্ছাসেবী সেনা নিয়োগ দিতে হবে। সেইসঙ্গে ট্যাংক ও কামানের মতো ভারী অস্ত্র সঙ্গে রাখতে হবে এবং যুদ্ধে পারদর্শী সৈন্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে। হালকা অস্ত্রে সজ্জিত পদাতিক সৈন্যসংখ্যা যত বেশিই হোক না কেন ইরাকি বাহিনীর মতো প্রশিক্ষিত শত্রুসেনার বিরুদ্ধে তা যথেষ্ট ছিল না।  ফলে সেনা কমান্ডাররা পরবর্তী অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন। বৈঠকে শহীদ হয়ে যাওয়ার সেনা কমান্ডারদের যোগ্য স্থলাভিষিক্ত নিয়োগের বিষয়টিও প্রাধান্য পায়। আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছে বলে যে খবর এসেছিল তা নিয়েও পর্যালোচনা করা হয়। বৈঠকে বেশিরভাগ ইরানি কমান্ডার একথাই বলেন যে, ইরাকি বাহিনী খোররামশাহর পুরোপুরি ত্যাগ করছে না এ কারণে যে, তারা তাদের সেনাদেরকে নিরাপদে এই শহর থেকে বের করে নেয়ার জন্য সময়ক্ষেপণ করছে।

তখন পর্যন্ত ইরানি যোদ্ধারা শত্রুসেনার কাছ থেকে আহওয়াজ শহরের দক্ষিণের পাঁচ হাজার বর্গকিলোমিটারেরও বেশি জায়গা পুনরুদ্ধার করতে এবং প্রায় সাত হাজার ইরাকি সেনাকে বন্দি করতে পেরেছিলেন। আর ইরানি যোদ্ধাদের মধ্যে চার হাজার ৭০০ জন শহীদ এবং ১৭ হাজার জওয়ান আহত হয়েছিলেন। কিন্তু তারপরও ইরানি জনগণ খোররামশাহর পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেছিল। ফলে ইরানি সেনা কমান্ডাররা যেকোনো উপায়ে এই শহর শত্রুমুক্ত করার সংকল্পে অটল ছিলেন। যদিও ততক্ষণ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ দিন যুদ্ধ করে ইরানি সেনাবাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল এবং তাদের যুদ্ধ করার ক্ষমতাও কমে এসেছিল। কিন্তু তারপরও আল্লাহর সাহায্য নিয়ে অভিযানের চূড়ান্ত পরিণতি অর্জন অর্থাৎ খোররামশাহর পুরোপুরি শত্রুসেনামুক্ত না করা পর্যন্ত ইরানি যোদ্ধারা স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।

ওদিকে ইরাকি বাহিনীও তখন অনেক বেশি পর্যুদস্ত ও হতবিহ্বল অবস্থায় ছিল। কাজেই ওই অবস্থায় খোররামশাহরকে মুক্ত করতে না পালে ইরাকি সেনারা শহর রক্ষার জন্য নতুন উদ্যোমে শক্তি সঞ্চয় করতে পারত। তারা নতুন নতুন পরীখা ও টানেল খনন করে শহরের প্রতিরক্ষা জোরদার করত এবং শহরটিকে একটি অজেয় দূর্গে পরিণত করত। অভিযানের এই পর্যায়ে ইরানি যোদ্ধারা খোররামশাহরের পেছনে চলে গিয়ে দু’দেশের সীমান্তরেখা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। তারা এই সুযোগে পেছন দিক দিয়ে আক্রমণ চালিয়ে শহরটি পুনরুদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু সমস্যা যেটি ছিল তা হলো, অধিকাংশ ইরানি সৈন্য ছিলেন ক্লান্ত। কাজেই তাদের নতুন করে যুদ্ধক্ষেত্রে আগত যোদ্ধার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

আগ্রাসী ইরাকি সেনারা খোররামশাহরের ওপর দখলদারিত্ব বজায় রাখার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। তারা সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সেনাদের মনোবল চাঙ্গা রাখারও উদ্যোগ নেয়। খোররামশাহর দখলে রাখতে পারলে তারা কি কি সুবিধা ভোগ করতে পারবে- সেকথা বলে সাদ্দাম বাহিনীর সেনাদের মনোবল চাঙ্গা করার কাজ চলছিল।  ১৯৮২ সালের ২৩ মে অর্থাৎ ইরানি যোদ্ধাদের চূড়ান্ত হামলা শুরু আগের দিন ইরাকি বাহিনী খোররামশাহর ও এর আশাপাশে মোতায়েন নিজের সেনাদের কাছে একটি ঘোষণাপত্র বিলি করে। 

