প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) পর্ব-২৪
বিশ্ববাসীকে সৌন্দর্য, ঈমান, ভ্রাতৃত্ব ও প্রেমসহ জীবনের সবক্ষেত্রে সর্বোত্তম মানবীয় আদর্শ উপহার দানকারী মহামানব তথা শেষ নবী ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র শানে পেশ করছি অসংখ্য দরুদ ও সালাম।
পাশ্চাত্যে ইসলাম সম্পর্কে বিংশ শতকেও বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানগর্ভ ও বাস্তবতা-কেন্দ্রিক ব্যাপক গবেষণা অব্যাহত ছিল বলে আমরা গত কয়েকটি পর্বের আলোচনায় জেনেছি।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক হ্যামিল্টন এ আর গিব (১৮৯৫-১৯৭১) ইসলামের ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিষয়ের একজন বড় পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ। তিনি আরবি ভাষা ও সাহিত্য নিয়েও ব্যাপক গবেষণা করেছেন। তার বাবা-মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের অধিবাসী। আলেকজান্দ্রিয়াতে জন্মগ্রহণকারী গিব পড়াশুনা করেছেন স্কটল্যান্ডে। তিনি আরবি ভাষা ও ইসলাম সম্পর্কে গবেষণার জন্য ১৯২৬ সালে মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়া সফর করেন এবং খুব কাছ থেকে মুসলমানদের জীবনধারা লক্ষ্য করেন। ‘ইসলামী সভ্যতা সম্পর্কে ঐতিহাসিক পর্যালোচনা’ শীর্ষক তার একটি বই লন্ডন থেকে ১৯৪৯ সনে প্রকাশ হয়।
স্টাডিজ অন দ্য সিভিলাইজেশান অফ ইসলাম শীর্ষক এ বইয়ে গিব মহানবী (সা) সম্পর্কে লিখেছেন: এটা স্বীকার করতে হবে যে মুহাম্মাদ (সা)’র ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মগুলোর অশোভনীয় ও হাল্কা চালের কথাবার্তা এই ব্যক্তিত্বকে কঠিনভাবে পীড়া দিয়েছে!...নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন মহামানব। তিনি ছিলেন দুর্বল ও বঞ্চিতদের সহমর্মী বা দরদি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনম্র ও সৌজন্যপরায়ন। কেবল আল্লাহর প্রতি অবমাননাকর কোনো কিছু না দেখলে তিনি ক্রুদ্ধ বা কঠোর হতেন না।... তিনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে শালীনতা বজায় রেখে ঠাট্টাও করতেন। নিজ সমাজের মানুষকে শিক্ষিত করা ও উন্নত করা ও তাদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতা চালু করা ছিল তাঁর ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু। সাহাবিদের অনুভূতি ও ইচ্ছার ওপর মুহাম্মাদ (সা)’র কর্তৃত্ব ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রভাবের সুফল। এমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হলে তারা মুহাম্মাদের নবুওত লাভের দাবিকে গুরুত্বই দিত না। আর তাই মানুষ হিসেবে তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাবের জায়গাটি অপসৃত হয়ে গেলে সেই স্থানটিতে এসে পড়ে নবী হিসেবে প্রাপ্য সম্মান।

গিব মহানবীর রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বের প্রশংসা করে এ বিষয়গুলোকে তাঁর প্রতিভা ও বিচক্ষণতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
