পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-৯)
গত আসরে আমরা সারা বিশ্বে বিশেষকরে পাশ্চাত্যে আত্মহত্যার প্রবণতা নিয়ে কথা বলেছি। আত্মহত্যার নানা দিক বিশ্লেষণের পর যে প্রশ্নটি আমাদের সামনে এসেছে তাহলো বৈজ্ঞানিক উন্নতি এবং অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের পরও পাশ্চাত্যের মানুষ কেন আত্মহত্যা করে? আজকের আসরে এ বিষয়েই বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করব।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সামাজিক সুস্থতা ঝুঁকির মুখে পড়লে সেখানে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ে। নানা কারণে সামাজিক সুস্থতা ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। যেমন পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়া,পারস্পরিক মমত্ববোধের অভাব, বেকারত্ব,অর্থনৈতিক সমস্যা,মাদকাসক্তি,মদ তথা অ্যালকোহলের যথেচ্ছ ব্যবহার, সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি ভ্রুক্ষেপহীনতা,তালাকের সংখ্যাধিক্য,শিশু-কিশোরদের প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধির মতো সমস্যাগুলো মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা ও হতাশাসহ নানা মানসিক ব্যাধির জন্ম দিতে পারে। আর এসব ব্যাধিই এক সময় একজন ব্যক্তিকে আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যারা আত্মহত্যা করে তাদের সবার মধ্যে অভিন্ন যে সমস্যাটি দেখা দেয় তাহলো মানসিক অস্বস্তি ও অশান্তি। এ ধরণের পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতেই তারা ধ্বংসাত্মক পথ বেছে নেয়। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার নিজের সঙ্গেই চরম অবিচার করে।

পাশ্চাত্য চিন্তা-দর্শনে মূলত: মানুষের দৃশ্যমান ও বাহ্যিক দিকগুলোই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। মানুষের জীবন ব্যবস্থার গভীরতর স্তরগুলো তাদের চিন্তা-দর্শনে সেভাবে আসেনি। বিশেষকরে মানুষের আত্মিক জগতকে পুরোপুরি এড়িয়ে চলছে পাশ্চাত্য সভ্যতা। এ কারণে অনেক ইস্যুতেই তাদেরকে হঠাৎ করেই অচলাবস্থা ও গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন হতে দেখা যায়। তারা আত্মিক বা আধ্যাত্মিক শূন্যতা পূরণে এমন সব পন্থা বেছে নিচ্ছে যা যথোপযুক্ত নয়। আত্মিক দিক উপেক্ষিত হওয়ায় আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাসই হয়ে উঠেছে পাশ্চাত্য-সমাজের চূড়ান্ত গন্তব্য। আত্মিক প্রশান্তি বলে যে একটা কিছু রয়েছে তা যেন ভুলেই গেছে তারা। আরাম-আয়েশ ও ভোগ-বিলাস যে কখনোই আত্মিক প্রশান্তির বিকল্প হতে পারে না তা এখনও পাশ্চাত্য-সমাজ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। জার্মানির বিখ্যাত মনস্তত্ত্ববিদ এরিক ফ্রম তার রচিত 'ম্যান ফর হিমসেল্ফ'বইয়ে লিখেছেন,"আজকাল মানুষ আর প্রশান্তি অনুভব করে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ এক ধরণের দেউলিয়াত্বের শিকার। নিজের কাজকর্মও তাদের কাছে নিরর্থক মনে হয়।"
মার্কিন লেখক বুকানান জে.পেট্রিক লিখেছেন,নীতি-নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিকতার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কারণে পশ্চিমা সভ্যতায় ধর্মপরায়ণ ও সম্মানিত ব্যক্তিদের উপর চরম দুর্দশা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে,আর এ কারণেই এই সভ্যতা অগ্রহণযোগ্য ও ঘৃণ্য। পাশ্চাত্য সভ্যতার পেছনে যে আইডিওলোজি বা জ্ঞান-তত্ত্ব কাজ করছে তা মানব প্রকৃতির সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। তিনি সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার সমালোচনা করে লিখেছেন, সমকামীরা প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং প্রকৃতিও মানুষকে চরম শাস্তি দিচ্ছে। বর্তমানে লাখ লাখ মানুষ এইডস বা এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চরম সংকটে দিনাতিপাত করছে। মার্কিন এই লেখক পশ্চিমা সভ্যতার প্রভাবকে মারাত্মক মাদকদ্রব্য হেরোইনের ভয়াবহ প্রভাবের সঙ্গে তুলনা করেছেন। হেরোইন যেমন প্রথমে মানুষকে দৃশ্যত সুখানুভূতি দিলেও ক্রমেই তা মানবদেহকে বিকল করে দিয়ে মাদকসেবীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়,তেমনি পশ্চিমা সভ্যতাও বাহ্যত আকর্ষণীয় হলেও এর চূড়ান্ত ফল বিষময়। আমেরিকার আরেক বিখ্যাত লেখক কেনেথ মিনং তার নিউ স্ট্যান্ডার্ড শীর্ষক বইয়ে লিখেছেন,পশ্চিমা সভ্যতা নীতি-নৈতিকতা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।
