নভেম্বর ০৭, ২০২০ ১৭:১০ Asia/Dhaka

আজ আমরা পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে আরও একজন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদের বক্তব্য ও মন্তব্য শুনব।

কবি ও দার্শনিক ফ্রিথোফ শুঅন Frithjof  Schuon ওরফে ঈসা নুরুদ্দিন আহমাদ বিংশ শতকের একজন বিখ্যাত পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব ও ইসলাম বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। জার্মান এই মনীষী ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সুইজারল্যাণ্ডের বাসেল শহরে। তার বাবা ছিলেন সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ।

পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের সাহিত্য বিষয়েও ব্যাপক পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন ফ্রিথোফ শুঅন। আরব বিশ্ব ও আরবি ভাষা সম্পর্কে গবেষণা করতে গিয়ে শুঅন ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ১৯৩২ সনে তিনি তার তৎকালীণ কর্মস্থল প্যারিসে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার নতুন নাম হয় ঈসা নুরুদ্দিন আহমাদ। 

শুঅনের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী বেশ অলৌকিক ও রোমাঞ্চকর। একদিন তিনি আদর্শ বা শ্রেষ্ঠ ধর্ম নিয়ে ভাবতে গিয়ে মনে মনে স্রস্টাকে উদ্দেশ করে এ প্রতিজ্ঞা করেন যে, হে বিধাতা! একটি নির্দিষ্ট দিনে দুপুর শুরু হওয়ার আগেই যদি তোমার পক্ষ থেকে ধর্ম বিষয়ের কোনো নিদর্শন আমার কাছে পৌঁছে তাহলে সেই নিদর্শনের আলোকেই আমি ওই ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে ধরে নিয়ে ওই ধর্ম গ্রহণ করব। সেই নির্দিষ্ট দিনটিতে শুঅন দুপুরের কাছাকাছি সময়ে ১১ টা ৪৫ মিনিটে নিজ বাসভবন থেকে বেরিয়ে এসে প্যারিসের একটি মেইনরোড বা রাজপথের দিকে হাঁটতে থাকেন। ঠিক ১১টা ৫৫ মিনিটের সময় উত্তর আফ্রিকার একদল অশ্বারোহী সেনাকে ওই রাজপথে মার্চরত অবস্থায় দেখা গেল! তারা  পুরোপুরি ইসলামী পোশাকে সজ্জিত ছিল! অবিশ্বাস্য এই দৃশ্যের অর্থ শুঅনের কাছে স্পষ্ট হল। স্রস্টার সঙ্গে করা ওয়াদা অনুযায়ী তিনি দেরি না করেই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।

শুঅন পাশ্চাত্যে থেকেও ইসলামী ঐতিহ্যের পরিবেশকে দেখতে পেতেন। তার বাসভবনটিও ছিল প্রাচ্যের ঐতিহ্যবাহী সুদৃশ্য বাসভবনের মত। ওই বাসভবনের ভেতরে গেলে কারো কাছেই এটা মনে হত না যে এর পরিবেশ ইসলামী বিশ্ব থেকে ভিন্ন কোনো পরিবেশ! ইসলামী ঐতিহ্য ও শিল্পের সঙ্গে তার নিবিড় যোগাযোগ কেবল বাহ্যিক পরিবেশেই সীমিত ছিল না। মহানবীর (সা) ঐতিহ্য অনুসরণ করে নুরুদ্দিন আহমাদ কেবল পবিত্র রমজানেই রোজা রাখতেন না অন্য অনেক সময়ও তিনি রোজা রাখতেন। যৌবনেই তার দিনগুলো শুরু হত রোজাসহ নানা ইবাতের মধ্য দিয়ে। প্রায় প্রতিদিনই তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। ১৯৯৮ সনে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কুরআনে উল্লেখিত আল্লাহর পবিত্র নামগুলোর আশ্রয় নেয়া ও আল্লাহর স্মরণ তথা জিকর্‌ করা ছিল তার প্রাত্যহিক কাজের অংশ। মহানবী (সা) সম্পর্কে বলতে গিয়ে শুঅন ওরফে নুরুদ্দিন বলতেন, ইসলাম যদি হয়ে থাকে বাস্তবতা, সৌন্দর্য ও শক্তির প্রকাশ তাহলে মহানবী (সা) নিজেই হচ্ছেন পবিত্রতা, শান্তি, দয়া বা সম্মান ও শক্তির প্রকাশ। 

শুঅন ওরফে নুরুদ্দিন আহমাদ কখনও মহানবী (সা) সম্পর্কে বই লেখেননি যাতে মহানবীর (সা) জীবনের নানা পর্যায়ের আধ্যাত্মিক তাৎপর্যগুলো স্পষ্ট হয়। কিন্তু তিনি খাঁটি মুহাম্মাদি আধ্যাত্মিকতা ও মহানবীর (সা) গুণগুলোর অর্থ নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনেক লেখালেখি করেছেন। পাশ্চাত্যের অমুসলমানদের কাছে অন্য যে কোনো ব্যক্তির চেয়ে তিনিই সবচেয়ে বেশি এ বিষয়ে ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন যে মুসলমানদের কাছে মহানবী বলতে কি বোঝায় এবং কেন মুসলমানরা মহানবীর প্রতি এত বেশি প্রেম-অনুরক্ত!