মহানবী (সা) ছিলেন উম্মি তথা নিরক্ষর। তিনি কারো কাছে পড়াশুনা করেননি।পবিত্র কুরআনেই তা উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ এই উম্মি নবী এমনসব বিধি-বিধান প্রতিষ্ঠা করে গেছেন যা মদিনার সবকিছুকে পুরোপুরি বদলে দেয় বলে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গিব উল্লেখ করেছেন। মুসলমানদের ওপর মহানবীর আধ্যাত্মিক প্রভাবের কথা তুলে ধরে গিব লিখেছেন: ইসলাম মুসলিম জাতিগুলোর মধ্যে এনেছে অভিন্নতা এবং তাদের সংস্কৃতিগুলোকেও করেছে সমন্বিত।... ইসলাম বাইরের সভ্যতাগুলোর মধ্যে লুটেরা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন জাতি হিসেবে প্রবেশ করেনি, বরং এক উন্নত নৈতিক শক্তির অধিকারী হিসেবে স্থান করে নিয়েছে ও এ ধর্ম সম্পর্কে সবার মধ্যে সম্মানবোধ জাগ্রত হয়েছে। ইসলাম একটি যৌক্তিক ধর্ম হিসেবে পূর্ব রোমের খ্রিস্ট ধর্ম ও ইরানের জরাথ্রুস্ত ধর্মকে তাদের উৎপত্তির স্থলেই চ্যালেঞ্জ করতে সক্ষম হয়েছে।
ইসলাম ধর্মের সাম্যবাদ বা সমতার নীতির ব্যাপক প্রভাব বা শক্তি তুলে ধরতে গিয়ে হ্যামিল্টন এ আর গিব ‘ যখন ইসলাম প্রতিষ্ঠা পায়’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন:
ইসলামের এখনও এমন শক্তি রয়েছে যা মানবতাকে অত্যন্ত মূল্যবান সেবা দিতে সক্ষম। ইসলাম ছাড়া আর কোনো ধর্মই বিচ্ছিন্ন জাতিগুলোকে সমতা ও ঐক্যের চিন্তার বন্ধনে একটি একক ফ্রন্টে রূপ দিতে সক্ষম নয়। আফ্রিকায়, ভারতে, ইন্দোনেশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বড় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাপান ও চীনে প্রতিষ্ঠিত ছোট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় –এসবই এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ইসলামের বাণী এখনও নানা শ্রেণী ও লিঙ্গের মানুষের ওপর প্রভাব রাখছে। যখন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বড় সরকারগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব হয় বিতর্কের বিষয় তখন এ সংকট সমাধানের জন্য ইসলামের আশ্রয় নেয়া উচিত। ইসলামই প্রথম ধর্ম যা জনগণের মধ্যে সমতা প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে আলোচনায় এনেছে।
গিবের মতে ইসলামী সমাজের মত আর কোনো ধর্মীয় সমাজই এমন ব্যাপক মাত্রায় সর্বজনীন ও সামষ্টিক চেতনায় বিশ্বাসী নয় কিংবা এতটা প্রস্তুতি রাখে না যে নিজ ধর্মের সদস্য ও সমর্থকদেরকে এই শর্তে সর্বোচ্চ স্বাধীনতা দেবে যে তারা অন্তত বাহ্যিকভাবে হলেও ধর্মীয় দায়িত্বগুলোকে মেনে নিবে।
হ্যামিল্টন এ আর গিব গিবের মতে মুহাম্মাদের ও তার বিরোধীদের দৃষ্টিতে নতুন ধর্মীয় সমাজ বলতে এমন সমাজকে বোঝাত যে তা রাজনৈতিক ভিত্তি ও পটভূমির ওপর সুসংঘটিত হয়েছে এবং স্থায়ীত্ব পেয়েছে। আর নবী-রাসুলদেরকে ধর্মীয় রাষ্ট্র গঠন ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়নি। কেবল নবী মুহাম্মাদের (সা) ধর্মেই এ দুটি বিষয়ই একসঙ্গে জড়িয়ে গেছে তা নয়, সে যুগের সব সরকারই ছিল ধর্মের ভিত্তিগুলোর ওপর প্রতিষ্ঠিত। কেবল যে বিষয়টা ছিল নতুন তা হল মদিনার ধর্মতাত্ত্বিক সমাজকে জ্ঞান-বিজ্ঞান-কেন্দ্রীক করার ভিত্তি গড়ে দেয়া। #
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।