আসলে পাশ্চাত্যের মানুষ এখন প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিকতার সংকটে ভুগছে। চিন্তা-চেতনায় আধ্যাত্মিকতার অনুপস্থিতি পাশ্চাত্যে এখন যে লাইফ স্টাইলের প্রচলন ঘটিয়েছে তা ভয়াবহ পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। মানুষের লাইফ স্টাইলের সঙ্গে অনেক কিছু জড়িত। সৃষ্টি জগত সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি,জীবনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি এবং তার আচার-আচরণের সঙ্গে লাইফ স্টাইলের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। পাশ্চাত্য-দর্শনে মানুষ হচ্ছে সব কিছুর ঊর্ধ্বে। বৈজ্ঞানিক সূত্র দিয়ে এখনও প্রমাণিত নয় এমন কোনো কিছুকেই তারা গুরুত্ব দেয় না। স্বাতন্ত্রবাদ, ভোগবাদ ও ধর্ম-বিমুখতা তাদের লাইফ স্টাইলের মূল ভিত্তি। আর আত্মহত্যার মতো ধ্বংসাত্মক প্রবণতার পেছনেও রয়েছে এ ধরণের লাইফ স্টাইল। মানসিক অশান্তি ও অস্থিরতার পেছনে রয়েছে আধ্যাত্মিকতা তথা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করার মতো দুঃসাহস। এ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,মানুষের মনের মূল ওষুধ হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক বা ঐশীপ্রেম যে প্রশান্তি এনে দেয় বৈষয়িক প্রাচুর্য কখনোই তা দিতে পারে না।
আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপিত হলে মানুষের কাছে তার জীবন অর্থপূর্ণ ও মূল্যবান বলে মনে হয়। মানুষ তার আত্মিক ও মানসিক শূন্যতা থেকে মুক্তি পায় এবং হতাশা ও বিষণ্ণতা দূর হয়। তার কাছে জীবনটা কখনোই অর্থহীন মনে হয় না। পৃথিবীর জীবনকেও সে এক ধরণের সুযোগ হিসেবে দেখে,প্রতি মুহূর্তকে কাজে লাগিয়ে আল্লাহর কাছে আরও বেশি মর্যাদাবান হওয়ার চেষ্টা করে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন,অর্থ-সম্পদ,সমর শক্তি ও বিজ্ঞান আমেরিকার মতো পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মানুষের জন্য সুখ ও প্রশান্তি নিশ্চিত করতে পারেনি,এর কারণ হলো আল্লাহ-বিমুখতা ও আধ্যাত্মিকতাকে অস্বীকার। তিনি মনে করেন,নয়া ইসলামি সভ্যতা গড়ে তুলতে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সব ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিকতা ও নীতি-নৈতিকতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রত্যেক সমাজের জন্যই আধ্যাত্মিকতা ও নীতি-নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন,আধ্যাত্মিকতা ও নৈতিকতার উপস্থিতি বৈষয়িক সমস্যার সম্মুখীন জীবনকেও বেহেশতে রূপ দিতে পারে। কিন্তু এসবের অনুপস্থিতি বৈষয়িক বৈষয়িক প্রাচুর্যপূর্ণ জীবনকেও জাহান্নামের দিতে ঠেলে দিতে পারে।
আসলে ইসলাম ধর্ম মনে করে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে উপেক্ষা করে প্রকৃত সুখ ও প্রশান্তি অর্জন সম্ভব নয়। পাশ্চাত্যে বৈষয়িক প্রাচুর্য সত্ত্বেও আত্মহত্যার প্রবণতার কারণ সংক্রান্ত আজকের আলোচনা আমরা শেষ করতে যাচ্ছি। তবে বিদায় নেওয়ার আগে আত্মহত্যার বিষয়ে ধর্মের দিক-নির্দেশনা আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। ইসলাম ধর্মে আত্মহত্যা মহাপাপ। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ আত্মহত্যার পরিণামে কঠোর শাস্তির বর্ণনা দিয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা নিসার ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘তোমরা নিজেদের হত্যা কোরো না,নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমা লঙ্ঘন করে অন্যায়ভাবে তা (আত্মহত্যা) করবে, তাকে অগ্নিতে দগ্ধ করব;এটা আল্লাহর পক্ষে সহজ।’ ইসলামি চিন্তাবিদদের মতে, যখন কেউ অসহায় ও আশাহত বোধ করে এবং তার মনে আত্মহত্যার কুচিন্তা আসে, তখন তাকে মনে করতে হবে এখন কুমন্ত্রণাদাতা শয়তানের দুরভিসন্ধি এসেছে। কখনো আত্মহত্যার কথা মনে এলে নিজকে রক্ষার জন্য নামাজের মাধ্যমে বিনীতভাবে আল্লাহর দয়া ও সাহায্য চাইতে হবে।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৫
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।