শুঅন ওরফে নুরুদ্দিন আহমাদ যখন মহানবীর (সা) পবিত্র গুণগুলো উল্লেখ করেন তখন তিনি কেবলই একজন প্রাচ্যবিদ হিসেবে লেখেন না বরং একজন বিশ্বাসী ও অনুরাগী হিসেবে হৃদয়ের গভীর থেকে লেখেন। তিনি লিখেছেন, ‘মহানবীর (সা) প্রেম ও ভালোবাসাই হচ্ছে ইসলামের প্রকৃত আধ্যাত্মিকতা। মুসলমানরা মহানবীর মধ্যে যেসব আদর্শ গুণ ও চরিত্র দেখে থাকেন সেসবই খোদায়ী গুণ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করে এবং সেসবই আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের জন্য মুক্তির পথগুলো খুলে দেয়। আর এ জন্যই মুসলমানরা মহানবীকে ভালোবাসেন এবং ক্ষুদ্রতম প্রাত্যহিক আকর্ষণের ক্ষেত্রেও তারা মহানবীকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেন।

মহানবীকে (সা) নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন শুঅন। নবুওতের নির্যাসের রহস্য শীর্ষক তার একটি প্রবন্ধ বা পুস্তিকা রয়েছে। মহানবীর (সা) প্রতি তার অনুরাগের অতুলনীয় প্রকাশ ঘটেছে এ পুস্তিকায়। মহানবীর সুপ্ত বা অদৃশ্য বাস্তবতা নিয়ে যত লেখালেখি হয়েছে এটি সেসবের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ লেখা হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যোগ্য। শুঅন মহানবীর সুন্নাত বা ঐতিহ্যগুলো সম্পর্কে ভালোভাবেই পরিচিত এবং এ বিষয়ে প্রায়ই মহানবীর (সা) অনেক হাদিস উল্লেখ করেছেন এবং সামগ্রীকভাবে ইসলামী জীবন ও বিশেষভাবে তাসাওউফ বা ইসলামী আধ্যাত্মবাদ নিয়ে লেখালেখি করেছেন।

শুঅন ওরফে নুরুদ্দিন আহমাদ মনে করেন মহানবীর (সা) রুহানি বাস্তবতা মানবীয় ও পার্থিব পর্দাগুলোর মধ্যে জড়িয়ে আছে এবং এর কারণ হল তিনি হলেন বিশ্বের জন্য আইন-প্রণেতা। তিনি লিখেছেন: মহানবীর উচ্চতর পবিত্রতা ও মুক্তি দেয়ার ক্ষমতা থেকে বোঝা যায় তিনি কেবলই ভিন্ন জগত থেকে খোদায়ি বাণী আনার ও ভিন্ন জগতের একমাত্র প্রতিনিধিই ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি আচার-আচরণের মাধ্যমে এটা দেখিয়েছেন যে তিনি খোদায়ি দিক থেকে আধ্যাত্মিক প্রেমের আদর্শ ও মানবীয় দিক থেকে যোদ্ধা ও নির্মাতা বা সংগঠক।

শুঅন ওরফে নুরুদ্দিন আহমাদের দৃষ্টিতে মহানবীর (সা) গুণাবলী গড়ে তুলেছে এমন এক ত্রিভূজ যার শীর্ষে রয়েছে প্রশান্তি ও সত্য বা সততা এবং অন্য দুই ভূজে রয়েছে সম্মান- দয়া ও শক্তি আর অল্পেতুষ্টি। তার মতে মহানবীর গুণাবলী ছাড়া অন্য কোনো গুণই নেই। কারণ এসব গুণ কেবল এমন ব্যক্তির মধ্যেই দেখা যেতে পারে যে আবারও মহানবীকে আদর্শ মনে করে ও তাঁকে অনুসরণ করেই প্রশান্তি পায়। এমন অনুসারীদের মাধ্যমেই মহানবী (সা) জীবন্ত হয়ে আছেন। 

কুরআনে মহানবীর উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে অনেক বক্তব্য রয়েছে। মহানবীর অনুসরণকে মহান আল্লাহর অনুসরণ ও তাঁর অবাধ্য হওয়াকে আল্লাহর অবাধ্য হওয়া বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তাঁর প্রিয় এই রাসুলের নামে শপথ নিয়েছেন এবং তাকে শ্রেষ্ঠ আদর্শ ও সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী বলে উল্লেখ করেছেন। কুরআনে মহানবীকে সব সময় স্মরণ করতে মুসলমানদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। নামাজেও মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র বংশধরদের উদ্দেশে সালাম আর দরুদ পাঠ করা ফরজ। মহানবীর (সা) জন্য রহমত চাইতে বলা হয়েছে কুরআনে। সুরা আহযাবের ৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে অন্য সবার আগে মহান আল্লাহ নিজে ও ফেরেশতারা মহানবীর (সা) ওপর সালাওয়াত বা দরুদ পাঠান। আর তাই ঈমানদাররাও যেন তা-ই করে ও সালাম পাঠায় এবং পুরোপুরি তাঁর নির্দেশ মেনে চলে।  

শুঅন ওরফে নুরুদ্দিন আহমাদের মতে যে মহানবীর (সা) ওপর দরুদ ও সালাম পাঠায় সে নিজের অজান্তেই বুদ্ধিমত্তা ও আত্মার প্রতি এবং সমগ্রতা ও কেন্দ্রের প্রতি সালাম আর দরুদ পাঠায়। আর এইসব প্রকাশে তা দশগুণ হয় ও এমন প্রত্যেক ব্যক্তির কাছে তা দশগুণ হয়ে ফিরে আসে। মহানবী ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের প্রতি অশেষ দরুদ ও সালাম।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।