এতে খোররামশাহর ও এর আশপাশের এলাকাকে বাগদাদ ও তার আশপাশের এলাকা হিসেবে ধরে  নিয়ে তা রক্ষা করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করার নির্দেশ দেয়া হয়। ঘোষণাপত্রে খোররামশাহরকে একটি বালিশের সঙ্গে তুলনা করে বলা হয়, এটিতে মাথা পেতে বসরা নগরী ঘুমিয়ে আছে এবং এই শহর হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার অর্থ হবে ইরাকের জন্য বিপর্যয়ের দরজা খুলে যাওয়া। এ ছাড়া, ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম ইরানে মোতায়েন তার সেনা কমান্ডারকে এই বলে চিঠি দেয় যে, খোররামশাহরকে দখলে রাখতে না পারলে বসরার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

ক্লান্তি, অস্ত্রসস্ত্র ও রসদের সীমাবদ্ধতা এবং সৈন্যসংখ্যার ঘাটতি নিয়েই শেষ পর্যন্ত খোররামশাহরকে পুরোপুরি মুক্ত করার লক্ষ্যে বায়তুল মোকাদ্দাস অভিযানের চতুর্থ পর্ব শুরু হয়ে যায়। মধ্যরাতের পর শুরু হওয়া এ অভিযানে ফাতহ শিবিরের সৈন্যরা সকাল নাগাদ নগরীর প্রবেশপথে পুলিশের চেকপোস্ট উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। অন্যদিকে ফাজ্‌র শিবিরের যোদ্ধারা নয়া সেতু দখল করে আরভান্দরুদ নদীর দিকে অগ্রসর হন। আর সীমান্তের দিকে মোতায়েন নাসর শিবিরের সৈন্যরা দক্ষিণ দিক দিয়ে খোররামশাহরের দিকে এগিয়ে যান। এ অবস্থায় শহরটি ইরানি যোদ্ধাদের দ্বারা পুরোপুরি অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং বাইরের সঙ্গে শত্রু সেনাদের যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইরাকি বাহিনী ভেতর থেকে প্রতিরোধ চালিয়ে যায়।

এ সময় ইরাকের সেনাপ্রধান খোররামশাহরে মোতায়েন সেনা কমান্ডারদেরকে প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয় এবং তাদেরকে অস্ত্র ও রসদ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয়। বেতারে প্রদত্ত এসব নির্দেশনা ইরানি বেতারযন্ত্রে ধরা পড়ে। এ সময় সংগঠিত হয়ে পাল্টা হামলা চালিয়ে শহরের ওপর থেকে অবরোধ ভেঙে ফেলার আশায় আহওয়াজ-খোররামশাহর মহাসড়কে মোতায়েন ইরাকি সেনাদের সরিয়ে নেয়া হয়।  ১৯৮২ সালের ২৩ মে খোররামশাহরের ওপর অবরোধ আরো সংকীর্ণ করেন ইরানি যোদ্ধারা। তাদের হাতে বেশ কিছু শত্রুসেনা বন্দি হয়। ঠিক এ সময় খোররামশাহরে মোতায়েন ইরাকি বাহিনীর কমান্ডার ‘আহমাদ জেইদান’ মাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়। কমান্ডারের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে ইরাকি বাহিনী ছত্রভঙ্গ ও দিশেহারা হয়ে যায়। এ সময় কিছু ইরাকি সেনা আরভান্দ নদীতে ঝাঁপ দেয় নদী সাতরে ওপার গিয়ে ইরাকে পালিয়ে যাওয়ার আশায়। এদের মধ্যে অনেকে পানিতে ডুবে মারা যায়। কিছু সময় পরই শহরের লাউড স্পিকারগুলো থেকে ইরানি যোদ্ধাদের বিজয় ধ্বনি ভেসে আসে। যেসব ইরাকি সেনা পালিয়ে যেতে ব্যর্থ হয়েছিল তারা ইরানি সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পন করে।

১৯৮২ সালের ২৪ মে শহরের নানা প্রান্ত থেকে দুহাত উপরে তুলে দলে দলে ইরাকি সেনারা আত্মসমর্পন করতে থাকে। শত্রু সেনারা ভেবেছিল শহরের উত্তর, দক্ষিণ বা পূর্ব দিক দিয়ে ইরানি যোদ্ধারা হামলা চালাবে; এজন্য এই তিন দিকে তারা প্রতিরোধ ব্যুহ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তাদের ধারনা ব্যর্থ করে দিয়ে ইরানি যোদ্ধারা পশ্চিম দিক অর্থাৎ ইরাকি বাহিনী যেদিক দিয়ে এসে শহরটি দখল করেছিল সেদিক দিয়ে এসেই এটি পুনরুদ্ধার করেন। এভাবে ৩৪ দিনের প্রতিরোধ শেষে দখলদার ইরাকি সেনাদের হাতে যে শহরটির পতন হয়েছিল, ৫৭৫ দিনের দখলদারিত্ব শেষে তা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন ইরানি যোদ্ধারা। চূড়ান্ত অভিযান শুরুর ৪৮ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে খোররামশাহরে থাকা ইরাকি বাহিনী ধরাশায়ী হয়। ইরানি যোদ্ধারা শহর পুনরুদ্ধারের পরপরই নগরীর জামে মসজিদে শোকরানা নামাজ আদায় করেন।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ২৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